সাহিত্য

চিরন্তন আলোর সন্ধানী অধ্যাপক এমাজউদ্দীন আহমদ

চিরন্তন আলোর সন্ধানী অধ্যাপক এমাজউদ্দীন আহমদ

আনোয়ার হোসাইন শেখ মুহাম্মদ

Advertisement

বাংলাদেশের শিক্ষাক্ষেত্র, রাষ্ট্রচিন্তা ও রাজনৈতিক বিশ্লেষণে একটি উজ্জ্বল নাম অধ্যাপক ড. এমাজউদ্দীন আহমদ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য, একজন নন্দিত শিক্ষক, গবেষক ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানী হিসেবে তাঁর অবদান আজও সমানভাবে প্রাসঙ্গিক। তিনি ছিলেন এমন একজন ব্যক্তি, যিনি জ্ঞানচর্চাকে শুধু পেশা নয়, দায়িত্ব ও সাধনার জায়গা থেকে গ্রহণ করেছিলেন। যাঁর জীবন ও কর্ম আজকের প্রজন্মের জন্য এক অনন্য দৃষ্টান্ত।

অধ্যাপক ড. এমাজউদ্দীনের জন্ম ১৯৩২ সালের ১৫ ডিসেম্বর অবিভক্ত বাংলার মালদহ জেলার কালিনগর গ্রামে। পরবর্তীতে তাঁর পরিবার চাঁপাইনবাবগঞ্জে বসবাস শুরু করে। রাজশাহী কলেজে পড়াশোনার পর তিনি সরকারি কলেজে প্রভাষক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। এরপর কানাডার কুইন্স ইউনিভার্সিটি থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। দেশে ফিরে যোগ দেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে, যেখানে তিনি শিক্ষকতা ছাড়াও বিভাগীয় প্রধান এবং পরে উপাচার্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৯২ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য নিযুক্ত হন।

অধ্যাপনা ও প্রশাসনিক দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি তিনি ছিলেন এক নিবেদিতপ্রাণ গবেষক। জীবদ্দশায় তিনি ৭০টিরও বেশি বই রচনা করেন, যার মধ্যে অনেকগুলোই বাংলাদেশের পাঠ্যসূচিতে অন্তর্ভুক্ত। বিশেষত তাঁর রাষ্ট্রবিজ্ঞান সম্পর্কিত গ্রন্থগুলো, যেমন- ‘রাষ্ট্রবিজ্ঞানের কথা’, ‘তুলনামূলক রাজনীতি’, ‘বাংলাদেশে গণতন্ত্র সংকট’, ‘গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ’ ইত্যাদি বর্তমান ছাত্র, গবেষক ও পাঠকের জন্য অনুপ্রেরণার উৎস।

Advertisement

তাঁর লেখা বই ও প্রবন্ধে তিনি বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতা, দক্ষিণ এশিয়ার সামরিক ও কূটনৈতিক সম্পর্ক, প্রশাসনিক কাঠামো, সুশাসন, এবং গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ নিয়ে গভীর বিশ্লেষণ করেছেন। তাঁর গবেষণাগুলোর বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি, বিশ্লেষণের গভীরতা ও ভাষার সৌন্দর্য পাঠকদের মনে আলাদা জায়গা করে নেয়। বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য, নবম-দশম শ্রেণির জন্য তাঁর ইংরেজি ব্যাকরণ বই, যা আজও বহু শিক্ষার্থীর টেবিলে স্থান করে নিয়েছে। তিনি পাঠ্যপুস্তক প্রণয়নে এতটাই সফল ছিলেন যে, রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ছাত্রছাত্রীদের জন্য তাঁর বইগুলো প্রায় অপরিহার্য হিসেবে বিবেচিত।

পাঠদান ও গবেষণার বাইরেও অধ্যাপক এমাজউদ্দীন এক প্রজ্ঞাবান প্রশাসক ছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য থাকাকালে তিনি সবধরনের রাজনৈতিক প্রভাব ও পক্ষপাতদুষ্টতা থেকে নিজেকে দূরে রেখে সততা, ন্যায়ের সঙ্গে প্রশাসনিক দায়িত্ব পালন করেন। শিক্ষার্থীদের প্রতি তাঁর ভালোবাসা ছিল পিতৃসুলভ, যাদের তিনি স্নেহ করে ডাকতেন ‘বাবাজী’ নামে। তাঁর স্নেহ, উৎসাহ, পরামর্শ আজও তাঁর ছাত্রদের মনে গেঁথে আছে। তাঁর গুণাবলি শুধু শিক্ষকতা বা গবেষণার মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না। তিনি ছিলেন একজন প্রাজ্ঞ বক্তা, সুশীল নাগরিক ও বিশ্লেষক। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন ইস্যুতে তিনি সংবাদপত্রে কলাম লিখেছেন, সেমিনারে বক্তব্য রেখেছেন। তাঁর কলামে রাজনৈতিক বিশ্লেষণ ছিল স্পষ্ট, যুক্তিসম্মত এবং ভবিষ্যৎ দিকনির্দেশনামূলক। তিনি কখনোই কোনো নির্দিষ্ট রাজনৈতিক দলের হয়ে রাজনীতি করেননি বরং গণতন্ত্র ও জনকল্যাণের পক্ষে নিরপেক্ষভাবে কথা বলেছেন। তাঁর লেখায় ও বক্তৃতায় গণতন্ত্র, সুশাসন, জাতির অগ্রগতি ও বৈষম্যহীনতা, জনঅধিকারই ছিল মূল ভাবনা। তিনি বিশ্বাস করতেন, একটি জাতির উন্নয়নের জন্য সঠিক রাজনৈতিক চিন্তা ও সুশিক্ষার বিকল্প নেই।

আরও পড়ুন স্পেনের গৃহযুদ্ধ এবং জর্জ অরওয়েলের ‘মারাকেচ’ নজরুলের প্রেম নজরুলের দ্রোহ

শুধু দেশের মাটিতেই নয়, আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলেও তাঁর কৃতিত্ব ছড়িয়ে ছিল। জাতিসংঘের ৪১তম অধিবেশনে তিনি বাংলাদেশকে প্রতিনিধিত্ব করেছেন। গবেষণামূলক প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে দেশ-বিদেশের খ্যাতনামা জার্নালে। তিনি ছিলেন এশিয়াটিক সোসাইটির সদস্য এবং বিভিন্ন বুদ্ধিবৃত্তিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে সম্পৃক্ত। তাঁর অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি পেয়েছেন একুশে পদকসহ বহু জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সম্মাননা। মাইকেল মধুসূদন গোল্ড মেডেল, শেরে বাংলা স্মৃতি স্বর্ণপদক, জিয়া সাংস্কৃতিক স্বর্ণপদকসহ বহু পুরস্কার তাঁর ঝুলিতে স্থান পেয়েছে। ২০১৮ সালে ইউডা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অবসর নিলেও তাঁর লেখনী ও বিশ্লেষণ ছিল টাটকা এবং সমাজের জন্য প্রয়োজনীয়। গণমাধ্যমে তিনি ছিলেন নিয়মিত আলোচক। তাঁর চিন্তা-চেতনায় সব সময়ই ছিল একটি স্বপ্নের বাংলাদেশ। যেখানে থাকবে ন্যায়, গণতন্ত্র, সুশাসন ও শিক্ষার আলো।

২০২০ সালের ১৭ জুলাই এই জ্ঞানতাপস চিরবিদায় নেন। সত্যিই কি তাঁর মৃত্যু হয়েছে? ইতিহাস বলে, যাঁরা জাতিকে আলোকিত করেন, তাঁরা কখনোই হারিয়ে যান না। অধ্যাপক এমাজউদ্দীনের চিন্তা, গবেষণা ও লেখনীর ভান্ডার আজও আমাদের আলোকিত পথ দেখায়। তিনি এক আলোর শিখা, যাঁর দীপ্তি প্রজন্ম থেকে প্রজন্মের অন্তরে ছড়িয়ে যাবে।

Advertisement

যারা তাঁকে চিনতেন, তারা জানেন তিনি ছিলেন সহজ, অনাড়ম্বর, সদা হাস্যময় এক প্রজ্ঞাবান মানুষ। সর্বদা সাহস, স্বচ্ছতা ও মানবিকতার পক্ষ নিয়ে কথা বলতেন। তাঁর সব কর্মকাণ্ড ছিল আন্তরিকতা, সদিচ্ছা, দেশপ্রেম, নৈতিকতা ও জ্ঞানানুসন্ধান। এই ছিল তাঁর জীবনের পরম দর্শন। আজকের শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও রাজনৈতিক নেতৃত্বের উচিত অধ্যাপক এমাজউদ্দীনের জীবন ও কর্ম থেকে অনুপ্রেরণা নেওয়া। একজন শিক্ষক, গবেষক এবং মানবিক মানুষ হিসেবে তিনি যে দৃষ্টান্ত রেখে গেছেন, তা সত্যিকার অর্থেই আমাদের জাতির জন্য অহংকার।

তাঁর লেখনী যেমন ছিল চিন্তাশীল, তেমনই তাঁর জীবন ছিল শান্ত অথচ দীপ্তিময়। রাষ্ট্রচিন্তার এই দীপ্ত আলো আমাদের জাতির পথপ্রদর্শক হয়ে থাকবেন চিরকাল।

লেখক: পিএইচডি গবেষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এম.ফিল স্কলার।

এসইউ/এএসএম