মতামত

১০ বছরেও সম্ভব হয়নি, ১০ মাসেই সম্ভব

১০ বছরেও সম্ভব হয়নি, ১০ মাসেই সম্ভব

আবারও ‘সরকারি-বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নিজস্ব ওয়েবসাইট তৈরি ও হালনাগাদের নির্দেশ দিয়েছে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তর (মাউশি)। গত ১৪ জুলাই ২০২৫ তারিখে জারিকৃত পত্রে বলা হয়, প্রতিষ্ঠানগুলোর ওয়েবসাইটে প্রতিষ্ঠান পরিচিতি, প্রতিষ্ঠানের পাঠদানের অনুমতি ও স্বীকৃতি, শ্রেণি ও লিঙ্গভিত্তিক শিক্ষার্থীর তথ্য, শ্রেণিভিত্তিক অনুমোদিত শাখার তথ্য, পাঠদান সংক্রান্ত তথ্য (শিক্ষক, শিক্ষিকার নামসহ পূর্ণাঙ্গ রুটিন, পাঠ্যসূচি, বিবিধ নোটিশ ইত্যাদি), এমপিও, প্রতিষ্ঠানের ফোন/মোবাইল নম্বরসহ যোগাযোগের ঠিকানা, তথ্যসেবা কেন্দ্রের ঠিকানা ও মোবাইল নম্বর, অভিযোগ নিষ্পত্তি কর্মকর্তার ঠিকানা ও মোবাইল নম্বর, প্রতিষ্ঠান প্রধানসহ সব শিক্ষক-কর্মচারীর তথ্য, ব্যবস্থাপনা কমিটির তথ্য হালনাগাদ রাখতে হবে।’

Advertisement

বিষয়টি অবশ্যই অনেক গুরুত্বপূর্ণ! কেননা, কোন প্রতিষ্ঠানের ওয়েবসাইট ওই প্রতিষ্ঠানকে ভার্চুয়ালি উপস্থাপন করে। আর সে উপস্থাপনটি হয় অত্যন্ত ব্যাপক পরিসরে, পৃথিবীজুড়ে। তাই মাউশি নির্ধারিত সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ডায়নামিক ওয়েবসাইট থাকা এবং সেখানে মাউশি নির্দেশিত বিষয়গুলোসহ প্রতিষ্ঠানের অন্য তথ্যাদি ও কৃতিত্ব উপস্থাপিত থাকা অত্যাবশ্যক। কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় হচ্ছে, অনুরূপ আদেশ বারবার দেওয়ার পরেও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো এসব আদেশ পরিপূর্ণভাবে বাস্তবায়ন করছে না অথবা বাস্তবায়ন করতে পারছে না!

একটু পেছনে তাকালে দেখা যায় যে, শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে অনুরূপ আদেশ সম্বলিত প্রথম পরিপত্রটি জারি করা হয়েছিল ০২ মে ২০১৫ তারিখে। যেটির বিষয় ছিল 'সরকারি ও বেসরকারি মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ডায়নামিক ওয়েবসাইট তৈরি ও হালনাগাদকরণ।' এরপরে শিক্ষা অধিদপ্তর থেকে গত ২৪ এপ্রিল ২০১৯ তারিখে এবং গত ১৯ আগস্ট ২০২৩ তারিখে এ সংক্রান্ত আরও দুটি আদেশ জারি করা হয়েছিল। অর্থাৎ সেই ২০১৫ সাল থেকে গত ১০ বছর ধরে বারবার আদেশ/পুনরাদেশ দেওয়া হলেও বাংলাদেশের সব স্কুল, কলেজ, মাদরাসা ও কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এখনো ডায়নামিক ওয়েবসাইট তৈরি করানো এবং সব তথ্য সংযুক্ত করে হালনাগাদ রাখানো সম্ভব হয়নি!

মনে রাখতে হবে, দেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অবস্থা ও অবস্থান যেহেতু একই রকম নয় সেহেতু মাঠ পর্যায়ের বাস্তবতা বিবেচনা করে কেন্দ্রীয়ভাবে সমন্বিত সবার জন্য অনুকূল কোনো উদ্যোগ ব্যতীত সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ডায়নামিক ওয়েবসাইট ও সফটওয়্যারের ব্যবহার সমভাবে নিশ্চিত করে অত্যাধুনিক শিক্ষাব্যবস্থা সচল রাখা প্রায় অসম্ভব।

Advertisement

মাঠ পর্যায়ের বাস্তবতা হচ্ছে, যখনই ডায়নামিক ওয়েবসাইট তৈরির আদেশ দেওয়া হচ্ছে তখনই অনেক ভূঁইফোড় ও নামসর্বস্ব সফটওয়্যার/ আইটি প্রতিষ্ঠান স্বল্পমূল্যে ওয়েবসাইট তৈরি ও পরিচালনা করবে বলে চটকদার বিজ্ঞাপন দিচ্ছে, মোবাইল ফোনে এসএমএস দিচ্ছে, লোকজন ধরাধরি করছে, প্রতিষ্ঠানে এসে ধরনা দিচ্ছে। কোনো কৌশলে চুক্তিবদ্ধ হয়ে যেনতেন কাজ করে টাকা হাতিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছে। এসব সফটওয়্যার কোম্পানির বৈধতা কোন অথরিটির কেমন সনদ দেখে নিশ্চিত হতে হবে তা জানা নেই অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রধানের। অবশ্য শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে বৈধ সফটওয়্যার/ আইটি প্রতিষ্ঠানগুলোর কোনো তালিকা দেওয়া হলে তারাও আবার সিন্ডিকেট করে অতিরিক্ত চার্জ ধার্য করার কৌশল নিতে পারে।

অপরদিকে নামিদামি সফটওয়্যার/ আইটি প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের এককালীন ও মাসিক চার্জ অস্বাভাবিক বৃদ্ধি করছে। তাদের সফটওয়ারে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সব ডাটা আপলোড করা হলে প্রতি বৎসর চার্জ বাড়ানোর কৌশল করছে। ফলে অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানই নিজস্ব ডাইনামিক ওয়েবসাইট তৈরি করতে ও পরিচালনা করতে ব্যর্থ হচ্ছে। বিশেষ করে অসচ্ছল ও কম সচ্ছল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো প্রকৃত ডায়নামিক ওয়েবসাইট প্রস্তুত করার এককালীন ব্যয় এবং রক্ষণাবেক্ষণের প্রয়োজনীয় ব্যয় নির্বাহ করতে ব্যর্থ হচ্ছে। সারাদেশে এমন অনেক স্কুল, কলেজ ও মাদরাসা আছে যেখানে শিক্ষার্থীরা মাসিক বেতনই ঠিক মতো দেয় না এবং শিক্ষকরা তাদের প্রতিষ্ঠান অংশ থেকে তেমন কিছুই পান না!

আরেকটি বাস্তবতা হচ্ছে, ওয়েবসাইট নিয়মিত হালনাগাদ করা ও সমস্যা হলে সমাধান করার মতো দক্ষ জনবল অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানেই নেই। আউটসোর্সিং করতে গেলে যে বাড়তি টাকার প্রয়োজন সেটিও অনেক প্রতিষ্ঠানে নেই। দুঃখজনক হলেও সত্য যে অধিকাংশ আইসিটি টিচার ও কম্পিউটার অপারেটর প্রাক্টিক্যাল/ ডিজিটাল কাজে অত্যন্ত দুর্বল। সাধারণ শিক্ষকদের কথা আর কী বলব! প্রতিষ্ঠানে নিয়োজিত কম্পিউটার অপারেটরকে ওয়েবসাইট আপডেট রাখার বিষয়ে গাইড করার মতো যোগ্যতা, আগ্রহ ও দায়িত্ব বেশিরভাগ আইসিটি টিচারের নেই! অথচ প্রতিষ্ঠানের বৃহত্তর স্বার্থে সব শিক্ষককেই শিক্ষা কার্যক্রমের পাশাপাশি সহশিক্ষা কার্যক্রম ও অন্যান্য কার্যক্রম সম্পাদন করতে হয়।

আলোচিত বিভিন্ন বাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিতে শুধু শহরের কতিপয় অতি সচ্ছল ও শিক্ষিত অভিভাবকের সন্তান যে সব প্রতিষ্ঠানে লেখাপড়া করে সে সব প্রতিষ্ঠানের দিকে তাকিয়ে সবকিছু চিন্তা করলে হবে না, প্রত্যন্ত গ্রাম এলাকায় অবস্থিত অসচ্ছল ও অশিক্ষিত বা স্বল্পশিক্ষিত পরিবারের সন্তানরা যে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে লেখাপড়া করে সেগুলোর দিকেও তাকাতে হবে। শিক্ষাক্ষেত্রে সমানতালে এগিয়ে নিতে হবে সবাইকে।

Advertisement

এমতাবস্থায় শিক্ষা মন্ত্রণালয় বা এর অধীন কোনো প্রতিষ্ঠান যদি একটি শক্তিশালী ডায়নামিক ওয়েবসাইট ও সফটওয়্যার প্রস্তুত করে প্রয়োজনীয় ম্যানু, সাব-ম্যানু যুক্ত করে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে সেটির ব্যবহার বাধ্যতামূলক করে দেয় তাহলে এই সমস্যার সহজ সমাধান হবে বলে আমি মনে করি। সে ওয়েবসাইট প্রস্তুত, কাস্টমাইজ ও রক্ষণাবেক্ষণ করার জন্য প্রয়োজনে সংশ্লিষ্ট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসমূহ থেকে নামমাত্র বার্ষিক ফি নেওয়া যেতে পারে। এ ফি ছোট-বড় প্রতিষ্ঠানের ব্যবহৃত ডাটা/স্পেস অনুসারে কম-বেশি হতে পারে। তাতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো বর্তমান বিড়ম্বনা, অতিরিক্ত ব্যয় ও আর্থিক ক্ষতির ঝুঁকি থেকে মুক্তি পাবে।

তদুপরি দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রয়োজনীয় তথ্য শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ও এর অধীন প্রতিষ্ঠানগুলোর চাহিদা মতো ফরমেট অনুসারে একটি প্ল্যাটফর্মে রেডি পাওয়া যাবে। কোন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সেই ওয়েবসাইট ও সফটওয়্যার ব্যবহার না করার এবং নিয়মিত আপডেট না করার কোন অজুহাত দেখাতে পারবে না। তবে কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান যদি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্ধারিত ওয়েবসাইট ও সফটওয়্যারের ব্যবহার শতভাগ নিশ্চিত করে এর পাশাপাশি নিজস্ব অর্থায়নে অন্য কোনো ওয়েবসাইট/ সফটওয়্যার প্রস্তুত ও পরিচালনা করতে চায় তাহলে সে সুযোগ দিতে হবে। অপরদিকে বিশ্ববিদ্যালয়ে তাদের স্বতন্ত্র ওয়েবসাইট ব্যবহারের সুযোগ থাকতে হবে।

শিক্ষা মন্ত্রণালয় যেহেতু বর্তমানে প্রায় সব শ্রেণির ভর্তি কার্যক্রম অনলাইনে চালাতে সক্ষম সেহেতু সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ব্যবহার উপযোগী একটি ডায়নামিক ওয়েবসাইট ও প্রয়োজনীয় সফটওয়্যার প্রস্তুত এবং রক্ষণাবেক্ষণ করতে অবশ্যই সক্ষম হবে বলে আমি মনে করি। এক্ষেত্রে প্রয়োজনে তারা বুয়েট বা অন্য কোনো বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগিতা নিতে পারে। ঢাকা শিক্ষাবোর্ড বেশ কিছুদিন আগেই প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের ইআইআইএন নম্বরযুক্ত আইডি দিয়ে একটি কমন ওয়েবসাইট প্রস্তুত করেছে, যা সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো সম্পূর্ণ বিনামূল্যে ব্যবহার করতে পারে। কিন্তু সেটিতে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান তাদের তথ্য আপলোড করেনি।

এমনকি অনেকে জানেনও না যে, তাদের প্রতিষ্ঠানের জন্য সম্পূর্ণ ফ্রি ব্যবহার উপযোগী একটি ওয়েবসাইট তৈরি করা আছে। বাস্তবে সেটির ব্যবহার বাধ্যতামূলক না করায়, সেটিতে প্রতিষ্ঠানের তথ্যাদি আপলোড করার জন্য তেমন তাগাদা না দেওয়ায়, সেটিকে প্রয়োজনীয় পরিবর্তন করে কাঙ্ক্ষিত মানে উন্নীত না করায় এবং অপরদিকে পৃথক ডায়নামিক ওয়েবসাইট তৈরির জন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে বারবার আদেশ ও পুনরাদেশ দেওয়ায় কোনোটিই সঠিকভাবে হয়নি বলে ধারণা করা যাচ্ছে।

শিক্ষার্থীদের ভর্তি, রেজিস্ট্রেশন, ট্রান্সফার, ফরম পূরণ, পরীক্ষা গ্রহণ, উত্তরপত্র মূল্যায়ন, ফলাফল প্রদান, সনদ প্রদান, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের স্বীকৃতি প্রদান, স্বীকৃতি নবায়ন, স্বীকৃতি বাতিলকরণ, কমিটি গঠন, কমিটির অনুমোদন প্রদান, কমিটি বাতিলকরণ, শিক্ষক-কর্মচারীদের শাস্তি নিশ্চিতকরণ বা অব্যাহতি প্রদান ইত্যাদি বিভিন্ন কাজ যেহেতু শিক্ষা বোর্ডের নিয়ন্ত্রণে অর্থাৎ শিক্ষা বোর্ড যেহেতু শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সংক্রান্ত সর্বাধিক তথ্যের ব্যবহারকারী সেহেতু শিক্ষা বোর্ডকেই একটি কমন ডায়নামিক ওয়েবসাইট ও সফটওয়্যার তৈরি এবং আপডেট ও রক্ষণাবেক্ষণ করার দায়িত্ব দেওয়া যেতে পারে।

এজন্য প্রয়োজনীয় ব্যয় তারা প্রতিষ্ঠানের স্বীকৃতি প্রদান ও নবায়ন ফি বাবদ আদায় করা অর্থের অংশবিশেষ দিয়ে নির্বাহ করতে পারে। অপরদিকে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের আওতাধীন প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য অধিদপ্তর তাদের বাস্তবতার আলোকে পৃথক ওয়েবসাইট ও সফটওয়্যার তৈরি এবং মেইনটেইন করতে পারে।

মনে রাখতে হবে, দেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অবস্থা ও অবস্থান যেহেতু একই রকম নয় সেহেতু মাঠ পর্যায়ের বাস্তবতা বিবেচনা করে কেন্দ্রীয়ভাবে সমন্বিত সবার জন্য অনুকূল কোনো উদ্যোগ ব্যতীত সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ডায়নামিক ওয়েবসাইট ও সফটওয়্যারের ব্যবহার সমভাবে নিশ্চিত করে অত্যাধুনিক শিক্ষাব্যবস্থা সচল রাখা প্রায় অসম্ভব।

লেখক: অধ্যক্ষ, প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট।

এইচআর/এমএফএ/এএসএম