শেখ হাসিনার ১৫ বছরের শাসনামলে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ ও ত্রুটিপূর্ণ নীতির কারণে অস্পষ্ট ছিল দেশের ব্যাংক ব্যবস্থার প্রকৃত অবস্থা। গত ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর বের হয়ে আসে ব্যাংকখাতের আসল চিত্র। নানান অনিয়ম ও দুর্নীতির কারণে লোকসানে থাকা ব্যাংকগুলোর ঋণের বড় একটি অংশ এখন খেলাপি। অনেক ক্ষেত্রে গ্রাহকের আমানত ফেরত দিতে পারছে না ব্যাংকগুলো।
Advertisement
এমতাবস্থায় ব্যাংকখাতে আস্থা ফেরাতে এবং দীর্ঘদিন ধরে লোকসানে থাকা (ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক, ইউনিয়ন ব্যাংক এবং এক্সিম ব্যাংক) ব্যাংককে পুনরুজ্জীবিত করতে একীভূত করার উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এতে যেমন সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে, তেমনি দেখা দিয়েছে নানান শঙ্কা।
এরই অংশ হিসেবে অভ্যুত্থানের পর এক্সিম ব্যাংক ছাড়া বাকি চারটি ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদে বড় পরিবর্তন আনা হয়। এ চার ব্যাংকে স্বতন্ত্র পরিচালকদের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।
‘শুধু ব্যাংক একীভূতকরণের উদ্যোগ নিলেই হবে না, সেটি হতে হবে বাস্তবভিত্তিক। দুর্বল ব্যাংক মার্জ করে সরকার দায়িত্ব নিলে একটি শক্তিশালী ইসলামী ব্যাংক গড়ে উঠবে।— অর্থনীতিবিদ এম হেলাল আহমেদ জনি
Advertisement
পাঁচ ব্যাংকের সম্মিলিত আমানত এক লাখ ৪৭ হাজার ৩৬৮ কোটি টাকা ও ঋণ বিতরণ এক লাখ ৯০ হাজার ৪৮৪ কোটি টাকা। এর মধ্যে এক লাখ ৪৬ হাজার ৯১৮ কোটি টাকা, অর্থাৎ প্রায় ৭৭ শতাংশ খেলাপি। মূলধন ঘাটতি বিশাল হলেও পরিশোধিত মূলধন মাত্র ৫ হাজার ৮১৯ কোটি টাকা। তবুও গ্রাহক সংখ্যা ৯২ লাখ এবং কর্মকর্তা-কর্মচারী ১৬ হাজার।
গ্রাহক ও কর্মীদের দোলাচলঅনেকে সম্ভাবনার দিকে তাকিয়ে থাকলেও গ্রাহকদের মধ্যে আমানত নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ রয়েছে। কর্মীরা শঙ্কায় রয়েছেন চাকরি ও অবস্থান হারানো নিয়ে। এরই মধ্যে কিছু ব্যাংক আমানত হারাতে শুরু করেছে।
এক্সিম ব্যাংকের আপত্তিমার্জারের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে এক্সিম ব্যাংক। ব্যাংকটির দাবি, তারা স্বনির্ভর ও মজবুত। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংকের অ্যাসেট কোয়ালিটি রিভিউ অনুযায়ী, এক্সিমের ৫২ শতাংশ ঋণই অনাদায়ী এবং প্রভিশন ঘাটতি ১৫ হাজার ১১৭ কোটি টাকা।
আরও পড়ুন পদত্যাগ করলেন ইসলামী ব্যাংকের চেয়ারম্যান ওবায়েদ উল্লাহ আবারও ৮ শতাংশের নিচে আমানতের প্রবৃদ্ধি সেরার তালিকায় ১০ ব্যাংক ও ২ আর্থিক প্রতিষ্ঠান আইএমএফের চাপ ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অবস্থানআন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) নিয়মে ৩০ শতাংশের বেশি খেলাপি থাকলে ব্যাংককে বিলুপ্ত বা পুনর্গঠন করতে হয়। সব ব্যাংকই সেই সীমা পেরিয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আশ্বস্ত করেছেন— এ প্রক্রিয়ায় কারও চাকরি যাবে না, কেবল অতিরিক্ত শাখা স্থানান্তর হতে পারে।
Advertisement
মার্জারের ফলে দেশের বৃহত্তম ইসলামী ব্যাংক গড়ে উঠবে— ৭৭৯টি শাখা, ৬৯৮ উপশাখা, ৫০০ এজেন্ট আউটলেট ও হাজারের বেশি এটিএম বুথসহ। এতে প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়বে, খরচ কমবে, উৎপাদনশীলতা ও গ্রামীণ ব্যাংকিংয়ে ভূমিকা বাড়বে।
একিউআর অনুযায়ী ৫ ব্যাংকের আর্থিক চিত্র উদ্বেগজনকবাংলাদেশ ব্যাংকের সাম্প্রতিক অ্যাসেট কোয়ালিটি রিভিউ (একিউআর) প্রতিবেদনে দেখা গেছে, বেশ কয়েকটি ব্যাংকের আর্থিক অবস্থা অত্যন্ত নাজুক। বিশেষ করে আমানতের তুলনায় উচ্চহারে ঋণ বিতরণ এবং বিপুল পরিমাণ খেলাপি ঋণ তাদের মূলধন ও লোকসানে বড় ধাক্কা দিয়েছে।
এক্সিম ব্যাংক বর্তমানে ৪২ হাজার ৯৯৩ কোটি টাকার আমানতের বিপরীতে ৫১ হাজার ৬৪২ কোটি টাকা ঋণ দিয়েছে। এর মধ্যে ২৫ হাজার ১০১ কোটি টাকা বা প্রায় ৪৯ শতাংশ ঋণই খেলাপিতে পরিণত হয়েছে। ব্যাংকটির পরিশোধিত মূলধন এক হাজার ৪৪৮ কোটি টাকা, শাখা ১৫৫টি এবং চলতি লোকসান ৪০৯ কোটি টাকা।
সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক (এসআইবিএল) ৩০ হাজার ৯৭৭ কোটি টাকার আমানতের বিপরীতে ঋণ দিয়েছে ৩৫ হাজার ২২০ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ২৩ হাজার ৫৭৫ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের প্রায় ৬৭ শতাংশ। ব্যাংকটির পরিশোধিত মূলধন এক হাজার ১৪০ কোটি টাকা, শাখা ১৮১টি এবং লোকসান ৫৩ কোটি টাকা।
গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক ১২ হাজার ৩১৩ কোটি টাকার আমানতের বিপরীতে ১৪ হাজার ৪২৭ কোটি টাকা ঋণ বিতরণ করেছে। এর মধ্যে ১৩ হাজার ৫৬৯ কোটি টাকা খেলাপি, যা মোট ঋণের প্রায় ৯৪ শতাংশ। ব্যাংকটির পরিশোধিত মূলধন ৯৮৭ কোটি টাকা, শাখা ১০৪টি এবং লোকসান ২১৪ কোটি টাকা।
আরও পড়ুন দীর্ঘ অপেক্ষার পরও গভর্নরের দেখা পাননি ইসলামী ব্যাংকের চেয়ারম্যান রিজার্ভ ফের ৩০ বিলিয়ন ডলারের ঘরে ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের এমডিকে অপসারণইউনিয়ন ব্যাংক ১৭ হাজার ৯৪২ কোটি টাকার আমানতের বিপরীতে ২৮ হাজার ২৭৯ কোটি টাকা ঋণ দিয়েছে। অথচ এর মধ্যে ২৬ হাজার ৪৯১ কোটি টাকা খেলাপি হয়েছে, যা ঋণের প্রায় ৯৪ শতাংশ। ব্যাংকটির পরিশোধিত মূলধন এক হাজার ৩৬ কোটি টাকা, শাখা ১১৪টি এবং লোকসান ৮০ কোটি টাকা।
ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক সবচেয়ে বড় পরিমাণ খেলাপি ঋণে রয়েছে। ব্যাংকটির ৪৩ হাজার ১৪৩ কোটি টাকার আমানতের বিপরীতে ঋণ দিয়েছে ৬০ হাজার ৯১৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে ৫৮ হাজার ১৮২ কোটি টাকাই খেলাপি, যা মোট ঋণের প্রায় ৯৫ শতাংশ। পরিশোধিত মূলধন এক হাজার ২০৮ কোটি টাকা, শাখা ২০৬টি এবং লোকসান ৪০৫ কোটি টাকা।
খাত বিশ্লেষকরা মনে করেন, এ মার্জার সঠিকভাবে বাস্তবায়ন হলে ব্যাংকখাতে স্থিতিশীলতা ও আস্থা ফিরে আসবে। আমানত নিয়েও চিন্তা থাকবে না, ব্যাংক হবে শক্তিশালী।
বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর সম্প্রতি সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ‘একীভূতকরণের এ উদ্যোগ নির্বাচনের সঙ্গে সম্পৃক্ত নয় বরং এটি একটি চলমান প্রক্রিয়া, যা কয়েক মাসের মধ্যেই বাস্তবায়ন হবে। তিনি বলেন, এ মার্জারে কারও চাকরি হারানোর আশঙ্কা নেই। কেবল অতিরিক্ত শাখাগুলো শহর থেকে গ্রামে সরিয়ে নেওয়া হতে পারে। মোট ছয় ব্যাংকের সম্পদের মান পর্যালোচনার পর পাঁচটি ব্যাংক একীভূত করার প্রাথমিক আলোচনা হয়েছে। কোনো ব্যাংক একীভূত না হওয়ার জন্য যৌক্তিক কারণ দেখালে পুনর্বিবেচনার সুযোগ রয়েছে।’
এ বিষয়ে চেঞ্জ ইনিশিয়েটিভ রিসার্চ ফেলো ও অর্থনীতিবিদ এম হেলাল আহমেদ জনি বলেন, ‘শুধু ব্যাংক একীভূতকরণের উদ্যোগ নিলেই হবে না সেটি হতে হবে বাস্তবভিত্তিক। পাঁচ দুর্বল ব্যাংক মার্জ করে সরকার দায়িত্ব নিলে দেশে আরও একটি শক্তিশালী ইসলামী ব্যাংক গড়ে উঠবে। আর এটা করতে পারলে একদিকে ব্যাংক আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী হবে, অন্যদিকে আমানত নিয়ে শঙ্কা থাকবে না। অর্থাৎ আমানতকারীরা তাদের আমানত ফিরে পাবেন।’
ইএআর/এমএএইচ/এমএফএ/এএসএম