‘আগে স্বামীসহ ঢাকায় ছিলাম। তখন অনেক ভালো ছিলাম। জুলাই আন্দোলনে মারা যাওয়ার পর আমি এখন মানুষের বাসায় কাজ করি। ছেলেমেয়ের পড়াশোনা বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছে। একটা থাকার মতো ঘর যদি সরকার দিতো, তাহলে অন্তত মাথা গোঁজার ঠাঁই হতো।’
Advertisement
আক্ষেপের সঙ্গে কথাগুলো বলছিলেন জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থানে গুলিতে শহীদ মামুন হাওলাদারের স্ত্রী জাকিয়া বেগম। তিনি পটুয়াখালীর গলাচিপা উপজেলার চিকনিকান্দী ইউনিউনের বাসিন্দা। গত বছরের ৫ আগস্ট ঢাকার আদাবরে গুলিতে শহীদ হন। বর্তমানে তার পরিবারের অবস্থা করুণ।
তবে শুধু মামুন হাওলাদারের পরিবার নয়; খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত বছরের জুলাই-আগস্টের অভ্যুত্থানে শহীদ পটুয়াখালীর ২৫টি পরিবার আজও বাঁচার লড়াইয়ে জর্জরিত। কেউ হারিয়েছেন একমাত্র ছেলেকে, কেউবা পরিবারের উপার্জনক্ষম একমাত্র মানুষটিকে। শোকে নুয়ে পড়া পরিবারগুলো এখন আর্থিক ও চিকিৎসা সংকটসহ ভবিষ্যতের অনিশ্চয়তার মধ্যে দিন কাটাচ্ছে। সরকারের প্রাথমিক সহযোগিতা মিললেও তারা এখন চান স্থায়ী পুনর্বাসন ও কর্মসংস্থানের নিশ্চয়তা।
‘আমার স্বামী ঢাকায় ব্যবসা করতেন। এক ছেলে ও এক মেয়েকে নিয়ে আমরা ছোট পরিবার ছিলাম। তার মৃত্যু আমাদের জীবনে অন্ধকার নামিয়ে আনে। এখনো কোনো কাজ জোটেনি। আত্মীয়-স্বজনের সাহায্যে কোনোরকমে বেঁচে আছি।’
Advertisement
কথা হয় পটুয়াখালী সদর উপজেলার আউলিয়াপুরের বাসিন্দা শহীদ বাচ্চু হাওলাদারের স্ত্রী লাইলী বেগমের সঙ্গে। কেমন আছেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘ঢাকা থেকে চলে এসেছি। পটুয়াখালীতে ভাড়া বাসায় থাকছি। স্বামী না থাকায় ছেলেকে ঢাকায় কাজ করতে পাঠিয়েছি। মেয়েটাকে নিয়ে এখানে আছি, কিন্তু খুব কষ্টে। যদি একটা চাকরির ব্যবস্থা হতো, অন্তত সংসারটা বাঁচতো।’
শহীদ বাচ্চুর প্রতিবেশী নিলুফা ইয়াসমিন জাগো নিউজকে বলেন, ‘পরিবারটি সবসময় ঢাকাই থাকতো। বাচ্চু কাকা মারা যাওয়ার পর তারা পটুয়াখালীতে এই গ্রামের বাড়িতে এসেছিলেন। কিন্তু এখানে থাকার মতো ঘর না থাকায় তারা শহরে ভাড়া বাসায় চলে গেছেন। খুব অসহায় ও কষ্টের মধ্যে দিয়ে তাদের থাকতে হচ্ছে।’
আরও পড়ুন: ভিডিও ভাইরাল হলেও তালিকায় নেই শহীদ হৃদয়, আমন্ত্রণ পেলো না পরিবারওনির্বাচন কমিশন এখনই পক্ষপাতমূলক আচরণ করছে: মনিরা শারমিনজুলাই যোদ্ধাদের আত্মকর্মসংস্থানে আইসিটি বিভাগের সহায়তার ঘোষণাজুলাই আন্দোলনে আহত-শহীদদের এককালীন অনুদান-ভাতা দেওয়া হবেশহীদ জাহাঙ্গীর হোসেনের ছেলে সুজন জাগো নিউজকে বলে, ‘আমার বাবা ঢাকায় ভ্যান চালাতেন। ১৯ জুলাই যাত্রাবাড়ী টোলপ্লাজায় ছাত্রদের সঙ্গে আন্দোলনে যোগ দিলে সেখানে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান। আমি তখন নবম শ্রেণিতে পড়তাম। বাবার মৃত্যুর পর লেখাপড়া চালিয়ে যেতে পারিনি। ছোট ভাইকে নিয়ে পটুয়াখালীতে চলে আসি। এখন একটি গ্লাসের দোকানে কাজ করি।’
‘পটুয়াখালীতে সরকারি গেজেটভুক্ত যে ২৫টি শহীদ পরিবার রয়েছে, তাদের আমরা এরইমধ্যে ১০ লাখ টাকা করে সঞ্চয়পত্র দিয়েছি। তাদের নিয়ে সামনে সরকারের অনেক বড় পরিকল্পনা রয়েছে। সরকারের দিকনির্দেশনা পেলেই আমরা সেগুলো বাস্তবায়ন করবো।’
Advertisement
সুজন আরও বলে, ‘গ্রামের বাড়িতে থাকলেও আমরা ভালো নেই। আমাদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা হোক। আমি বিশ্বাস করি, আমার বাবাকে আওয়ামী লীগ সরকার হত্যা করেছে। আমি এর বিচার চাই।’
ঢাকার ধনিয়া এলাকায় একটি বিদ্যুৎ কারখানায় কাজ করতেন পটুয়াখালীর আরেক সন্তান আমিন। গত বছরের ২১ জুলাই যাত্রাবাড়ী ধনিয়া থেকে বাসায় ফেরার পথে ছাত্রদের সঙ্গে আন্দোলনে যোগ দেন। তারপর গুলিতে সেখানেই মারা যান। পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তার আয়ে সংসার চলতো। তার মৃত্যুর পর পরিবারটি পড়েছে অথৈই সাগরে।
শহীদ আমিনের বাবা ওবায়দুল ইসলাম বলেন, ‘বাধ্য হয়ে গ্রামে ফিরে এসেছি। সরকার যদি কর্মসংস্থান বা অন্তত একটি ঘরের ব্যবস্থা করে, তবে আমাদের বাঁচার পথ খুলে যায়।’
আরেক শহীদ নবীন তালুকদার। ১৯ জুলাই পল্টন এলাকায় আন্দোলন চলাকালীন সরাসরি গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান। তার স্ত্রী রুমা আক্তার জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমার স্বামী ঢাকায় ব্যবসা করতেন। এক ছেলে ও এক মেয়েকে নিয়ে আমরা ছোট পরিবার ছিলাম। তার মৃত্যু আমাদের জীবনে অন্ধকার নামিয়ে আনে। এখনো কোনো কাজ জোটেনি। আত্মীয়-স্বজনের সাহায্যে কোনোরকমে বেঁচে আছি।’
কথা হয় শহীদ দুলাল সরদারের বড় ছেলে সাইফুল ইসলামের সঙ্গে। তিনি জানান, ১৮ জুলাই রাজধানীর ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির সামনে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান দুলাল সরদার। তিনি ঢাকায় গাড়ি চালাতেন।
সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘আমরা চার ভাই-বোনসহ পরিবারের সদস্য সংখ্যা এখন ৯ জন। সবাই আমার ওপর নির্ভরশীল। আমি একটি কোম্পানিতে চাকরি করি। কিন্তু ওই আয় দিয়ে সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছি।’
আরও পড়ুন: ছেলের কথা বলতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন শহীদ শান্তর মাউপদেষ্টারা নিচে, সভামঞ্চে শহীদ পরিবারের সদস্যরাএ সরকারের আমলেই আবু সাঈদ হত্যাকাণ্ডের বিচার হবে: আইন উপদেষ্টাসদর উপজেলার মাদারবুনিয়ার শহীদ রায়হানের মা কাঁদতে কাঁদতে বলেন, ‘আমার ছেলেটা আমার পরিবারের সবকিছু দেখতো। ও চলে যাওয়ার পর আমরা অসুস্থ হয়ে পড়েছি। চিকিৎসা করানোর সামর্থ্য নেই। আমরা খুব কষ্টে আছি।’
শহীদদের বিষয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন পটুয়াখালীর নেতা তোফাজ্জেল হোসেন জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমরা আন্দোলন করেছি সুন্দর একটি দেশ পাওয়ার জন্য। কিছুটা হলেও আমরা পেয়েছি। সরকারের কাছে আমার দাবি থাকবে, জুলাই অভ্যুত্থানে আহত-নিহত পরিবারদের যেন সর্বোচ্চ সহযোগিতা করা হয়।’
পটুয়াখালী জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক মুজিবুর রহমান টোটন জাগো নিউজকে বলেন, ‘জুলাই আন্দোলনে আহত-নিহত পরিবারদের জন্য আমাদের অনেক বড় পরিকল্পনা রয়েছে। তবে প্রশাসনের পক্ষ থেকে তাদের অনেক সহযোগিতা করা হয়েছে। কিছুদিন আগে পটুয়াখালী ছাত্রদলের যে চারজন নিহত হয়েছিলেন, তাদের পরিবারকে ঢাকায় নিয়ে যাওয়া হয়েছিল বড় একটা অনুষ্ঠানে।’
জেলা জামায়াতের আমির নাজমুল আহসান বলেন, ‘পটুয়াখালীতে এরইমধ্যে আমাদের পক্ষ থেকে শহীদ পরিবারকে দুই লাখ টাকা করে দেওয়া হয়েছে। তাদের কর্মসংস্থানের জন্য আমরা বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করছি। তাদের জন্য মানবিক সহযোগিতা অব্যাহত রয়েছে। আশা করছি, সামনে তাদের জন্য আরও ভালো কিছু করতে পারবো।’
এদিকে শহীদ ও আহতদের জন্য উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন পটুয়াখালীর সিভিল সার্জন ডা. খালেদুর রহমান। তিনি বলেন, জেলায় আহত ১৮৫ জনের মধ্যে ১৫৭ জনকে এরইমধ্যে স্বাস্থ্যকার্ড দেওয়া হয়েছে। এই কার্ডে দেশের যেকোনো সরকারি হাসপাতালে ফ্রি চিকিৎসা ও টেস্ট করানো যাবে। বাকি কার্ডগুলোও দ্রুত বিতরণ করা হবে।
এ বিষয়ে পটুয়াখালী জেলা প্রশাসক আবু হাসনাত মোহাম্মদ আরেফীন জাগো নিউজকে বলেন, ‘পটুয়াখালীতে সরকারি গেজেটভুক্ত যে ২৫টি শহীদ পরিবার রয়েছে, তাদের আমরা এরইমধ্যে ১০ লাখ টাকা করে সঞ্চয়পত্র দিয়েছি। তাদের নিয়ে সামনে সরকারের অনেক বড় পরিকল্পনা রয়েছে। সরকারের দিকনির্দেশনা পেলেই আমরা সেগুলো বাস্তবায়ন করবো।’
ডিসি আরও বলেন, ‘যারা আহত হয়েছেন তাদের সমাজসেবার মাধ্যমে আমরা বিভিন্ন প্রশিক্ষণ দিচ্ছি, যাতে করে তারা কর্মসংস্থানের সুযোগ পান। খুবই সামান্য সুদে তাদের ঋণ দেওয়া হবে।’
এসআর/জেআইএম