অনেকটা প্রস্তুতি নিয়েই এবার রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে জাতীয় সমাবেশের আয়োজন করলো জামায়াতে ইসলামী। পিআর পদ্ধতিতে ভোট, নির্বাচনে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিশ্চিত করাসহ সাত দফা দাবিতে তাদের এই সমাবেশ। তবে আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর প্রথমবারের মতো সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে এতো বড় সমাবেশ কতটা সফল হয়েছে দলটির তা নিয়ে চলছে আলোচনা।
Advertisement
শনিবার (১৯ জুলাই) জামায়াতের সমাবেশে যোগ দিতে ভোরবেলা থেকেই জড়ো হন দলটির নেতাকর্মীরা। রাজধানীর বিভিন্ন জায়গা থেকে মিছিল নিয়ে দলে দলে সমাবেশে যোগ দেন তারা। এমনকি ভাড়া করা ট্রেন, বাস যে যেভাবে পেরেছেন দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে এসে সমাবেশ অংশ নেন। সমাবেশে বিএনপিকে আমন্ত্রণ জানানো হয়নি। তবে সমাবেশে এসেছিলেন জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) নেতা সারজিস আলম, আখতার হোসেন ও আবদুল হান্নান মাসউদ।
সমাবেশ ঘিরে রাজধানীজুড়ে দলটির নেতা-কর্মীদের সরব উপস্থিতি চোখে পড়ে। তীব্র যানজট দেখা দেয় ঢাকার বিভিন্ন সড়কে। শাহবাগ এলাকা দিয়ে বাস চলাচল বন্ধ ছিল। শুধু ব্যক্তিগত গাড়ি, মোটরসাইকেল, রিকশা ও অ্যাম্বুলেন্স চলাচল করে।
সকাল থেকেই সমাবেশে জড়ো হওয়া লোকজনকে উজ্জীবিত রাখতে পরিবেশন করা হয় ইসলামী সঙ্গীত। পরিবেশিত হয় জুলাই আন্দোলনকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন গান। সমাবেশের বিস্তৃতি ছিল সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের আশপাশের সড়কসহ রমনা পার্ক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা পর্যন্ত। জামায়াতের নেতাকর্মীদের পদচারণায় মুখর ছিল আশপাশের পরিবেশ। যদিও ভ্যাপসা গরমে অনেকে অস্বস্তিতেও ভোগেন।
Advertisement
দুপুর ২টায় শুরু হয় সমাবেশের মূল পর্ব। এর আগেই মঞ্চে এসে উপস্থিত হন জামায়াতের কেন্দ্রীয় নেতারা। বিকেল সোয়া ৫টার দিকে মঞ্চে উঠেন জামায়াতের আমির ডা. শফিকুর রহমান। বক্তব্যের এক পর্যায়ে হঠাৎ তিনি অসুস্থ হয়ে পড়ে যান। নেতাকর্মীদের সহযোগিতায় উঠে দাঁড়ালেও আবারও অসুস্থ হয়ে পড়ে যান তিনি। পরে বসেই বক্তব্য শেষ করেন জামায়াত আমির।
আরও পড়ুন: মঞ্চে অসুস্থ হয়ে পড়ে গেলেন জামায়াত আমির হাসপাতাল ছাড়লেন জামায়াত আমির, সুস্থ আছেন জামায়াতের এমপি-মন্ত্রী প্লট নেবে না, ট্যাক্সবিহীন গাড়িতেও চড়বে নাসংক্ষিপ্ত বক্তব্যে তিনি বলেন, ‘আল্লাহ যতদিন হায়াত দিয়েছেন জনগণের জন্য লড়াই অব্যাহত থাকবে। আল্লাহ আমাদের যদি সুযোগ দেন তাহলে মালিক হবো না, সেবক হবো। আমরা ঘোষণা দিচ্ছি, জামায়াত থেকে আগামীতে যারা সংসদ সদস্য নির্বাচিত হবেন, তারা কোনো সরকারি উপহার নেবেন না। এমপি-মন্ত্রীরা সরকারি প্লট বরাদ্দ নেবেন না, ট্যাক্সবিহীন গাড়িতেও চড়বেন না। নিজ হাতে সরকারি বরাদ্দের টাকা চালাচালিও করবেন না’।
ডা. শফিকুর রহমান বলেন, ‘তারা (জামায়াতের এমপি-মন্ত্রী) নির্দিষ্ট কোনো কাজের জন্য বরাদ্দ পেলে বাংলাদেশের ১৬ কোটি মানুষের কাছে তার বিবরণ তুল ধরতে বাধ্য হবেন। চাঁদা আমরা নেবো না, দুর্নীতি আমরা করবো না। চাঁদা নিতে দেবো না, দুর্নীতি আমরা সহ্য করবো না’।
এর আগে মঞ্চে বক্তব্য রাখেন এনসিপিসহ আরও বেশ কয়েকটি রাজনৈতিক সংগঠনের নেতারা।
Advertisement
জাতীয় সমাবেশে জামায়াতে ইসলামীর সাত দফা দাবির প্রতি সমর্থন জানিয়েছে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ। সমাবেশে উপস্থিত হয়ে দলটির মহাসচিব অধ্যক্ষ মাওলানা ইউনুস আহমদ বলেন, গত বছর এ মাসে এই দিনে বাতাসে বারুদের গন্ধ ছিল। চতুর্দিকে গুলির আওয়াজ ছিল, হাসপাতালে দৌড়াদৌড়ি, শহীদদের নিয়ে কান্নাকাটি। যদি এই ৫ আগস্ট সংঘটিত না হতো, তাহলে এই জাতীয় সমাবেশ আজ কল্পনাও করা যেত না। মাওলানা ইউনুস আহমদ আরও বলেন, জামায়াতে ইসলামী যে সাত দফা দাবি জানিয়েছে, এটা দেশের জন্য মঙ্গল, জাতির জন্য মঙ্গল। আমরা পুরোপুরি এই সাত দফা দাবি সমর্থন করি।
এনসিপি নেতা সারজিস আলম বলেন, আমাদের নতুন সংবিধান লাগবে, গণপরিষদ নির্বাচন লাগবে, নারীদের অধিকার ও সংখ্যালঘু ভাই-বোনদের অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। সারজিস বলেন, অভ্যুত্থানের এক বছর পেরিয়ে আমরা আরেক বছরে এসে উপস্থিত হয়েছি। কিন্তু বাংলাদেশ থেকে মুজিববাদীদের ষড়যন্ত্র এখনো শেষ হয়নি। গোপালগঞ্জে মুজিববাদীদের আস্তানা গড়ে উঠেছে। মুজিববাদের সদস্যরা এখনো বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গায় সক্রিয়। এই মুজিববাদ একটি আদর্শ। শুধু আইনিভাবেই মুজিববাদের মোকাবিলা করা যাবে না। আমাদের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিকভাবেই মুজিববাদের কোমর ভেঙে দিতে হবে।
সমাবেশে আরেক এনসিপি নেতা আখতার হোসেন বলেন, ‘ক্ষমতার ভারসাম্যের প্রশ্নে উচ্চকক্ষে পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন করতে হবে। পিআর পদ্ধতি হলে উচ্চকক্ষ চাই না, এমন বক্তব্য যারা দেয়, তারা জাতির সঙ্গে প্রতারণা করছে।’ তিনি বলেন, ক্ষমতার ভারসাম্য নিশ্চিত করে নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণের জন্য ২৪ এর গণঅভ্যুত্থানে আমরা অংশ নিয়েছিলাম।
অনতিবিলম্বে স্থানীয় সরকার নির্বাচনের দাবি জানিয়ে গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নুর বলেন, হাদিসে আছে বিপদ কেটে গেলে মানুষ উৎফুল্ল হয়, আনন্দিত হয়। আমরা দেখতে পাচ্ছি অভ্যুত্থানের অংশীদাররা উৎফুল্ল হয়ে জালিম হয়ে উঠছেন। তাই বলতে চাই, আল্লাহ পাক কিন্তু ছাড় দেবেন না।
আরও পড়ুন: নির্বাচনে যারা পিআর চায় না তারা জাতির সঙ্গে প্রতারণা করে: আখতার আমাদের নতুন সংবিধান লাগবে, জামায়াতের সমাবেশে সারজিসএদিকে, জামায়াতে ইসলামীর জাতীয় সমাবেশে বিএনপিকে আমন্ত্রণ জানানো হয়নি বলে জানান বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ। যদিও জামায়াতের নায়েবে আমির ডা. সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের জানান, পিআরের পক্ষে থাকা দলগুলোকে কেবল এই জাতীয় সমাবেশে আমন্ত্রণ করা হয়েছে।
আরও পড়ুন: জামায়াতের সমাবেশে বিএনপিকে আমন্ত্রণ জানানো হয়নিএই পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন নিয়ে পরস্পরবিরোধী অবস্থানে অনড় বিএনপি ও জামায়াত।
পিআর পদ্ধতিতে ভোট ছাড়াও জামায়াতের সমাবেশে তোলা অন্যান্য দাবিসমূহ হলো ২০২৪ সালের ৫ আগস্টসহ অন্যান্য সময় সংঘটিত সব হত্যার বিচার, রাষ্ট্রের সব স্তরে প্রয়োজনীয় মৌলিক সংস্কার, জুলাই সনদ ও ঘোষণাপত্রের বাস্তবায়ন, জুলাই অভ্যুত্থানে হতাহতদের পরিবারের পুনর্বাসন, প্রবাসীদের ভোটাধিকার ও ভোটের লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিশ্চিত করা।
এসএনআর/এএসএম