দেশজুড়ে

খানাখন্দে ভরা মহাসড়ক যেন মাটি-কাদার ভাগাড়

খানাখন্দে ভরা মহাসড়ক যেন মাটি-কাদার ভাগাড়

দেখে মনে হতে পারে, এটি রোপণের অপেক্ষায় থাকা আমনের ক্ষেত অথবা কোনো মাটি-কাদার ভাগাড়। কিন্তু আদতে তা নয়, এটি দেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ চলাচল পথ যশোর-খুলনা মহাসড়ক। সড়কটির কোথাও বিরাট গর্তে জমে আছে নোংরা পানি। কোথাও হাঁটু সমান কাদায় একাকার। আর এই সড়ক দিয়ে মৃত্যুঝুঁকি নিয়ে প্রতিদিন চলাচল করছে হাজার হাজার যানবাহন।

Advertisement

জানা যায়, যশোর-খুলনা মহাসড়কের বসুন্দিয়া থেকে চেঙ্গুটিয়া পর্যন্ত পাঁচ কিলোমিটার অংশ যান চলাচলের জন্য চরম ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে। টানা বৃষ্টিতে এই মহাসড়কে তৈরি হয়েছে বড় বড় গর্ত। পিচ উঠে কোথাও কোথাও হাঁটু সমান কাদা। ফলে সড়কে যান চলাচল সীমিত হয়ে পড়েছে। দুই প্রান্তে প্রায় সবসময়ই দেখা যাচ্ছে দীর্ঘ যানজট।

স্থানীয়রা বলছেন, শত শত গর্ত আর কাদা মিলে বৃষ্টির পর এই সড়ক যেন মৃত্যুফাঁদে পরিণত হয়।

সড়ক বিভাগ বলছে, সংস্কার কাজ চলমান, শেষ হতে দেড় বছর সময় লাগতে পারে।

Advertisement

সূত্র জানায়, যশোর-খুলনা মহাসড়কটি দেশের একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও ব্যস্ততম সড়ক। এটি দেশের বৃহত্তম স্থলবন্দর বেনাপোল, যশোরের নওয়াপাড়া নদীবন্দর, মোংলা বন্দর এবং ভোমরা স্থলবন্দরের সঙ্গে যোগাযোগের প্রধান রুট হিসেবে কাজ করে। প্রতিদিন ২৪ ঘণ্টায় হাজার হাজার পণ্যবাহী ছোট-বড় যানবাহন এই সড়ক দিয়ে চলাচল করে। সরকার ২০১৭ সালে সড়কটি সম্প্রসারণ ও পুনঃনির্মাণের উদ্যোগ নেয়। যদিও কাজের মেয়াদ কয়েক দফা বাড়িয়ে ২০২৩ সালে সম্পন্ন হয়। কিন্তু কাজ শেষ হতে না হতেই কয়েক মাসের মধ্যে সড়কের বিভিন্ন অংশ ভেঙে পড়ে। এরপর থেকে লাগাতার সংস্কারকাজ চালানো হলেও তা খুব একটা কার্যকর হয়নি।

স্থানীয় বাসিন্দা ও ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, চলাচলে এই দুর্ভোগের কারণে নওয়াপাড়া নৌবন্দর কেন্দ্রিক ব্যবসা-বাণিজ্যে স্থবিরতা নেমে এসেছে। বিশেষ করে ভরা মৌসুমে সার সরবরাহ ব্যাহত হওয়ায় কৃষকেরাও বিপাকে পড়ছেন।

সড়ক ও জনপথ বিভাগ জানায়, যশোর-খুলনা মহাসড়কের বিভিন্ন অংশে ঢালাই রাস্তা নির্মাণের কাজ চলমান রয়েছে। আশা করা যাচ্ছে কাজ শেষ হলে সমস্যার স্থায়ী সমাধান মিলবে। যশোর শহরের পালবাড়ি মোড় থেকে অভয়নগরের রাজঘাট পর্যন্ত ৩৮ কিলোমিটার মহাসড়ক নির্মাণে এরই মধ্যে ৩২১ কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে। নতুন করে আরও ১৭২ কোটি টাকার কাজ চলমান রয়েছে।

যশোর-খুলনা মহাসড়ক সংলগ্ন প্রেমবাগ এলাকার বাসিন্দা আব্দুস সবুর জানান, এ মহাসড়কের পাশেই আমাদের গ্রাম। এই সড়ক ব্যবহার করে আমরা যাতায়াত করি। এখানে দিনরাত ২৪ ঘণ্টা যানবাহন চলাচল করে। গত ৩-৪ বছর ধরে সড়কটি উন্নয়নের কাজ চলমান রয়েছে। তবে একদিকে সংস্কারের কাজ শেষ হতে না হতেই অন্যদিকে সড়ক আবার নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। সম্পূর্ণ সংস্কার না হওয়ায় এলাকাবাসী অনেক কষ্ট পাচ্ছে। সামনে চেঙ্গুটিয়া বাজারে তিনটি স্কুল ও কলেজ রয়েছে। সড়কের হাঁটু সমান কাদার কারণে শিক্ষার্থীদের যাতায়াতের সমস্যা হচ্ছে এবং যানবাহন চলাচলও ব্যাহত হচ্ছে। প্রতিদিন শতশত গাড়ি যানজটে দুর্ভোগ পোহাচ্ছে।

Advertisement

এই মহাসড়কে যাত্রীবাহী বাসের চালক আব্দুল মালেক বলেন, রূপদিয়া থেকে নওয়াপাড়া পর্যন্ত সড়কটি খানাখন্দে ভরা। বিশেষ করে চেঙ্গুটিয়া থেকে বসুন্দিয়া পর্যন্ত অংশটি একেবারেই চলাচলের অযোগ্য হয়ে পড়েছে। রাস্তায় হাঁটু কাদা সৃষ্টি হওয়ায় গাড়ি নিয়ে চলাচল করা কঠিন হচ্ছে। অনেক গাড়ির এক্সেল ভেঙে আটকে যাচ্ছে। গাড়ি উল্টে রাস্তার পাশে পড়ে যাচ্ছে। প্রতিদিন বাস ও ট্রাক ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এই সড়কে ট্রিপ নিলে জ্যামে দুই-তিন দিন আটকে থাকতে হয়। ফলে আমরা অনেক সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছি।

আরেক ট্রাকচালক সাইদুল ইসলাম বলেন, সড়কের বেহাল দশার কারণে ট্রাকের স্প্রিং ভেঙে কাদায় আটকে পড়েছিল। পরের দিন দুপুর ২টা পর্যন্ত গাড়ি সরানো সম্ভব হয়নি। সড়কের এই অবস্থার কারণে সবাইই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি।

নূর ইসলাম নামের এক স্থানীয় বাসিন্দা বলেন, এই মহাসড়কে ২০২২ সাল থেকে সংস্কার কাজ চলছে। সরকার এখানে কোটি কোটি টাকা খরচ করছে, কিন্তু সঠিকভাবে কাজ হয়নি। বরং দুর্নীতির কারণে সড়কটি সর্বত্র ভাঙ্গা খানাখন্দে ভরে গেছে। সড়কের আশপাশে অনেক শিল্প প্রতিষ্ঠান, স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসা থাকলেও মানুষের চলাচলে ব্যাপক সমস্যা তৈরি হয়েছে।

নওয়াপাড়া শিল্পনগরীর আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান নওয়াপাড়া গ্রুপের ম্যানেজার রাজু আহমেদ বলেন, নওয়াপাড়া শুধু একটি নৌবন্দর নয় এটি দেশের গুরুত্বপূর্ণ শিল্পনগরীও। এখানকার বন্দরের মাধ্যমে দেশের মোট চাহিদার প্রায় ৭০ শতাংশ আমদানিকৃত সার খালাস করে বিভিন্ন জেলায় সরবরাহ করা হয়। ভরা মৌসুমে যশোর-খুলনা মহাসড়কের বেহাল অবস্থার কারণে সার সরবরাহ এখন মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে। বিশেষ করে চেঙ্গুটিয়া থেকে বসুন্দিয়া পর্যন্ত ৫ কিলোমিটার রাস্তা এতটাই খারাপ যে ট্রাকগুলো লোড নিতেই চাইছে না। ফলে আমরা সার সরবরাহ করতে পারছি না। এতে শুধু ব্যবসায়ীরাই নয়, কৃষকরাও ক্ষতির মুখে পড়ছেন।

নওয়াপাড়া সার, সিমেন্ট ও খাদ্যশস্য ব্যবসায়ী সমিতির নেতা নূরে আলম বাবু বলেন, যশোর-খুলনা মহাসড়কের করুণ অবস্থা টানা বর্ষায় আরও ভয়াবহ হয়ে গেছে। রাস্তা এতটাই নষ্ট হয়েছে যে, এখন মালবাহী ট্রাকগুলো চলাচলই করতে পারছে না। ফলে নওয়াপাড়া নৌবন্দর কেন্দ্রিক ব্যবসা-বাণিজ্য প্রায় স্থবির হয়ে পড়েছে। এতে ব্যবসায়ীরা বড় ধরনের আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়ছেন। এই সড়ক দ্রুত সংস্কার করে চলাচলের উপযোগী না করলে সার ও খাদ্যশস্য সরবরাহ ব্যাহত হবে।

যশোর সড়ক ও জনপথ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী গোলাম কিবরিয়া জানান, এই মহাসড়কের মাটির গুণাগুণ খারাপ। আবার ওভারলোড যানবাহন চলাচলের কারণেও সড়ক দ্রুত নষ্ট হয়ে যায়। বুয়েটের পরামর্শে ঢালাই রাস্তা নির্মাণের কাজ চলছে। চার কিলোমিটার শেষ হয়েছে, ২.৩ কিলোমিটারের কাজ চলছে। আরও আট কিলোমিটার ঢালাই রাস্তা করা হবে। সব কাজ শেষ হতে দেড় বছর লাগবে। কাজ শেষ হলে সমস্যার স্থায়ী সমাধান মিলবে।

মিলন রহমান/এমএন/এমএস