রফিক হায়দার, চট্টগ্রাম থেকে
Advertisement
উচ্চ মাধ্যমিকের গণ্ডি পেরিয়ে উচ্চ শিক্ষায় পাড়ি জমানোর ইচ্ছে কমবেশি সবারই থাকে। এর মধ্যে প্রথম পছন্দ থাকে দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। এরপর প্রথম সারির সরকারি কলেজগুলো। দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা সরকারি কলেজে পড়াশোনা করা বেশিরভাগ শিক্ষার্থী মধ্যবিত্ত, নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের হয়ে থাকে। প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করা তাদের সামর্থ্য থাকে না। সরকারি কলেজে পড়ে কম খরচে হোস্টেলে শিক্ষাজীবন পার করেন বহু শিক্ষার্থী।
চট্টগ্রাম নগরের গুরুত্বপূর্ণ চারটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান—চট্টগ্রাম সরকারি কলেজ, চট্টগ্রাম পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট, সরকারি কমার্স কলেজ ও সরকারি হাজী মুহাম্মদ মহসিন কলেজ। নগরের প্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী এই চারটি প্রতিষ্ঠান শিক্ষা খাতে দারুণ অবদান রেখে চলেছে। প্রতি বছর হাজার হাজার শিক্ষার্থী এসব প্রতিষ্ঠান থেকে পড়াশোনা শেষ করে বের হন। চট্টগ্রামের প্রত্যন্ত উপজেলা থেকে এসে অনেকে প্রতিষ্ঠানগুলোতে পড়াশোনা করেন। শুধু চট্টগ্রাম নয়, এর বাইরে থেকেও শিক্ষার্থীরা এসব প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হন। কিন্তু বছরের পর বছর এসব প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা আবাসন সুবিধা বঞ্চিত। অনেক প্রতিষ্ঠানে হল বা হোস্টেল থাকলেও সেটা দীর্ঘদিন বন্ধ হয়ে পড়ে আছে। আবার অনেক প্রতিষ্ঠানের আবাসন সুবিধা বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে না। এতে দূরদূরান্তের শিক্ষার্থীদের চরম ভোগান্তি পোহাতে হয়। তাদের উচ্চ মূল্যে মেসে বা বাসায় থাকতে হয়। এতে বড় অঙ্কের একটা আর্থিক ব্যয় হচ্ছে শিক্ষার্থীদের। নানা সময় বিভিন্ন ছাত্র সংগঠনের নেতিবাচক বা বিতর্কিত কার্যক্রম এসব প্রতিষ্ঠানে হোস্টেলসমূহ না খোলার পেছনে অন্তরায় বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।
চট্টগ্রাম সরকারি কলেজচট্টগ্রাম কলেজ বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী একটি কলেজ। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ঘেরা চট্টগ্রামের অন্যতম স্বনামধন্য বিদ্যাপীঠ চট্টগ্রাম কলেজ। এই কলেজের শিক্ষার্থীদের রয়েছে নানা সুযোগ-সুবিধা। তবে সকল সুযোগ-সুবিধার মাঝেও আবাসন সংকট ব্যাপকভাবে রয়েছে। ১৯২৬ সালে চট্টগ্রাম কলেজের প্রথম ছাত্রাবাস প্রতিষ্ঠিত হয়। এখন পর্যন্ত পাঁচটি ছাত্রাবাস রয়েছে। সোহরাওয়ার্দী ছাত্রাবাস, শেরেবাংলা ছাত্রাবাস, ডা. আব্দুস সবুর ছাত্রাবাস, হজরত খাদিজাতুল কুবরা (রা.) ছাত্রাবাস, শেখ হাসিনা ছাত্রাবাস। ছেলেদের জন্য তিনটি এবং মেয়েদের জন্য দুটি ছাত্রাবাস রয়েছে। কলেজে প্রায় ২১ হাজার শিক্ষার্থীর জন্য পাঁচটি ছাত্রাবাস যথেষ্ট নয়। বাংলাদেশের প্রায় সকল জেলার শিক্ষার্থী রয়েছে এখানে। আবাসনের অসুবিধায় অনেকেই নিয়মিত ক্লাস করতে পারে না। যার কারণে শিক্ষার্থীরা পিছিয়ে পড়ছে। বেসরকারি হোস্টেল এবং মেসের ব্যয়ভার বেশি ও অনিরাপদ হওয়ার কারণে অনেকেই মাঝপথে পড়াশোনার ইতি টানছে।
Advertisement
তাই শিক্ষার্থীদের চাওয়া, চট্টগ্রাম কলেজের ছাত্রাবাস সংকট দূর করা হোক। ২০১৫ সালের পর থেকে নানা কারণে হোস্টেলগুলো বন্ধ থাকলেও জুলাই আন্দোলনের পর সেগুলো খুলে দেওয়া হয়েছে। হোস্টেল পুনরায় চালু করায় খুশি শিক্ষার্থীরা। তবে এ আবাসন সুবিধা মোট শিক্ষার্থীর তুলনায় খুবই নগণ্য। শিক্ষার্থীদের দাবি আরও কয়েকটি হল নির্মাণ করা হোক। অবশ্য আশার বাণীও শোনা যাচ্ছে। শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তরের একটি সূত্র জানিয়েছে, চট্টগ্রাম কলেজে দুটি ১০তলা বিশিষ্ট আবাসিক ভবন নির্মাণ প্রকল্প হাতে নেওয়া হচ্ছে।
চট্টগ্রাম সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক মোহাম্মদ মোজাহেদুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, শিক্ষার্থীদের তুলনায় আবাসন সুবিধা খুবই নগণ্য। আমরা মন্ত্রণালয়কে জানিয়েছি। আমাদের দুটি আবাসিক ভবন নির্মাণ করার ব্যাপারে কার্যক্রম চলছে।
চট্টগ্রাম পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটশিক্ষার্থীদের মাঝে গ্রুপিংকে কেন্দ্র করে ১৬ বছর ধরে বন্ধ নগরের নাসিরাবাদে অবস্থিত চট্টগ্রাম পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের দুটি ছাত্রাবাস। ২০০৯ সালে এই ছাত্রাবাস দুটি বন্ধ করে দেওয়া হয়। এরপর শিক্ষার্থীরা বেশ কয়েকবার দাবি জানানোর পরও এগুলো আর খুলে দেওয়া হয়নি। ২০১৮ সালে প্রশাসন উদ্যোগ নেয় ছাত্রাবাস দুটি খুলে দেওয়ার। সেই অনুসারে ছাত্রাবাসের সংস্কার কাজ শুরু করেন। শিক্ষার্থীদের হলে উঠার ব্যাপারে ফরম সংগ্রহ করার জন্য নোটিশও দেওয়া হয়। কিন্তু অজানা কারণে সেটা বাস্তবায়ন হয়নি। প্রায় সাড়ে চার হাজার শিক্ষার্থীর বিপরীতে নবাব সিারজউদ্দৌলা ও সূর্যসেন ছাত্রাবাস দুটিতে প্রায় ৩০০ শিক্ষার্থীর আবাসন ব্যবস্থা রয়েছে।
সর্বশেষ গত ৫ আগস্ট স্বৈরাচার শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর শিক্ষার্থীরা দাবি জানায় ছাত্রাবাস দুটি খুলে দেওয়ার জন্য। শিক্ষার্থীদের সুবিধার কথা চিন্তা করে প্রশাসনও খোলার ব্যাপারে একমত হন। পরে আসনপ্রাপ্তদের তালিকা প্রকাশ করলে শিক্ষার্থীরা হলে উঠতে গেলে ছাত্রদলের বাধার মুখে পড়ে। এতে হলে আসনপ্রাপ্ত শিক্ষার্থী ও ছাত্রদলসহ স্থানীয় বিএনপির সংঘর্ষ বাধে। এ নিয়ে ছাত্রদল শিবিরকে দোষারোপ করেন।
Advertisement
এ ব্যাপারে চট্টগ্রাম পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের অধ্যক্ষ প্রকৌশলী মো. ইয়াছিন বলেন, শিক্ষার্থীদের ছাত্রাবাস খুলে দেওয়ার ব্যাপারে আমরা একমত। কিছু ব্যাপারে দ্বিমত আছে সেগুলো ঠিক হয়ে যাবে। আমাদের ছাত্রাবাসে যে আসবাবপত্র প্রয়োজন সেগুলো শিক্ষার্থীরা নিজেরা ব্যবস্থা করবে মর্মে ছাত্রাবাস খুলে দেওয়ার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত হয়েছে। কিন্তু ছাত্রদের মাঝে গ্রুপিংয়ের কারণে সমস্যা হয়।
সরকারি কমার্স কলেজ চট্টগ্রামপ্রায় ৩৬ বছর ধরে বন্ধ চট্টগ্রাম সরকারি কমার্স কলেজের শহীদ আব্দুল হামিদ ছাত্রাবাস। জরাজীর্ণ ভবনটির ভেঙে পড়েছে দেয়াল। কক্ষের ভেতর ময়লা-আবর্জনায় পরিপূর্ণ। পলেস্তারাঁ খসে পড়ছে। ৩৬ বছর আগে বন্ধ হওয়া ছাত্রাবাসটি এখন পরিত্যক্ত। কলেজটিতে প্রায় ৮ হাজার শিক্ষার্থী পড়াশোনা করেন। ১৯৬২-৬৩ সালের দিকে নগরের আগ্রাবাদ এলাকায় অবস্থিত সরকারি কমার্স কলেজের দক্ষিণ পাশে চারতলার ছাত্রাবাসটি তৈরি করা হয়। ১০০ শিক্ষার্থী এই ছাত্রাবাসে থাকতে পারতেন। ১৯৮৯ সালে দুই পক্ষের মধ্যে দফায় দফায় সংঘর্ষে মারা যান তিন ছাত্র। এরপর ১৯৮৯ সালের মে মাসে ছাত্রাবাসটি বন্ধ করে দেওয়া হয়। পরে বন্ধ হয়ে যায় ১০০ আসনবিশিষ্ট ছাত্রীদের হোস্টেলটিও।
কলেজটির মাস্টার্সের শিক্ষার্থী আল আল আমিন বলেন, আমার বাড়ি ফেনী। থাকি দেওয়ানহাট একটি মেসে। মাসে ১০ হাজার টাকার মতো খরচ হয়ে যায়। ছাত্রাবাস থাকলে খরচ অনেকটা কমে যেত। থাকার খরচ লাগত না। আবার খাওয়ার খরচও অনেক কমে যেত। চার–পাঁচ হাজার টাকার মধ্যে মাস চলা যেত। কিন্তু এখন সে সুযোগ নেই।
সরকারি কমার্স কলেজের অধ্যক্ষ সুসেন কুমার বড়ুয়া জানান, ছাত্রাবাস ও ছাত্রীনিবাস এখন ব্যবহারের অযোগ্য হয়ে গেছে। মেরামত বা সংস্কার করেও কোনো লাভ হবে না। এ কারণে ছাত্রাবাসটি ভেঙে সেই জায়গায় ২০০ আসনের নতুন একটি ভবন তৈরির জন্য শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে জানানো হয়েছে। একইভাবে আরেকটি ছাত্রীনিবাস তৈরির জন্য বলা হয়েছে।
সরকারি হাজী মুহাম্মদ মহসিন কলেজমহসিন কলেজের মহসিন মুসলিম ছাত্রাবাস ও নতুন ছাত্রাবাস নামের দুটি ছাত্রাবাসে ৮০টি করে মোট ১৬০টি আসন রয়েছে। এর মধ্যে মহসিন মুসলিম ছাত্রাবাসটি নির্মিত হয় ১৯৭০ সালে। ব্যবহার অনুপযোগী হওয়ায় এটি বর্তমানে বন্ধ রয়েছে। অন্য ছাত্রাবাসটি নির্মিত হয় ২০০৩ সালে। দীর্ঘদিন বন্ধ থাকার ৫ আগস্ট পর এটি খুলে দেওয়া হয়েছে শিক্ষার্থীদের জন্য। ছাত্রাবাস নতুন নির্মাণের ব্যাপারে সরকারের আবেদন করবেন বলে জানান সরকারি হাজী মুহাম্মদ মহসিন কলেজের অধ্যক্ষ মোহাম্মদ কামরুল ইসলাম।
আরও পড়ুন দেশে সরকারি উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থী সাড়ে ৩১ লাখ বেসরকারি ও সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আলাদা নয়এ ব্যাপারে ছাত্রশিবিরের চট্টগ্রাম মহানগর দক্ষিণের প্রচার সম্পাদক জাহিদুল আলম জয় বলেন, শিক্ষার্থীদের আবাসন একটি বড় সমস্যা। আমরা ৫ আগস্টের পর প্রশাসনের সঙ্গে যেসব ছাত্রাবাস বন্ধ সেগুলো খুলে দেওয়ার ব্যাপারে আলাপ করেছি। মহসিন কলেজের ছাত্রাবাস খুলে দিতে আমরা কথা বলেছি। এরপর কমার্স কলেজ, সিটি কলেজ এসব নিয়েও আলাপ করবো। ছাত্রাবাস খোলা থাকলে শিবির করে নেবে— এমন মনোভাবের বিষয়ে তিনি বলেন, যারা শিবিরের সঙ্গে আদর্শিকভাবে মোকাবিলা করতে ব্যর্থ তারাই বলে থাকেন। আমরা হল বা ছাত্রাবাস দখলের রাজনীতি করি না। কেউ বলতে পারবে না আমরা জোর করে হলে থাকা কাউকে শিবির করতে বাধ্য করেছি।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চট্টগ্রাম মহানগরের সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক ইবনে হোসাইন জিয়াদ বলেন, লেজুড়বৃত্তিক ছাত্র রাজনীতি বন্ধ না হলে দখলমুক্ত হবে না। শিক্ষার্থীরা কলেজে বিশ্ববিদ্যালয়ে আসে পড়াশোনা করতে কিন্তু সেখানে যখন বাজে রাজনীতির রোষানলে পড়ে যায় তখন সেটা খুবই দুঃখজনক। শিক্ষার্থীদের আবাসন সুবিধা বৃদ্ধি করা মৌলিক অধিকার। ক্যাম্পাসে যারা চাঁদাবাজ টেন্ডারবাজি করতে চায় তারাই আধিপত্য ধরে রাখতে চায়।
চট্টগ্রাম মহানগর ছাত্রদলের আহ্বায়ক সাইফুল আলম বলেন, আমরা সাধারণ শিক্ষার্থীদের কল্যাণে কাজ করি। আমাদের প্রায় কলেজে বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদলের কমিটি আছে। তারা শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে কাজ করে থাকে। এরপর আবার আমাদেরও জানান, আমরা সেগুলো নিয়ে কাজ করি। সিটি কলেজের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আমি কথা বলেছি।
এমআরএম/এএসএম