রাজনৈতিক বিতর্ক ও বিরোধিতা উপেক্ষা করে জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনের (ওএইচসিএইচআর) কার্যালয় স্থাপনের অনুমতি দিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। তারা এ সিদ্ধান্তকে মানবাধিকার উন্নয়ন এবং আন্তর্জাতিক অংশীদারত্ব জোরদারের একটি ইতিবাচক পদক্ষেপ হিসেবে দেখছে। তবে বিশ্লেষকদের আশঙ্কা, এই পদক্ষেপ বাংলাদেশকে বিশ্বের সবচেয়ে সংকটাপন্ন দেশগুলোর কাতারে ফেলবে। এর বিরূপ প্রভাব পড়তে পারে বিদেশি বিনিয়োগ, কূটনৈতিক সম্পর্ক ও অভ্যন্তরীণ নীতিনির্ধারণে।
Advertisement
জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনের কার্যালয় স্থাপনের মাধ্যমে বাংলাদেশ বড় ইমেজ সংকটে পড়বে বলে মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. ইমতিয়াজ।
জাগো নিউজকে তিনি বলেন, সরকারের একাধিক উপদেষ্টা জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনের সঙ্গে আগেও কাজ করেছেন। তারা হয়তো মনে করেন, এ ধরনের কিছু হলে বাংলাদেশের লাভ হতে পারে। কিন্তু আমাদের মানবাধিকার পরিস্থিতিতে যে ঘাটতি আছে, সেটা জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশন এসে কীভাবে ঠিক করবে? এটি আমাদের দেশের মানুষেরই করতে হবে। বিদেশিরা আসলে বরং এতে আরও সমস্যা তৈরি হতে পারে।
বিশ্বের ১৮ দেশে জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনের কার্যালয় রয়েছে, বাংলাদেশ যদি সেই তালিকায় চলে যায়, তাহলে এটা আমাদের জন্য বিরাট ইমেজ সংকট হবে। স্বাভাবিকভাবেই এর প্রভাব বিনিয়োগের ওপর পড়বে। বিনিয়োগকারীরা তখন বাংলাদেশকে ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে বিবেচনা করে অন্য দেশে চলে যাবে।
Advertisement
অধ্যাপক ড. ইমতিয়াজ বলেন, বিশ্বের ১৮ দেশে জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনের কার্যালয় রয়েছে, বাংলাদেশ যদি সেই তালিকায় চলে যায়, তাহলে এটা আমাদের জন্য বিরাট ইমেজ সংকট হবে। স্বাভাবিকভাবেই এর প্রভাব বিনিয়োগের ওপর পড়বে। বিনিয়োগকারীরা তখন বাংলাদেশকে ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে বিবেচনা করে অন্য দেশে চলে যাবে। এটা না বোঝার কোনো কারণ নেই।
বর্তমানে জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনের স্থায়ী কার্যালয় রয়েছে ১৬ দেশে, যেগুলোর বেশিরভাগই আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকায়। এসব দেশ বহুদিন ধরেই রাজনৈতিক অস্থিরতা, মানবাধিকার লঙ্ঘন, দুর্নীতি, অর্থনৈতিক বিপর্যয় কিংবা গৃহযুদ্ধের অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে গেছে বা এখনো যাচ্ছে। দেশগুলো হলো- বুরকিনা ফাসো, কম্বোডিয়া, চাদ, কলম্বিয়া, গুয়াতেমালা, গিনি, হন্ডুরাস, লাইবেরিয়া, মৌরিতানিয়া, মেক্সিকো, নাইজার, ফিলিস্তিন, সিরিয়া (লেবাননের বৈরুত থেকে পরিচালিত), সুদান, তিউনিসিয়া এবং ইয়েমেন।
এর বাইরে দক্ষিণ কোরিয়া ও ইউক্রেনেও ওএইচসিএইআরের পৃথক কার্যালয় রয়েছে। এছাড়া জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশন পরিচালিত নয়টি দেশেও সংস্থটি কাজ করছে, তবে সেগুলো আলাদা কাঠামোতে পরিচালিত হয়।
ড. ইমতিয়াজ বলেন, বুরকিনা ফাসো, কম্বোডিয়া বা মেক্সিকোর যে ভয়াবহ অবস্থা—তাদের সঙ্গে যদি বাংলাদেশকে এক কাতারে ফেলা হয়, তাহলে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আমাদের অবস্থান ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
Advertisement
দক্ষিণ এশিয়ার কোনো দেশেই জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিশনের কার্যালয় নেই উল্লেখ করে তিনি বলেন, বাংলাদেশে এভাবে হঠাৎ করে একটি অফিস চালু হলে এর অর্থনৈতিক প্রভাব পড়বে। এমনিতেই বাংলাদেশিদের জন্য অনেক দেশ ভিসা পাওয়া কঠিন করে দিয়েছে, এই সিদ্ধান্তে তা আরও কঠিন হতে পারে।
আরও পড়ুন অবশেষে ঢাকায় চালু হচ্ছে জাতিসংঘ মানবাধিকার পরিষদের মিশন ঢাকায় জাতিসংঘ মানবাধিকার মিশন চালু নিয়ে হেফাজতের প্রতিবাদ জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনের এজেন্ডা দেশবিরোধী: মামুনুল হকবাংলাদেশে মানবাধিকার ঘাটতি আছে- এতে কোনো সন্দেহ নেই মন্তব্য করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এ অধ্যাপক বলেন, জুলাই-অগাস্টে আমাদের মানুষই অনেক কিছু ত্যাগ করেছে। সেই আত্মত্যাগের বিনিময়ে আজকের বাংলাদেশ গড়ে উঠেছে। এখন যদি এমন কিছু করা হয়, তাহলে আমরা বড় ইমেজ সংকটে পড়তে পারি।
যুক্তরাষ্ট্র নিজেই এই কমিশন থেকে বেরিয়ে গেছে জানিয়ে তিনি আরও বলেন, গাজা পরিস্থিতির মতো লাইভ জেনোসাইডেও এই কমিশন কিছুই করতে পারেনি। যেসব দেশে তাদের কার্যালয় আছে সেসব দেশেও মানবাধিকার পরিস্থিতিতে উল্লেখযোগ্য কোনো উন্নতি দেখা যায়নি।
ঢাকায় জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিশনের কার্যালয় হলে বাংলাদেশের ওপর ভারতের হস্তক্ষেপ কমবে। কারণ, সংখ্যালঘু ইস্যুতে ভারত সবসময় বাংলাদেশকে চাপে রাখতে চায়। জাতিসংঘ কমিশন থাকলে সেটা কমে আসবে।
গত ২৯ জুন আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল বাংলাদেশে ওএইচসিএইচআরের অফিস খোলার বিষয়টি এক সংবাদ সম্মেলনে প্রথম জানান। এর এক মাসেরও কম সময়ে সরকারের সঙ্গে এক সমঝোতা স্মারক সইয়ের মধ্য দিয়ে ঢাকায় জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক কমিশন চালু হতে যাচ্ছে। গত বৃহস্পতিবার জাতিসংঘের পক্ষ থেকে ঘোষণার একদিন পর শনিবার সরকারের পক্ষ থেকেও আনুষ্ঠানিক ঘোষণা হয়। ১৯তম দেশ হিসেবে বাংলাদেশে এই কার্যালয় স্থাপন করতে যাচ্ছে সংস্থাটি।
শনিবার (১৯ জুলাই) অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং এক বিজ্ঞপ্তিতে জানিয়েছে, ‘মানবাধিকার সুরক্ষা ও বিকাশে সহায়তা করার লক্ষ্যে একটি মিশন খোলার জন্য জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনারের অফিস এবং বাংলাদেশ সরকার তিন বছর মেয়াদি একটি সমঝোতা স্মারক সই করেছে।’
অভ্যন্তরীণ অস্থিরতা বাড়ার আশঙ্কানাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন মানবাধিকারকর্মী জাগো নিউজকে বলেন, বাংলাদেশের মানবাধিকারের অবস্থা এত খারাপ নয় যে জাতিসংঘ মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনারের কার্যালয় স্থাপন করতে হবে। এর ফল ভালো হবে না।
উদাহরণ টেনে তিনি বলেন, বাংলাদেশে বর্তমানে ১২ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা শরণার্থী আশ্রয় নিয়েছে। অথচ দেশটি এখনো জাতিসংঘের ১৯৫১ সালের শরণার্থী কনভেনশন এবং সংশ্লিষ্ট প্রটোকলে সই করেনি। একইভাবে, আদিবাসী জনগোষ্ঠীর অধিকার সংক্রান্ত কনভেনশনসহ বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক চুক্তি থেকেও বাংলাদেশ এখনো বিরত রয়েছে, যেগুলো জাতিসংঘ অগ্রাধিকারভিত্তিতে বিবেচনা করে।
তার মতে, ঢাকায় জাতিসংঘের মানবাধিকার কার্যালয় স্থাপিত হলে সংস্থাটি এসব কনভেনশনে বাংলাদেশের সই নিশ্চিত করতে চাপ দেবে। এতে রাজনৈতিক অঙ্গনে মতপার্থক্য ও অস্থিরতা দেখা দিতে পারে বলে আশঙ্কা রয়েছে। তাছাড়া জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনের কার্যালয়ে স্থানীয় কর্মকর্তাদের দায়মুক্তির যে বিধানের কথা বলা হয়েছে- সে বিষয়ে আপত্তি জানান তিনি।
তবে এই মানবাধিকারকর্মী মনে করেন, ঢাকায় জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিশনের কার্যালয় হলে বাংলাদেশের ওপর ভারতের হস্তক্ষেপ কমবে। কারণ, সংখ্যালঘু ইস্যুতে ভারত সবসময় বাংলাদেশকে চাপে রাখতে চায়। জাতিসংঘ কমিশন থাকলে সেটা কমে আসবে।
ইসলামি দলগুলোর আপত্তিওএইচসিএইচআর সাধারণত স্থানীয়ভাবে লিঙ্গভিত্তিক অধিকার, আবাসন ও ভূমি ব্যবস্থাপনা, বৈষম্য হ্রাস, স্বাস্থ্যসেবা এবং বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন মানুষের অধিকার নিয়ে কাজ করে। তবে, এই কমিশনের ভূমিকাকে ঘিরে প্রশ্ন তুলেছেন অনেকেই-বিশেষ করে ইসলামপন্থি রাজনৈতিক দল ও সংগঠনগুলো।
আরও পড়ুন যুদ্ধবিরতির পরেও সিরিয়ায় সাম্প্রদায়িক সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ছে এখনো হাসপাতালে জুলাই আহতরা, মানসিক বিপর্যয়ে ৬৭ শতাংশ পরিকল্পিতভাবে গাজার সব ভবন ধ্বংস করে দিচ্ছে ইসরায়েল: বিবিসিশনিবার এক বিবৃতিতে হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ বলেছে, ‘বাংলাদেশে মানবাধিকার কমিশনের অফিস খুলতে দেওয়া হবে না।’ চুক্তি বাতিল না করলে কঠোর কর্মসূচি ঘোষণার হুঁশিয়ারি দিয়েছে তারা।
এ নিয়ে এক বিবৃতিতে অভিযোগ করা হয়, ‘অতীতেও দেশি-বিদেশি বিভিন্ন সংস্থা ইসলামি শরিয়াহ, পারিবারিক আইন ও ধর্মীয় মূল্যবোধে হস্তক্ষেপের চেষ্টা করেছে। নারী সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনে সেই প্রবণতা স্পষ্ট। এছাড়া এলজিবিটি ইস্যুকে ওএইচসিএইচআরের মানবাধিকার নীতির অংশ হিসেবে তুলে ধরা নিয়েও আমাদের গভীর উদ্বেগ রয়েছে।’
এর আগে শুক্রবার রাজধানীতে বিক্ষোভ মিছিল করে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ ও বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস।
ইসলামী আন্দোলনের কেন্দ্রীয় সহকারী সেক্রেটারি ইমতিয়াজ আলম বলেন, ফিলিস্তিন, আফগানিস্তানসহ বিভিন্ন দেশে মুসলমানদের ওপর নির্যাতনে এই কমিশনের ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ। এখন তারা বাংলাদেশে মানবাধিকার শেখাতে চায়?
জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) উত্তরাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক সারজিস আলম সমঝোতা স্মারক নিয়ে ফেসবুকে পোস্ট করেন। এতে তিনি ওএইচসিএইচআরের পক্ষপাতমূলক ও সাম্রাজ্যবাদ-সমর্থক ভূমিকার সমালোচনা করেন।
উদ্বেগ আমলে নিয়েছে সরকারশনিবার প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং থেকে পাঠানো বিজ্ঞপ্তিতে বিভিন্ন পক্ষের আপত্তির বিষয়টি তুলে ধরে বলা হয়েছে, ‘আমরা স্বীকার করি জাতিসংঘের মানবাধিকার সংস্থাগুলির আদর্শিক অবস্থান নিয়ে সমাজের একটি অংশের উদ্বেগ রয়েছে। বাংলাদেশের সমাজ ব্যবস্থা একটি শক্তিশালী সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় ঐতিহ্যের ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে। অনেক নাগরিক আমাদের জানিয়েছেন যে কোনো আন্তর্জাতিক অংশীদারত্বের ক্ষেত্রে এই মূল্যবোধের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়া উচিত।’
‘এ প্রেক্ষিতে, ওএইচসিএইচআর মিশন মানবাধিকারের যে কোনো গুরুতর লঙ্ঘনের প্রতিরোধ ও প্রতিকার, বিগত সরকারের মানবাধিকার লঙ্ঘনের জন্য জবাবদিহি নিশ্চিত করার ওপর মনোনিবেশ করবে। এটি দেশের প্রতিষ্ঠিত আইনি, সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক কাঠামোর বাইরে থাকা কোনো সামাজিক এজেন্ডা উৎসাহিত করবে না।’
সমঝোতা সইয়ের পর প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং থেকে বলা হয়, ‘বিগত সরকারের সময় বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড এবং গণহত্যার দায়মুক্তির যেসব ঘটনা ঘটেছে- সে সময় যদি এ ধরনের একটি সংস্থার কার্যক্রম চলমান থাকত, তাহলে সেই অপরাধের অনেকগুলো ঘটনা হয়তো সঠিকভাবে তদন্ত, লিপিবদ্ধ এবং বিচার করা হতো।’
অন্তর্বর্তী সরকারের গুম কমিশনের সদস্য এবং মানবাধিকার কর্মী নূর খানও মনে করেন সরকারের এই সিদ্ধান্ত ইতিবাচক।
জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনারের কার্যালয় (ওএইচসিএইচআর) জাতিসংঘ সচিবালয়ের একটি বিভাগ। সংস্থাটির ওয়েবসাইট অনুযায়ী, তারা সংশ্লিষ্ট দেশকে মানবাধিকার বিষয়ক বাধ্যবাধকতা পূরণে সহায়তা করে, লঙ্ঘনের ঘটনায় নিরপেক্ষভাবে আওয়াজ তোলে এবং প্রতিকারের উপায় খোঁজে।
ওএইচসিএইচআরের সদর দপ্তর জেনেভায়। তবে নীতিনির্ধারণী একটি অফিস রয়েছে নিউইয়র্কে।
জেপিআই/কেএসআর/এএসএম