দেশজুড়ে

ভারতের নিষেধাজ্ঞায় বিপন্ন পাবনার হোসিয়ারি শিল্প

ভারতের নিষেধাজ্ঞায় বিপন্ন পাবনার হোসিয়ারি শিল্প

ভারতের সঙ্গে স্থলপথে রপ্তানি বন্ধ হওয়ায় একের পর এক বন্ধ হয়ে যাচ্ছে গার্মেন্টসের পরিত্যক্ত কাপড় (ঝুট) দিয়ে গেঞ্জি বা পোশাক তৈরির পাবনার ক্ষুদ্র হোসিয়ারি কারখানা। নৌপথে রপ্তানির সুযোগ থাকলেও পোশাক ডেলিভারিতে একদিনের পরিবর্তে সময় লাগছে প্রায় এক মাস। ব্যয়ও বেড়েছে দ্বিগুণ। এতে লোকসান ও ঋণে বাধ্য হয়ে ৩-৪ হাজার কারখানা বন্ধ করে দিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। ফলে কর্মহীন হয়ে পড়েছেন দুই-তৃতীয়াংশ ঝুটশ্রমিক।

Advertisement

পাবনা শহরের অদূরের গ্রাম দ্বীপচরের বাসিন্দা মিরাজুল ইসলাম। তিনি পেশায় একজন হোসিয়ারি ব্যবসায়ী। তার প্রতিষ্ঠানের নাম ‌‘আসান হোসিয়ারি’। ঢাকা বা নারায়ণগঞ্জের মতো বিভিন্ন জেলার পোশাক কারখানা থেকে পরিত্যক্ত ঝুট কিনে এনে গেঞ্জি, সোয়েটার ও মোজাসহ নানান পোশাক বানিয়ে রপ্তানি করতেন ভারত, মালয়েশিয়া ও কাতারসহ বিভিন্ন দেশে। দুই-তৃতীয়াংশ পোশাকই রপ্তানি হতো ভারতে।

হোসিয়ারি পণ্য তৈরির দোকান ও কারখানার সাটারে তালা ঝুলছে/ছবি-জাগো নিউজ

২০০০ সালে এই ব্যবসাপ্রতিষ্ঠা করেন মিরাজুলের বাপ-দাদা। এরপর ২০১৫ সালে ব্যবসার হাল ধরেন তিনি। শুরুটা অল্প দিয়ে হলেও এখন তার গেঞ্জি বা এ ধরনের পোশাক তৈরির কারখানার সংখ্যা সাতটি।

Advertisement

‘লক্ষাধিক শ্রমিকের সংসার চলতো এই ব্যবসার ওপর নির্ভর করে। তারা কাজ হারাচ্ছেন। আমার প্রতিমাসে ২৫ লাখ টাকার গেঞ্জি ডেলিভারি হতো। রপ্তানি বন্ধের পর কোনো আয় নেই। অথচ ব্যাংক লোন আছে। সেগুলো পরিশোধ করা নিয়ে বড় চিন্তায় আছি।’

মিরাজুল আগে প্রতিমাসে ৬ কোটির বেশি টাকার পোশাক রপ্তানি করতেন। কিন্তু সেই সোনালি দিন এখন ফিকে। গত ১৭ মে ভারতের সঙ্গে দেশের স্থলবন্দর দিয়ে মালামাল আমদানি-রপ্তানি বন্ধ হওয়ায় বিপাকে পড়েছেন তিনি। তৈরি পোশাকে বিশাল গোডাউন ঠাসা। ডেলিভারি দিতে পারছেন না। ফলে প্রায় বন্ধ রেখেছেন গেঞ্জি বা পোশাক তৈরি।

বিক্রির অভাবে কারখানায় পড়ে হোসিয়ারি পণ্য/ছবি-জাগো নিউজ  

কারখানার মালিক মিরাজুল ইসলাম জানান, তার কারখানাগুলোতে আগে হাজারেরও বেশি শ্রমিক কাজ করেছেন। এখন শ্রমিক রেখেছেন ১০০ জনের মতো। বাকিদের ছাঁটাই করতে বাধ্য হয়েছেন। এতে কাজ হারিয়ে বিপাকে পড়েছেন শ্রমজীবীরা। নিঃস্ব হওয়ার পথে কারখানা মালিকরাও।

Advertisement

আরও পড়ুন: বাংলাদেশের কাপড়-পাট-সুতার পণ্য আমদানিতে ভারতের নিষেধাজ্ঞাভারতে পণ্য রপ্তানিতে অতিরিক্ত কত পথ পাড়ি দিতে হবে?অর্ধেকে নেমেছে আখাউড়া স্থলবন্দরের রপ্তানিস্থলবন্দর ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞা: ভারতের ক্ষতি কতটা?

মিরাজুল ইসলামের মতোই দুর্দশা হয়েছে জেলার হোসিয়ারি ও ঝুট ব্যবসায়ীদের। জেলা শহরঘেঁষা বাংলা বাজার এলাকায় প্রায় ৪০০টির মতো গেঞ্জি তৈরির কারখানা ও ঝুটের দোকান রয়েছে।

‘প্রতি মাসে জেলা থেকে ৭০-৮০ গাড়ি পোশাক রপ্তানি হতো। আন্তর্জাতিক হিসেবে মাসে ১০-১৫ লাখ ডলার ও বছরে ২-৩ কোটি ডলারের গেঞ্জি বা পোশাক রপ্তানি হতো। ঢাকা বা অন্যান্য জেলার গার্মেন্টস ব্যবসায়ীদের বাতিল করে দেওয়া ঝুট বা কাপড় কিনে এনে তৈরি করা গেঞ্জি বা পোশাকে এই টাকা রেমিট্যান্স আসতো দেশে। এখন সেটিও বন্ধ হয়ে যাবে।’

সরেজমিনে দেখা গেছে, এর কয়েকটি দোকান সাময়িক সময়ের জন্য খোলা। তবে বাকি সব দোকান ও কারখানার সাটার বন্ধ। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ভারতের সঙ্গে স্থলপথে আমদানি-রপ্তানি বন্ধ হওয়ায় কারখানা চালাতে পারছেন না মালিকরা। ঋণ ও পাওনাদারের ভয়ে অনেকেই কারখানা বন্ধ রেখেছেন।

একটি কারখানার ভেতরের চিত্র/ছবি-জাগো নিউজ

বাংলা বাজার হোসিয়ারি ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি ও নিউ সুবর্ণা হোসিয়ারির স্বত্বাধিকারী মো. রফিক শেখ জাগো নিউজকে বলেন, ‘এই বাজারে ১০০টির মতো কারখানা কোনোমতে চালু রয়েছে। ব্যবসা না থাকায় বাকিরা সব কারখানা বন্ধ করে দিয়েছেন।’

তিনি বলেন, ‘লক্ষাধিক শ্রমিকের সংসার চলতো এই ব্যবসার ওপর নির্ভর করে। তারা কাজ হারাচ্ছেন। আমার প্রতিমাসে ২৫ লাখ টাকার গেঞ্জি ডেলিভারি হতো। রপ্তানি বন্ধের পর কোনো আয় নেই। অথচ ব্যাংক লোন আছে। সেগুলো পরিশোধ করা নিয়ে বড় চিন্তায় আছি।’

ব্যবসায়ীরা জানান, প্রতি মাসে জেলা থেকে ৭০-৮০ গাড়ি পোশাক রপ্তানি হতো। আন্তর্জাতিক হিসেবে মাসে ১০-১৫ লাখ ডলার ও বছরে ২-৩ কোটি ডলারের গেঞ্জি বা পোশাক রপ্তানি হতো। ঢাকা বা অন্যান্য জেলার গার্মেন্টস ব্যবসায়ীদের বাতিল করে দেওয়া কাপড় কিনে এনে তৈরি করা গেঞ্জি বা পোশাকে এই টাকা রেমিট্যান্স আসতো দেশে। এখন সেটিও বন্ধ হয়ে যাবে।

কারখানায় কাজ করছেন নারী শ্রমিকরা/ছবি-জাগো নিউজ

তারা আরও জানান, স্থলবন্দর বন্ধ থাকায় ঘরে থাকা পোশাক অল্প অল্প করে নৌপথে পাঠালেও খরচ বাড়ছে দ্বিগুণ। আবার আগে একদিনে চালান ভারতে পৌঁছালেও নৌপথে পৌঁছাতে ২০ দিন থেকে এক মাস সময় লেগে যাচ্ছে। ভারতীয় পার্টিরও ব্যয় বাড়ছে। এভাবে চললে আমরা বাজার হারাবো।

‘এসব কারখানায় নারী ও পুরুষ মিলিয়ে লক্ষাধিক লোকের কর্মসংস্থান ছিল। এখন কারখানাগুলোই বিপন্ন। ৩-৪ হাজারের মতো কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। কাজ হারিয়েছেন দুই তৃতীয়াংশ শ্রমিক।’

১৪ বছর ধরে এই ব্যবসায় জড়িত আনোয়ার হোসেন। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘এরমধ্যে এরকম পরিস্থিতি দেখিনি। ৩ মাস ঘর ভাড়াই দিতে পারি না। ব্যাংক ও এনজিওর কিস্তি দিতে পারছি না। আমাদের মতো ছোট ব্যবসায়ীরা একেবারে শেষ।’

কথা হয় কারখানা মালিক ও রপ্তানিকারক আব্দুল খালেকের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘জুন মাসের ১৭ তারিখে এক গাড়ি মাল পাঠাইছি। এখনো ক্রেতার কাছে পৌঁছায়নি। মাসে কোটি টাকার মাল রপ্তানি করতাম। এখন কিচ্ছু নাই। আমার একশোর ওপরে লেবার। এগুলো কীভাবে চালাবো? ব্যাংক লোন আছে ৫০ লাখ টাকা। কীভাবে পরিশোধ করবো?’

একই চিত্র শহরের সাধুপাড়া ঝুটপট্টি এলাকাতেও। কিছুদিন আগেও যে কারখানাগুলোতে ছিল কর্মব্যস্ততা, সেখানে আজ শুধুই সুনসান নীরবতা। লোকসানে পড়ে বেশিরভাগ ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানেই ঝুলছে তালা।

এই এলাকার এস বি রাসেল হোসিয়ারি কারখানার মালিক রাসেল জানান, চট্টগ্রাম নৌবন্দর দিয়ে এক চালান মাল পাঠাতে তাদের সময় লাগছে এক থেকে দেড় মাস। এতে করে খরচ বেড়েছে। সময়মতো চালান না পৌঁছানোয় মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন বিদেশি ক্রেতারা। তাই এ সমস্যা সমাধানে দ্রুত সরকারের হস্তক্ষেপ কামনা করেন তিনি।

আরও পড়ুন: খরচ বাড়বে ৫ গুণ, ভারতের বাজার হারানোর শঙ্কায় রপ্তানিকারকরাভারতের নিষেধাজ্ঞায় শেওলা স্থলবন্দরে রপ্তানিতে অচলাবস্থাদুই প্রতিবেশীর সঙ্গেই টানাপোড়েনে বাংলাদেশ, বাড়ছে চাপকূটনৈতিক আলোচনার মাধ্যমে সমাধানের অনুরোধ বিকেএমইএর

বাংলাবাজারের শফিফুল ইসলাম, সুজন আলী ও সুলতান মাহমুদ খোকনসহ কয়েক ওয়েস্ট ফেব্রিক ব্যবসায়ী জানান, কারখানাগুলোতে কাজ কমে যাওয়ায় পর্যাপ্ত পরিমাণ ঝুট মজুত থাকলেও তা বিক্রি হচ্ছে না। বেচাবিক্রি না থাকায় ব্যাংক লোন ও অন্যান্য ঋণের দায়ে বেশিরভাগ দোকানগুলোতে তালা ঝুলছে।

হোসিয়ারি শ্রমিক আশরাফ ও আলমসহ কয়েকজন শ্রমিক জানান, আগে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত তারা ১০ ঘণ্টা কাজ করতেন। এখন কারখানায় কাজ কমে যাওয়ায় দিনে পাঁচ ঘণ্টা কাজ করতে হচ্ছে তাদের। এতে করে সাপ্তাহিক মজুরি অর্ধেক কমে পরিবার নিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছেন তারা।

হোসিয়ারি ম্যানুফ্যাকচারার্স গ্রুপের তথ্য বলছে, ২০০০ সালের দিকে গার্মেন্টেসের পরিত্যক্ত বা বাতিলকৃত কাপড় দিয়ে পাবনার শ্রমিকরা গেঞ্জি তৈরির কাজ শুরু করেন। এ গেঞ্জিগুলো মানসম্মত হওয়ায় খুব তাড়াতাড়িই দেশ ও দেশের বাইরে ছড়িয়ে পড়লে সোয়েটার বা অন্যান্য পোশাকও তৈরি শুরু করেন তারা। এরপর ব্যবসায়িক প্রসারতায় জেলায় এখন পাঁচ হাজারের বেশি গেঞ্জি বা এ জাতীয় পোশাক তৈরির ক্ষুদ্র কারখানা রয়েছে। এসব কারখানায় নারী ও পুরুষ মিলিয়ে লক্ষাধিক লোকের কর্মসংস্থান ছিল। এখন কারখানাগুলোই বিপন্ন। ৩-৪ হাজারের মতো কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। কাজ হারিয়েছেন দুই তৃতীয়াংশ শ্রমিক।

এই শিল্প না বাঁচাতে পারলে পাবনার অর্থনৈতিক উন্নয়ন বন্ধ হয়ে যাবে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেন জেলা হোসিয়ারি ম্যানুফ্যাকচারার্স গ্রুপের সভাপতি সরদার মো. সেলিম রেজা।

তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘ব্যবসায়িক মন্দায় একদিকে যেমন শ্রমিকরা বেকার হচ্ছেন, অন্যদিকে স্বল্প পুঁজির ব্যবসায়ীরা চালান হারিয়ে পথে বসছেন। দুই তিন মাস হলো ব্যাংকে কিস্তি দিতে পারছে না। এতে সরকারও রেমিট্যান্স হারাচ্ছে। তাই বিকল্প বাজার তৈরি অথবা আমদানি-রপ্তানি স্বাভাবিক করার মধ্য দিয়ে এ শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখার দাবি সরকারের প্রতি।’

বিষয়টি নিয়ে জেলা প্রশাসকের (ডিসি) মাধ্যমে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে যোগাযোগ করা হয়েছে জানিয়ে পাবনা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি সাইফুল আলম স্বপন চৌধুরী জাগো নিউজকে বলেন, ‘পণ্য বেচাকেনাই ব্যবসার মূল বিষয়। সেক্ষেত্রে আমদানি-রপ্তানি স্বাভাবিক করে বা ভিন্ন বাজার তৈরি করে, যেভাবেই হোক; ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে সরকার দ্রুত পদক্ষেপ নেবে এটিই আমরা প্রত্যাশা করি।’

পাবনার জেলা প্রশাসক মো. মফিজুল ইসলাম বলেন, বিষয়টি আপনার মাধ্যমেই জানলাম। ব্যবসায়ীদের ডেকে সমস্যা ও দাবিগুলো শুনবো। এরপর বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে সমাধানের চেষ্টা করা হবে।

এসআর/জেআইএম