দেশজুড়ে

যশোরের শিশু শ্রমিকদের সুরক্ষা ছাতা ঠাকুর ফাউন্ডেশন

যশোরের শিশু শ্রমিকদের সুরক্ষা ছাতা ঠাকুর ফাউন্ডেশন

দশ বছরের জান্নাতুল ফেরদৌস নুর যশোরের রাণী চানাচুর ফ্যাক্টরিতে কাজ করতো। বাবা শামীম হাসান জনি মাদকাসক্ত হওয়ায় সংসারে কলহ লেগেই থাকতো। একদিন ঝগড়া বিবাদের এক পর্যায়ে নুর ও তার মা নাসরিন আক্তার রিয়াকে গাছে বেঁধে গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেন শামীম।

Advertisement

পথচারীরা দেখতে পেয়ে এগিয়ে এলে শামীম পালিয়ে যান। পথচারীরা নুর ও তার মাকে উদ্ধার করে। এরপর নুর ও তার মায়ের আশ্রয় হয় নানা বাড়ি যশোর শহরের বকচর বিহারী কলোনিতে। উপার্জনক্ষম নানা অসুস্থ হয়ে পড়ায় আরও সংকটে পড়ে যান নুরের মা। অভাব অনটনের কারণে স্কুল বন্ধ হয়ে যায় নুরের। একপর্যায়ে মা ও মেয়ে রাণী চানাচুর ফ্যাক্টরিতে কাজ শুরু করেন। তবে অনটনের কারণে শিশুশ্রমে জড়িয়ে পড়া নুর এখন স্কুলে যায়। সে সপ্তম শ্রেণির ছাত্রী।

যশোরের নিউমার্কেট ট্রাকস্ট্যান্ড বস্তির বাসিন্দা পিকুল হোসেনের ছেলে ফরহাদ হোসেন (১৪)। বাবা রিকশাচালক, মা গৃহকর্মীর কাজ করেন। বাবা হঠাৎ দুর্ঘটনায় অসুস্থ হয়ে পড়ায় রিকশা চালানো বন্ধ হয়ে যায়। বাবার সেবা করতে গিয়ে মায়েরও কাজ কমে যায়। বাধ্য হয়ে স্কুল ছেড়ে ওয়ার্কসপে কাজ নেয় ফরহাদ। ইঞ্জিন মেরামতের হেলপার হিসেবে কাজ শুরু করলেও তার মন পড়ে থাকতো স্কুলে। গাড়ির লোহার জিনিসপত্রে হাতুড়ি পেটানোর শব্দ হলে ফরহাদের মনে হতো বুঝি স্কুলের ঘণ্টা বাজছে! স্কুলে যেতে না পেরে মন খারাপ হতো তার। সেই ফরহাদ এখন উপশহরের শিশু কল্যাণ স্কুলের সপ্তম শ্রেণির ছাত্র।

একইভাবে যশোরের চাঁচড়া বর্মনপাড়া এলাকার সাধন বিশ্বাসের দুই সন্তান নিশীতা বিশ্বাস ও নিরব বিশ্বাস। জেলে সম্প্রদায়ের সাধন বিশ্বাস পুকুরে মাছ ধরতে গিয়ে স্যালোমেশিনের তারে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে মারা যান। মা নীলা বিশ্বাসের হাত ধরে নিশীতা ও নিরব বিশ্বাসকে ভাড়াবাড়ি ছাড়তে হয়। ঠাঁই মেলে বাবার পূর্বের কাজের স্থান ‘ফাহাদ হ্যাচারির’ ঘেরের পাড়ের ঝুপড়িতে। মা বাসাবাড়িতে গৃহকর্মীর কাজ নেন। দুই ভাইবোন নিশীতা ও নিরবের স্কুল বন্ধ হয়ে যায়। তারা নেমে পড়ে জলাশয়ের শামুক কুড়াতে। শামুক কুড়িয়ে দশ টাকা কেজি দরে সরবরাহ করে ঘের মালিককে। রোদ-বৃষ্টি, শীত-গ্রীষ্ম শামুক কুড়িয়ে শ্রমজীবী জীবন শুরু হয় তাদের। কিন্তু এখন নিশীতা ও নিরব স্কুলে যায়।

Advertisement

স্কুল ছেড়ে শ্রমজীবী হয়ে যাওয়া নুর, ফরহাদ, নিশীতা ও নিরবকে স্কুলে ফিরে যেতে সহযোগিতা করেছে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা আব্দুর রশিদ খান ঠাকুর ফাউন্ডেশন (এআরকেটিএফ)। পরিবারকে আয়বর্ধক কাজে সহযোগিতা করা, স্কুলে ভর্তি-বেতন, পোশাকসহ শিক্ষা উপকরণ দিয়ে পাশে দাঁড়িয়েছে সংস্থাটি। শুধু এই চার কিশোর কিশোরীই নয়; সংস্থাটি প্রায় চার হাজার শিশু শ্রমিককে শিশুশ্রম থেকে সরিয়ে শিক্ষার সঙ্গে যুক্ত করেছে। প্রায় দশ বছর ধরে যশোরে শিশুশ্রম নিয়ে কাজ করা সংস্থাটির উদ্যোগ-সহযোগিতার প্রশংসা করেছেন সংশ্লিষ্ট সরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারাও।

আব্দুর রশিদ খান ঠাকুর ফাউন্ডেশনের প্রকল্প সমন্বয়কারী আব্দুর রহমান জানান, যশোর পৌরসভা ও নওয়াপাড়া পৌরসভা এলাকা বাংলাদেশের শিশুশ্রম প্রবণ এলাকাগুলোর মধ্যে অন্যতম। ২০১৫ সাল থেকে তারা এই এলাকায় শিশুশ্রম নিয়ে কাজ শুরু করেন। এর অংশ হিসেবে গত নয় বছরে ৩ হাজার ৮৭৪ জন শিশু শ্রমিককে শিশুশ্রম থেকে সরিয়ে শিক্ষার সঙ্গে যুক্ত করেছেন। ৮২৫ জন শিশু শ্রমিককে দক্ষতা উন্নয়মূলক প্রশিক্ষণ প্রদান করেছেন। ৩ হাজার ৫১ জন শিশু শ্রমিককে ঝুঁকিপূর্ণ কাজ থেকে সরিয়ে ঝুঁকিমুক্ত কাজের সঙ্গে যুক্ত করা হয়েছে। পুনরায় স্কুলে ভর্তি হওয়া ৫৭৫ জন শিশু শ্রমিককে শিক্ষা-সামগ্রীসহ অন্যান্য প্রয়োজনীয় সহায়তা প্রদান করা হয়েছে। শিশু শ্রমিকের ১০৭টি পরিবারকে আয়মূলক কাজে আর্থিক সহযোগিতা প্রদান করা হয়েছে। ১২৩টি কর্মস্থল শিশুশ্রম মুক্ত করা হয়েছে। ৭ হাজার ২৪৫ জন পিতা-মাতা এবং নিয়োগকর্তাকে সচেতনতামূলক কার্যক্রমে যুক্ত করা এবং ২২টি স্কুলকে প্রকল্পের কার্যক্রমের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত করা হয়েছে।

শিশুশ্রম থেকে স্কুলে ফিরে যাওয়া জান্নাতুল ফেরদৌস নুর এখন দানবীর হাজী মুহাম্মদ মহসীন স্কুলের ৭ম শ্রেণিতে পড়ে। নুরের মা নাসরিন আক্তার রিয়া জানান, চানাচুর ফ্যাক্টরিতে নুরের সন্ধান পেয়ে ঠাকুর ফাউন্ডেশন (এআরকেটিএফ) প্রথমে আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে। কাগজের ঠোঙা বানানোর পূর্ব অভিজ্ঞতা থাকায় আমাকে পুঁজি দিয়ে ঠোঙা বানানোর ব্যবসা শুরু করায়। আর নুরকে দর্জি প্রশিক্ষণ প্রদান করে। আমার ব্যবসা একটু বড় হলে নুরকে আবার স্কুলে ভর্তি করে দিই। স্কুলের ভর্তি, বেতন, পোশাক দিয়েও সহযোগিতা করে তারা। এখন ঠোঙার ব্যবসার পাশাপাশি ছোট দোকান এবং কাপড়ের ব্যবসা দাঁড় করিয়েছি। মেয়ে স্কুলের পাশাপাশি কাজে সহযোগিতা করছে।

মাদকাসক্ত বাবার আগুন থেকে বেঁচে শ্রমজীবী জীবনের অতীতে তাকিয়ে এখন কেঁদে ওঠে জান্নাতুল ফেরদৌস নুর। নুর জানায়, সে আর ওই কষ্টের জীবনে ফিরে যেতে চায় না। সে লেখাপড়া করে মানুষ হতে চায়; উকিল (আইনজীবী) হয়ে মানুষের সেবা করতে চায়। নুরকে আঁকড়ে ধরে বাঁচা নাসরিন আক্তার রিয়াও চান সন্তানের সুন্দর ভবিষ্যৎ গড়তে। স্কুল ছেড়ে শামুক কুড়াতে নামা যশোরের চাঁচড়া বর্মনপাড়া এলাকার ভাই বোন নিশীতা বিশ্বাস ও নিরব বিশ্বাস এখন চাঁচড়া মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ৭ম ও ৬ষ্ঠ শ্রেণি শিক্ষার্থী।

Advertisement

নিশীতা জানায়, চাঁচড়া বর্মনপাড়ায় ঠাকুর ফাউন্ডেশনের (এআরকেটিএফ) চাইল্ড ফোরাম আছে। সেই ফোরামের কর্মী আমাকে শামুক কুড়াতে দেখে মায়ের সঙ্গে কথা বলেন। পরে আমাকে ওই ফোরামের সদস্য করে নেন। এরপর স্যারেরা (এআরকেটিএফ কর্মী) আমার মা ও হ্যাচারির মহাজনের সঙ্গে কথা বলে বাড়তি আয়ের ব্যবস্থা করে দেন। সেইসঙ্গে আমাদের দুই ভাইবোনকে ফের স্কুলে ভর্তি করে দেন। শুধু তাই নয়, স্কুলের ব্যাগ, পোশাক, জুতাও তারা কিনে দিয়েছেন। নিশীতা লেখাপড়া শিখে পুলিশ হতে চায়।

ইঞ্জিন মেরামতের হেলপার হিসেবে কাজ শুরু করা ফরহাদ এখন উপশহরের শিশু কল্যাণ স্কুলের ৭ম শ্রেণির ছাত্র। ফরহাদ জানায়, এআরকেটিএফ কর্মীরা একদিন তাদের গ্যারেজে এসে তার ও তার মালিকের সঙ্গে কথা বলে। তারা গ্যারেজে সেফটি সামগ্রী, ফার্স্টএইড বক্স দেয়। এরপর আমাকে ঝুঁকিপূর্ণ কাজ থেকে সরিয়ে এনে স্কুলে ভর্তি করে দেয়। পাশাপাশি আমার বাবা-মাকে বুঝিয়েছে এবং তাদের পাশে দাঁড়িয়েছে।

যশোরের শিশুশ্রম প্রসঙ্গে আব্দুর রশিদ খান ঠাকুর ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক প্রদীপ মার্সেল রোজারিও বলেন, যশোরে শিশুশ্রম নিরসনে ভূমিকা রাখার ব্যাপারে স্থানীয় ব্যক্তি/সমাজিক প্রতিষ্ঠানসমূহের সক্ষমতা বৃদ্ধি করতে, সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানের জবাবদিহিতা বৃদ্ধি করতে, শিশু শ্রমিকদের কাজের পরিবেশ উন্নত করতে সর্বোপরি ঝুঁকিপূর্ণ কাজ থেকে শিশু শ্রমিকদের প্রত্যাহার করে স্কুলে ভর্তি এবং ঝুঁকিমুক্ত কাজের সঙ্গে যুক্ত করার ক্ষেত্রে তাদের উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি রয়েছে। তবে এখনও যশোরের তিনটি অঞ্চলে প্রায় দশ হাজার শিশু শ্রমিক রয়েছে। এদের জন্য ২০২৭ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন পরিকল্পনা রয়েছে। এর মধ্যে ১৪ বছরের কম বয়সী আড়াই হাজার শিশু শ্রমিককে শ্রম থেকে সরিয়ে শিক্ষার সঙ্গে যুক্ত করা, ১৪ থেকে ১৮ বছর বয়সী সাড়ে চার হাজার শিশু শ্রমিককে ঝুঁকিপূর্ণ শ্রম থেকে সরিয়ে ঝুঁকিমুক্ত কাজের সঙ্গে যুক্ত করার টার্গেট রয়েছে তাদের। এছাড়াও শিশু শ্রমিকদের স্কুলে ভর্তি, বেতন ভাতাদি পরিশোধ, তাদের পরিবারের আর্থিক সক্ষমতা বৃদ্ধি করতে চলমান কর্মকাণ্ড অব্যাহত থাকবে।

যশোরের শংকরপুর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক নজরুল ইসলাম বুলবুল জানান, স্কুল থেকে ঝরে কাজে চলে যাওয়া ১৪ জন শিক্ষার্থীকে ঠাকুর ফাউন্ডেশন স্কুলে ভর্তি করে দিয়েছে। ফাউন্ডেশন তাদের দেখভাল করে; আবার স্কুলের পক্ষ থেকেও তাদের সহযোগিতা করা হয় যাতে তাদের শিক্ষাজীবন অব্যাহত থাকে।

যশোর জেলা শিশু বিষয়ক কর্মকর্তা সাধন কুমার দাস জানান, শ্রমঘন অঞ্চল হিসেবে যশোরে শিশু শ্রমের প্রবণতা রয়েছে। শিশু শ্রম কমিয়ে আনতে এবং কর্ম পরিবেশ উন্নত করতে দীর্ঘদিন ধরেই আব্দুর রশিদ খান ঠাকুর ফাউন্ডেশন কাজ করে যাচ্ছে। তারাও নিয়মিত এই কর্মকাণ্ড পর্যবেক্ষণ ও মনিটরিং করছেন।

কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর যশোরের উপ-মহাপরিদর্শক (ডিআইজি) আরিফুল ইসলাম জানান, শিশুশ্রম নির্মূল করতে সরকারি, বেসরকারি এবং প্রাতিষ্ঠানিক সম্মিলিত উদ্যোগ দরকার। কোনো প্রতিষ্ঠানের একার পক্ষে শিশুশ্রম দূর করা দুরূহ। তবে এআরকেটিএফ দীর্ঘদিন ধরে শিশুশ্রম কমিয়ে আনতে কাজ করছে। তাদের কর্মকাণ্ড দৃশ্যমান।

এফএ/এএসএম