কোনো দুর্বল সরকার সফল দরকষাকষি করেছে- ইতিহাসে এ নজির খুব কম। একটি অসমন্বিত (সমন্বয় নেই এমন) সরকার তার সবচেয়ে বড় সুযোগগুলো কাজে লাগাতে পেরেছে- এমন ইতিহাসও খুব নেই। এ কারণে বর্তমানে (শুল্ক নিয়ে আলোচনায়) আমরা একটা কর্দমাক্ত অবস্থায় রয়েছি।
Advertisement
যুক্তরাষ্ট্রের আরোপিত শুল্ক নিয়ে দর-কষাকষিতে সরকারের ভূমিকার সমালোচনা করে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মানীয় ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য এমন মন্তব্য করেন।
তিনি বলেন, এটি এমন এক সমন্বয়হীন সরকার, যার বিভিন্ন কাজের নেতৃত্বে কে আছেন, এটা বোঝা যায় না। এছাড়া এ ধরনের সরকারের রাজনৈতিক বৈধতা না থাকলে সেটিও বড় দুর্বলতার অংশ হয়। বর্তমানে যেহেতু সরকার দুর্বল, সেহেতু শুল্কের আলোচনায় দুর্বলতার ঘাটতি পূরণ করতে বিশেষজ্ঞ ও অংশীজনদের সম্পৃক্ত করা প্রয়োজন ছিল। সেটি হয়নি।
রোববার (২০ জুলাই) রাজধানীর একটি হোটেলে ‘যুক্তরাষ্ট্রের পাল্টা শুল্ক: কোন পথে বাংলাদেশ’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে এ মন্তব্য করেন তিনি।
Advertisement
এই অর্থনীতিবিদ বলেন, বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের কার্যক্রমে মনে হচ্ছে আমরা একটা অত্যন্ত নিরপরাধ, নির্দোষ ও নিষ্পাপ সরকারকে সঙ্গে নিয়ে সামনে আগানোর চেষ্টা করছি।
সরকারকে নিরপরাধ, নির্দোষ ও নিষ্পাপ বলার ব্যাখ্যায় দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, আমরা এখানে বসে এত কিছু বুঝি আর ওনারা (সরকারে থাকা ব্যক্তিরা) বোঝেন না। আমার কাছে তো এটি আশ্চর্য লাগে। এজন্যই বললাম এত নির্দোষ, নিরপরাধ ও নিষ্পাপ সরকার আমি দেখিনি। বর্তমানে (শুল্ক নিয়ে আলোচনায়) আমরা একটা কর্দমাক্ত অবস্থায় রয়েছি। তবে সবাই মিলে ওই ঘাটতি পূরণ করতে পারব, এ ভরসায় আছি।
আগের সরকারের সঙ্গে বর্তমান সরকারের পার্থক্য তুলে ধরে দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, আমি একাধিক সরকারের সঙ্গে কাজ করেছি। আগের সরকারের সমস্যা ছিল তারা হয়তো কোনো বিষয়ে জানত না। এরপর আমরা কিছু নিয়ে গেলে ওনারা বলতেন, ও তাই নাকি? আচ্ছা, আমাদের পরামর্শগুলো দেন, বাস্তবায়ন করি। আর এখনকার সরকারের কাছে গেলে তারা বলে, এগুলো তো সব জানি। এসব নিয়ে আপনারা কোনো চিন্তা করবেন না।
যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দরকষাকষিতে শুল্কের বাইরেও বিভিন্ন অশুল্ক বিষয় রয়েছে উল্লেখ করে দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, এখানে শুধু অর্থনীতি নয়, এর সঙ্গে রাজনীতি-অর্থনীতি ও ভূরাজনীতি জড়িত। ফলে এটিকে যারা শুধু একটা শুল্ক সমস্যা হিসেবে দেখেন, তারা ঠিক দেখছেন না। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্য নিয়ে দরকষাকষিতে সেবা খাতের বিষয়টি একদমই সামনে আনা হয়নি। উপদেষ্টা থেকে শুরু করে অন্য যারা দরকষাকষির সঙ্গে যুক্ত, তাদের মুখে এটি নিয়ে কোনো কথা নেই। অথচ এই সেবা খাতের সঙ্গে আমাদের তৈরি পোশাক, ওষুধ ও অন্য রপ্তানি খাতও জড়িত।
Advertisement
শুল্ক নিয়ে দরকষাকষিতে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে করা গোপনীয়তা (নন-ডিসক্লোজার) চুক্তির সমালোচনা করে দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, গোপনীয়তা চুক্তিতে স্বাক্ষরের পরিবর্তে উচিত ছিল একটি নর্ম পেপার (নীতিগত অবস্থানের পত্র) ইস্যু করা।
ট্রাম্পের পাল্টা শুল্ক আরোপের সিদ্ধান্ত একটা ভুল অর্থনৈতিক নীতির ভিত্তিতে পরিচালিত হচ্ছে বলে জানান দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। তিনি বলেন, আজ হোক, কাল হোক, এখান থেকে তারা ফিরে যেতে বাধ্য হবে। মার্কিন অর্থনীতিতে মূল্যস্ফীতি শুরু হলে, প্রবৃদ্ধি কমলে, কর্মসংস্থান কমলে এটির উপসর্গ দেখা যাবে। গত মাস পর্যন্ত মার্কিন অর্থনীতিতে সে ধরনের কোনো ধাক্কা আসেনি। তবে আগামী ছয় মাসের মধ্যে এটা আসতে পারে। ফলে এ বিষয়গুলো মাথায় রেখে দরকষাকষি করতে হবে।
দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, আমি আপনাদের জোর দিয়ে বলতে পারি, ট্রাম্পের পাল্টা শুল্কের বিষয়টি টিকবে না। কারণ, এটি অবৈজ্ঞানিক। তবে সেই পর্যায়ে যাওয়ার আগে অন্তর্বর্তী সময়ের জন্য আমাদের কর্মসংস্থান ও বিনিয়োগকে প্রাধান্য দিয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
এ সময় সিপিডির সম্মানীয় ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, পাল্টা শুল্ক নিয়ে সরকার ভেবেছিল, আলাপ-আলোচনা করে সমাধান করবে। এ নিয়ে সরকারের এক ধরনের কৃতিত্ব নেওয়ার মানসিকতা ছিল। দরকষাকষির সঙ্গে সম্পৃক্ত ব্যক্তিরা ভেবেছিলেন, পাল্টা শুল্ককে ১০ শতাংশ বা শূন্য শতাংশে নামিয়ে আনতে পারবেন। সরকারি পর্যায়ে এমন আত্মবিশ্বাস ও অতি আত্মবিশ্বাসের খেসারত দিচ্ছি।
মোস্তাফিজুর রহমান আরও বলেন, আমাদের প্রতিযোগী দেশগুলো শুল্ক আলোচনায় কোন অবস্থায় থাকছে, সেটি আমাদের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। এ বিষয়ে খেয়াল রাখতে হবে। তার মতে, পাশাপাশি অশুল্ক বাধা ও ভূরাজনৈতিক কৌশলের নানান ইস্যু আছে। সেখানে আমাদের সার্বভৌমত্ব, অন্য দেশের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক- এসব আমরা কতটুকু করতে পারব, কতটুকু পারব না, তা-ও বিবেচনায় আনতে হবে।
এসএম/এএমএ/জিকেএস