সাহিত্য

কবি হ‌ুমায়ূন আহমেদ এবং তাঁর কবিতা

কবি হ‌ুমায়ূন আহমেদ এবং তাঁর কবিতা

নন্দিত কথাসাহিত্যিক হ‌ুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস, গল্প, নাটক ও গানে সবার কাছে পরিচিত। সিনেমার অনবদ্য স্রষ্টা হিসেবে আজও সমাদৃত। কিন্তু কবি হিসেবে কেমন ছিলেন? সবাই হয়তো সেভাবে ভাবেননি কখনো। তবে তাঁর কবিতাও পড়েছেন উপন্যাসে। উপন্যাসে লেখা কবিতাগুলো তো তাঁরই। তারপরও কবি হিসেবে তাঁর পরিচিতি তেমন ছিল না। তিনি নিজেও হয়তো চাননি সেটা। কেননা কবিতা খুবই কম লিখেছেন তিনি। সব সময় ভাবতেন, কবিতা লেখার প্রতিভা ঈশ্বর তাঁকে দেননি। তাঁর উপন্যাস কম-বেশি সবাই পড়েছি। কিন্তু অনেকের কাছেই অপরিচিত হয়ে আছে তাঁর কবিসত্তা।

Advertisement

তিনি তাঁর বিভিন্ন উপন্যাসের শুরুতেই কবিতার কিছু চরণ তুলে দিতেন। কবিতাকে ভালোবাসতেন, এ কথা নিঃসন্দেহে বলা যায়। ১৯৯৬ সালে কাকলী প্রকাশনী থেকে তাঁর একটি কবিতা সংকলন বের হয়। যার নাম দেওয়া হয় ‘গৃহত্যাগী জোছনা’। সেই সময় কবিতা প্রকাশের একটি নতুন স্টাইল লক্ষ্য করা যায়। আমার সংগ্রহেও হেলাল হাফিজের কবিতার ভিউকার্ড আছে। সেগুলো দেখে দেখে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে কবিতা পড়তাম। আর্টকার্ডে অনেকটা ভিউকার্ডের মতো করে একটি ছোট্ট খামের মধ্যে কিছু কবিতা থাকতো। সমর মজুমদার চিত্রায়িত হ‌ুমায়ূন আহমেদের ‘কবিতা-কার্ড’ তখনই প্রকাশ হয়েছিল। এখানে যে নয়টি কবিতা ছাপা হয়েছিল, তার সবগুলোই লেখকের ‘কবি’ উপন্যাস থেকে নেওয়া হয়েছিল। তবে কবি উপন্যাসে এগুলোর কোনো শিরোনাম ছিল না।

উপন্যাসে কবিতাগুলোর কোনো শিরোনাম না থাকলেও কবিতা কার্ডে শিরোনাম রাখা হয়েছিল। শিরোনামগুলো হলো—‘অশ্রু’, ‘কাচপোকা’, ‘কব্বর’, ‘গৃহত্যাগী জোছনা’, ‘তিনি’, ‘বাবার চিঠি’, ‘সংসার’, ‘বাসর’ ও ‘রাশান রোলেট’। ‘গৃহত্যাগী জোছনা’ কবিতাটি দিয়েই কবি উপন্যাসের সূচনা হয়েছে। এর বাইরে আরও কিছু কবিতার সন্ধান পাওয়া যায়। ‘ছোটবোন সেফুর নামে ইত্তেফাকের নারীদের সাময়িকীতে ছাপা হয়েছিলো তাঁর কবিতা। সেটিই প্রকাশনার বিবেচনায় তাঁর প্রথম ও শেষ কবিতা। পরবর্তীকালে তিনি আর সরাসরি কবিতা লেখেননি। তাঁর সেই কবিতা ‘শঙ্খনীল কারাগার’ উপন্যাসে ব্যবহৃত হয়েছিল।’১

তাহলে কেমন ছিলেন কবি হ‌ুমায়ূন আহমেদ? কেমন ছিল তাঁর কবিতা? এ প্রশ্নের উত্তর পেলেই আমরা পেয়ে যাবো তাঁর কবিসত্তা। তার আগে হ‌ুমায়ূন আহমেদের কিছু কবিতা পড়ে নেওয়া যাক—১.প্রতি পূর্ণিমার মধ্যরাতে একবার আকাশের দিকে তাকাইগৃহত্যাগী হবার মত জ্যোৎস্না কি উঠেছে?বালিকা ভুলানো জ্যোৎস্না নয়।যে জ্যোৎস্নায় বালিকারা ছাদের রেলিং ধরে ছুটাছুটি করতে করতে বলবে—ও মাগো, কি সুন্দর চাঁদ!নবদম্পতির জ্যোৎস্নাও নয়।যে জ্যোৎস্না দেখে স্বামী গাঢ় স্বরে স্ত্রীকে বলবেন—দেখ দেখ নীতু চাঁদটা তোমার মুখের মতই সুন্দর!কাজলা দিদির স্যাঁতস্যাতে জ্যোৎস্না নয়।যে জ্যোৎস্না বাসি স্মৃতিপূর্ণ ডাস্টবিন উল্টে দেয় আকাশে।কবির জ্যোৎস্না নয়। যে জ্যোৎস্না দেখে কবি বলবেন—কি আশ্চর্য রূপার থালার মত চাঁদ!আমি সিদ্ধার্থের মত গৃহত্যাগী জ্যোৎস্নার জন্য বসে আছি।যে জ্যোৎস্না দেখামাত্র গৃহের সমস্ত দরজা খুলে যাবে—ঘরের ভেতরে ঢুকে পড়বে বিস্তৃত প্রান্তর।প্রান্তরে হাঁটব, হাঁটব আর হাঁটব—পূর্ণিমার চাঁদ স্থির হয়ে থাকবে মধ্য আকাশে।চারদিক থেকে বিবিধ কণ্ঠ ডাকবে—আয় আয় আয়।(গৃহত্যাগী জোছনা)

Advertisement

২.দিতে পারো একশ’ ফানুস এনেআজন্ম সলজ্জ সাধ একদিন আকাশে কিছু ফানুস ওড়াই।

৩.এই ক্ষুদ্র জীবনে আমি বারবার দুঃখ পেয়েছি।বারবার হৃদয় হা-হা করে উঠেছে।চারপাশের মানুষদের নিষ্ঠুরতা,হৃদয়হীনতায় আহত হয়েকতবার মনে হয়েছে—এই পৃথিবী বড়ই বিষাদময়!আমি এই পৃথিবী ছেড়েঅন্য কোন পৃথিবীতে যেতে চাই,যে পৃথিবীতে মানুষ নেই।চারপাশে পত্রপুষ্প শোভিত বৃক্ষরাজি।আকাশে চির পূর্ণিমার চাঁদ।যে চাঁদের ছায়া পড়েছে ময়ূরাক্ষী নামের এক নদীতে।সেই নদীর স্বচ্ছ জলে সারাক্ষাণ খেলা করে জোছনার ফুল।দূরের বন থেকে ভেসে আসে অপার্থিব সংগীত।(আমার ছেলেবেলা থেকে নেওয়া)

৪.একটা ঝকঝকে রঙিন কাচপোকাহাঁটতে হাঁটতে এক ঝলক রোদের মধ্যে পড়ে গেল।ঝিকমিকিয়ে উঠল তার নকশাকাটা লাল নীল সবুজ শরীর।বিরক্ত হয়ে বলল, রোদ কেন?আমি চাই অন্ধকার। চির অন্ধকারআমার ষোলটা পায়ে একটা ভারি শরীর বয়ে নিয়ে যাচ্ছি—অন্ধকার দেখব বলে।আমি চাই অন্ধকার। চির অন্ধকারএকটা সময়ে এসে রোদ নিভে গেলবাদুড়ে ডানায় ভর করে নামল আঁধার।কি গাঢ়, পিচ্ছিল থকথকে অন্ধকার!কাচপোকার ষোলটা ক্লান্ত পা বার বারসেই পিচ্ছিল আঠালো অন্ধকারে ডেবে যাচ্ছিল।তার খুব কষ্ট হচ্ছিল হাঁটতেতবু সে হাঁটছে—তাকে যেতে হবে আরও গভীর অন্ধকারে।যে অন্ধকার-আলোর জন্মদাত্রী। (কাঁচপোকা)

৫.শোন মিলি।দুঃখ তার বিষমাখা তীরে তোকেবিঁধে বারংবার।তবুও নিশ্চিত জানি, একদিন হবে তোরসোনার সংসার।।উঠোনে পড়বে এসে এক ফালি রোদতার পাশে শিশু গুটিকয়তাহাদের ধুলোমাখা হাতে—ধরা দেবেপৃথিবীর সকল বিস্ময়। (সংসার)

Advertisement

৬.টেবিলের চারপাশে আমরা ছ’জনচারজন চারদিকে; দু’জন কোনাকুনিদাবার বোড়ের মতখেলা শুরু হলেই একজন আরেকজনকে খেয়ে ফেলতে উদ্যত।আমরা চারজন শান্ত, শুধু দু’জন নিঃশ্বাস বন্ধ করে বসে আছে।তাদের স্নায়ু টানটান।বেড়ালের নখের মত তাদের হৃদয় থেকেবেরিয়ে আসবে তীক্ষ্ণ নখ।খেলা শুরু হতে দেরি হচ্ছে,আম্পায়ার এখনো আসেনি।খেলার সরঞ্জাম একটা ধবধবে সাদা পাতাআর একটা কলম।কলমটা মিউজিক্যাল পিলো হাতে হাতে ঘুরবেআমরা চারজন চারটা পদ লিখবো।শুধু যে দু’জন নখ বের করে কোনাকুনি বসে আছেতারা কিছু লিখবে না।তারা তাদের নখ ধারালো করবেলেখার মত সময় তাদের কোথায়?প্রথম কলম পেয়েছি আমি,আম্পায়ার এসে গেছেন।পিস্তল আকাশের দিকে তাক করে তিনি বললেন,এ এক ভয়ংকর খেলা,কবিতার রাশান রোলেট—যিনি সবচে ভালো পদ লিখবেনতাকে তৎক্ষণাৎ মেরে ফেলা হবে।আমার হাতে কলম কম্পমানসবচে সুন্দর পদ এসে গেছে আমার মুঠোয়।(রাশান রোলেট)

৭.আমি যাচ্ছি নাখালপাড়ায়।আমার বৃদ্ধ পিতা আমাকে পাঠাচ্ছেন তাঁরপ্রথম প্রেমিকার কাছে।আমার প্যান্টের পকেটে সাদা খামে মোড়া বাবার লেখা দীর্ঘ পত্র।খুব যত্নে খামের উপর তিনি তাঁর প্রণয়িণীর নাম লিখেছেন।কে জানে চিঠিতে কি লেখা–?তাঁর শরীরের সাম্প্রতিক অবস্থার বিস্তারিত বর্ণনা?রাতে ঘুম হচ্ছে না, রক্তে সুগার বেড়ে গেছেকষ্ট পাচ্ছেন হাঁপানিতে—এইসব হাবিজাবি। প্রেমিকার কাছেলেখা চিঠি বয়সের ভারে প্রসঙ্গ পাল্টায়অন্য রকম হয়ে যায়।সেখানে জোছনার কথা থাকে না,সাম্প্রতিক শ্বাসকষ্ট বড় হয়ে উঠে।প্রেমিকাও একটা নির্দিষ্ট বয়সের পররোগভোগের কথা পড়তে ভালবাসেন।চিঠি পড়তে পড়তে দরদে গলিত হন—আহা, বেচারা ইদানিং বড্ড কষ্ট পাচ্ছে তো…(বাবার চিঠি)

যারা হ‌ুমায়ূন আহমেদের ‘কবি’ উপন্যাসটি পড়েছেন; তাদের হয়তো নতুন করে কবিতাগুলো পড়ার প্রয়োজন হবে না। শুধু কবি উপন্যাস নয়; আরও কিছু উপন্যাসে তার কবিতা খুঁজলে পাওয়া যাবে। কবি উপন্যাসের শুরুতে হ‌ুমায়ূন আহমেদ লিখেছেন, ‘কবি উপন্যাসে কিছু কবিতা ব্যবহার করতে হয়েছে। অতি বিনয়ের সঙ্গে জানাচ্ছি কবিতাগুলি আমার লেখা। পাঠক পাঠিকারা আমার দুর্বল গদ্যের সঙ্গে পরিচিত। সেই গদ্য তাঁরা ক্ষমা সুন্দর চোখে গ্রহণ করেছেন। কবিতাগুলিও করবেন—এই অসম্ভব আশা নিয়ে বসে আছি। ক্ষমা পেয়ে পেয়ে আমার অভ্যাস খারাপ হয়ে গেছে।’

তবে ‘কবি’ উপন্যাসে একাধিক কবিতার পাশে একটি ছড়া পাওয়া যায়। অনেকটা আহসান হাবীবের ছড়ার প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। তিনি লিখেছেন—আমার বন্ধুর বিয়েউপহার বগলে নিয়েআমি আর আতাহার,মৌচাক মোড়ে এসে বাস থেকে নামলামদু’সেকেন্ড থামলাম।।টিপটিপ ঝিপঝিপবৃষ্টি কি পড়ছে?আকাশের অশ্রু ফোঁটা ফোঁটা ঝরছে?

আমি আর আতাহারবলুন কি করি আর?উপহার বগলে নিয়ে আকাশের অশ্রুসারা গায়ে মাখলাম।।হি হি করে হাসলাম।। (অশ্রু)

‘কে কথা কয়’ উপন্যাসেও কিছু কবিতার উপস্থিতি লক্ষ্য করা গেছে। এই উপন্যাসের একটি কবিতা পড়া যাক—জলে কার ছায়া পড়েকার ছায়া জলে?সেই ছায়া ঘুরে ফিরেকার কথা বলে?কে ছিল সেই শিশুকি তাহার নাম?কেন সে ছায়ারে তারকরিছে প্রণাম?‘লীলাবতী’ উপন্যাসে হ‌ুমায়ূন আহমেদ উৎসর্গ অংশে লিখেছেন—‘শুদ্ধতম কবি জীবনানন্দ দাশকবি, আমি কখনো গদ্যকার হতে চাই নি।আমি আপনার মতো একজন হতে চেয়েছি।হায়, এত প্রতিভা আমাকে দেয়া হয় নি।’

বলাই বাহুল্য, উপন্যাস লেখার অনেক আগেই তাঁর কবিসত্তার সন্ধান পাওয়া যায়। কেননা শৈশবেও হ‌ুমায়ূন আহমেদ কবিতা লিখেছেন। তাঁর লেখা প্রথম কবিতা ‘God’। কবিতাটির নিচে লেখা ছিল Humayun Ahmed Class X Section B. কবিতাটি এমন:Let the earth moveLet the sun shineLet them to proveAll are in a line.২তাই সবশেষে মুম রহমানের সঙ্গে সুর মিলিয়ে বলতে হয়, ‘কবি হওয়ার প্রতিভা তার ছিলো কি-না সেটি তর্ক সাপেক্ষ, কিন্তু তিনি কবি হতে চেয়েছিলেন তাতে কোন ভুল নেই। আমার কাছে অন্তত মনে হয়, শেষ পর্যন্ত হ‌ুমায়ূন আহমেদ একজন কবিই ছিলেন।’ শুধু তা-ই নয়, তিনি একাধারে সফল গীতিকবিও। তাঁর জনপ্রিয় গানগুলো এখনো শ্রোতাদের কানে বেজে ওঠে। ‘যদি মন কাঁদে তুমি চলে এসো’ কিংবা ‘একটা ছিল সোনার কন্যা’ শ্রোতাদের মন জয় করে নিয়েছে। সেই হিসেবে একজন গীতিকবিও মূলত কবি। ফলে হ‌ুমায়ূন আহমেদকে আমরা নিঃসন্দেহে ‘কবি’ বলতে পারি।

তথ্যসূত্র:১. হ‌ুমায়ূন আহমেদ: যখন তিনি কবি, মুম রহমান, সহজিয়া, ১২ নভেম্বর ২০২০২. আপনারে আমি খুঁজিয়া বেড়াই, হ‌ুমায়ূন আহমেদ, আমার ছেলেবেলা, শেষ পর্ব, শঙ্খনদী, পৃষ্ঠা-৮৬৩. হ‌ুমায়ূন আহমেদের কবিতা: জীবনের শাদাকালো সুর, রেজওয়ান তানিম, মহাপথ, ২৩ জুলাই ২০১৬৪. জোছনা ও গৃহত্যাগী কবি হ‌ুমায়ূন আহমেদ, হাসান হামিদ, বাংলা কবিতা।

এসইউ/