দেশের বাজারে বিক্রি হওয়া শিশুদের প্লাস্টিকের খেলনার ৭০ শতাংশেই অতিমাত্রায় বিষাক্ত ভারী ধাতু পাওয়া গেছে। সিসা, পারদ, ক্যাডমিয়াম ও ক্রোমিয়ামের মতো স্বাস্থ্যঝুঁকিপূর্ণ উপাদান রয়েছে এসব খেলনায়। এগুলোর মাত্রা আন্তর্জাতিক নিরাপদ সীমার চেয়ে ১০ থেকে ৭০ গুণ পর্যন্ত বেশি।
Advertisement
বৃহস্পতিবার (১৭ জুলাই) এক প্রেস ব্রিফিংয়ে এসব তথ্য প্রকাশ করে পরিবেশ ও সামাজিক উন্নয়নমূলক সংগঠন এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট (এসডো)। ‘টক্সিক প্লে-টাইম: আনকভারিং হেভি মেটালস ইন চিলড্রেনস প্লাস্টিক টয়েজ’ শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদনে উঠে আসে এসব তথ্য। ঢাকায় এসডোর কার্যালয়ে এই প্রেস ব্রিফিংয়ের আয়োজন করা হয়।
গবেষণায় ফিলিপাইনভিত্তিক সংস্থা ব্যান টক্সিক্সের উন্নত এক্স-রে ফ্লুরোসেন্স প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়েছে।
এসডো জানিয়েছে, গবেষণাটি কেন্দ্রীভূত ছিল বিশেষভাবে শূন্য থেকে পাঁচ বছর বয়সী শিশুদের জন্য তৈরি খেলনার ওপর। কারণ এই বয়সী শিশুদের দাঁত গজানোর সময় মুখে খেলনা দেওয়ার প্রবণতা বেশি এবং তাদের দেহে রাসায়নিকের প্রতি সংবেদনশীলতা সবচেয়ে বেশি হয়।
Advertisement
মোট ৭০টি কঠিন প্লাস্টিকের খেলনা নমুনা হিসেবে সংগ্রহ করা হয়। মূলত লাল, হলুদ, কমলা রঙের খেলনায় জোর দেওয়া হয়। কারণ আগের গবেষণাগুলোতে দেখা গেছে, এসব রঙে বিষাক্ত রঞ্জকের উপস্থিতি বেশি। নমুনাগুলো দেশের বৃহত্তম খেলনা বাজার ঢাকার চকবাজার থেকে সংগ্রহ করা হয়। যার মধ্যে ছিল ১৮টি স্থানীয় ব্র্যান্ড (৩-৫টি নমুনা করে), দুটি চীনা ব্র্যান্ড (৩টি করে নমুনা) ও পাঁচটি নামবিহীন খেলনা।
গবেষণা তথ্য ও ফলাফল উপস্থাপন করে এসডোর রিসার্চ অ্যান্ড ক্যাম্পেইন অ্যাসোসিয়েট নওশিন নায়লা বলেন, সংগৃহীত নমুনার মধ্যে ৭০ শতাংশ খেলনায় অতিমাত্রায় ভারী ধাতু—বিশেষত ক্রোমিয়াম ও অ্যান্টিমনি পাওয়া গেছে। কিছু খেলনায় নিরাপদ মাত্রার তুলনায় ১০ থেকে ৭০ গুণ বেশি ভারী ধাতু পাওয়া গেছে। যেমন— ক্রোমিয়াম ৪৩০০ পিপিএম (সীমা ৬০ পিপিএম), সিসা ২৩৫০ পিপিএম (সীমা ৯০ পিপিএম), পারদ ১০৮০ পিপিএম (সীমা ৬০ পিপিএম) ও ক্যাডমিয়াম ৬৪০ পিপিএম (সীমা ৭৫ পিপিএম)।
প্লাস্টিকের খেলনা নিয়ে বৃহস্পতিবার গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করে এসডো। ছবি: জাগো নিউজ
এছাড়া আমান টয় গার্ডেনের প্রস্তুত করা একটি নীল রঙের খেলনা গাড়িতে নিরাপদ সীমার ২৬ গুণ বা ২ হাজার ৩৫০ পিপিএম সিসা পাওয়া গেছে। পারদ নিরাপদ সীমার ১৮ গুণ (১,০৮০ পিপিএম) ও ক্রোমিয়াম ২৩ গুণ বেশি (১,৪০০ পিপিএম) পাওয়া গেছে।
Advertisement
গবেষণায় আরও দেখা গেছে, উজ্জ্বল রঙের কিছু খেলনা রয়েছে যেগুলো শিশুদের বেশি আকর্ষণ করে, সেগুলোতে সর্বোচ্চ মাত্রায় ভারী ধাতু পাওয়া গেছে। এসব উজ্জ্বল রঙের ২০ শতাংশ খেলনায় বিপজ্জনক মাত্রায় ক্লোরিন ও ব্রোমিন রয়েছে, যা পিভিসি প্লাস্টিক ও ফ্লেম রিটার্ডেন্ট উপকরণ ব্যবহারের প্রমাণ দেয়।
বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য, আমান টয় গার্ডেন, খোকন প্লাস্টিক প্রোডাক্টস ও শাহজালাল টয়স গ্যালারি—এই তিনটি স্থানীয় প্রস্তুতকারকের ১০০ শতাংশ খেলনাই নিরাপদ সীমা অতিক্রম করেছে।
এসডো জানিয়েছে, বাংলাদেশে খেলনার জন্য কোনো বাধ্যতামূলক রাসায়নিক নিরাপত্তা আইন নেই। নেই লেবেলিং, পরীক্ষার বাধ্যবাধকতা কিংবা রিকল (প্রত্যাহার) ব্যবস্থা। অনেক খেলনা তৈরি হচ্ছে পুনর্ব্যবহৃত প্লাস্টিক দিয়ে, যেগুলো আসছে ই-ওয়েস্ট ও শিল্প বর্জ্য থেকে।
একইভাবে চীন ও ভারতের মতো দেশ থেকে আসা খেলনার সঙ্গেও থাকে না কোনো রাসায়নিক নিরাপত্তা রিপোর্ট বা ট্রেসেবিলিটি।
শিশুদের যে স্বাস্থ্যগত ঝুঁকিএই খেলনাগুলো ব্যবহার ও মুখে দেওয়ার মাধ্যমে শিশুদের বুদ্ধিমত্তার ক্ষয়, কথা বলা ও শেখার দেরি, কিডনি রোগ, আচরণগত সমস্যা ও মনোযোগের ঘাটতি এবং ক্যানসারের দীর্ঘমেয়াদি ঝুঁকি বাড়ে বলে গবেষণা প্রতিবেদনে জানানো হয়। এছাড়া এই খেলনাগুলোর বর্জ্য খাবারের মাধ্যমে মানবদেহে প্রবেশ করতে পারে এবং এতে থাকা সিসা বাতাসে ছড়িয়ে মানবদেহে প্রবেশ করছে বলে জানানো হয়।
যা বলছেন বিশ্লেষকরাপ্রেস ব্রিফিংয়ে সাবেক সচিব ও এসডোর চেয়ারপারসন সৈয়দ মার্গুব মুর্শেদ বলেন, ‘একটি জাতি হিসেবে আমরা আমাদের শিশুদের স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে ফেলতে পারি না। এ ফলাফল আমাদের ব্যর্থতা নগ্নভাবে প্রকাশ করে। সরকারকে অবিলম্বে কঠোর নিরাপত্তা মানদণ্ড বাস্তবায়ন করতে হবে এবং উৎপাদনকারীদের জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে। নিরাপদ খেলনা কোনো বিলাসিতা নয়, এটি প্রতিটি শিশুর মৌলিক অধিকার।’
প্লাস্টিকের খেলনা নিয়ে বৃহস্পতিবার গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করে এসডো। ছবি: জাগো নিউজ
‘আমাদের এ ব্যাপারে খুবই শক্ত পদক্ষেপ নিতে হবে। ছোট বাচ্চাদের তো খেলনা দিতে হবে, কিন্তু সেটাতে বিষ থাকলে এটা তাদের মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর।’ যোগ করেন মার্গুব মুর্শেদ।
এসডোর সিনিয়র টেকনিক্যাল অ্যাডভাইজার ড. শাহরিয়ার হোসেন বলেন, ‘খেলনা শিশুদের বুদ্ধি বিকাশের জন্য অপরিহার্য। কিন্তু আমরা গভীর উদ্বেগের সঙ্গে দেখছি যে সেগুলোতে ভারী ধাতু ও রাসায়নিকের ব্যবহার অনেক বেশি। আমরা খেলনা নিষিদ্ধ করতে পারি না বা শিশুদের খেলনা থেকে দূরে রাখতে পারি না। খেলনা আনন্দ নিয়ে আসে এবং একটি সুখী শৈশবের জন্য প্রয়োজন। আমাদের অবশ্যই অবিলম্বে পদক্ষেপ নিতে হবে যাতে এ খেলনাগুলো বিষমুক্ত হয় এবং আমাদের শিশুদের জন্য একটি নিরাপদ ভবিষ্যৎ নিশ্চিত হয়।’
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মো. আবুল হাশেম বলেন, ‘এ গবেষণা আমাদের সবচেয়ে খারাপ শঙ্কাকেই সত্য প্রমাণ করেছে। শিশুরা প্রতিদিন খেলনার মাধ্যমে নিউরোটক্সিন ও কার্সিনোজেনের মিশ্রণের সংস্পর্শে আসছে। এ ধরনের উচ্চমাত্রার ভারী ধাতু শিশুদের বিকাশকে ক্ষতি করেছে।’
এসডোর নির্বাহী পরিচালক সিদ্দীকা সুলতানা বলেন, ‘এটি শুধু একটি স্বাস্থ্য সংকট নয়, এটি শিশুদের মৌলিক অধিকারের লঙ্ঘন। আমরা ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে রক্ষার জন্য সরকারের কাছে কঠোর নিয়ন্ত্রণ নীতিমালার দাবি জানাচ্ছি।’
প্রেস ব্রিফিংয়ে বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশনের (বিএসটিআই) কর্মকর্তা মনজুরুল করিম বলেন, ‘আমরা এই উদ্বেগজনক ফলাফলগুলো স্বীকার করছি। আমাদের খেলনা টেস্টের স্ট্যান্ডার্ড তৈরি হয়েছে। মান তৈরির ক্ষেত্রে আমরা চারটা প্যারামিটার তৈরি করেছি। এসব পণ্য টেস্ট করারও সক্ষমতা আমাদের রয়েছে।
এ সময় এসডোর পক্ষ থেকে বাজারে বিষমুক্ত খেলনা নিশ্চিত করতে কিছু সুপারিশ তুলে ধরা হয়।
১. ভারী ধাতুর সীমা নির্ধারণ করে খেলনার মান নিয়ন্ত্রণে নীতিমালা প্রণয়ন করতে হবে।
২. পণ্য পরীক্ষাকে বাধ্যতামূলক করা ও লেবেলিং নিশ্চিত করতে হবে।
৩. পরিবেশ অধিদপ্তর, শিল্প মন্ত্রণালয়, বিএসটিআইসহ সব সংস্থাকে সমন্বিত হয়ে কাজ করতে হবে।
৪. ভোক্তা সতর্কতা ব্যবস্থা ও প্রস্তুতকারীদের জবাবদিহিতার আওতায় আনতে হবে।
৫. সব শ্রেণির মানুষের জন্য স্বাস্থ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে।
বাজারে যেমন নিম্নমানের ও বিষাক্ত উপাদানে তৈরি খেলনা পাওয়া যাচ্ছে, তেমনই কিছু স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠানও রয়েছে, যারা স্বাস্থ্যসম্মত ও নিরাপদ খেলনা বাজারজাত করছে। এসব প্রতিষ্ঠান আন্তর্জাতিক মান বজায় রেখে খেলনার কাঁচামাল নির্বাচন করে। তাদের উৎপাদিত পণ্যে ভারী ধাতু বা ক্ষতিকর রাসায়নিক থাকে না। ফলে শিশুদের জন্য তুলনামূলক নিরাপদ এই খেলনাগুলো দিন দিন জনপ্রিয় হয়ে উঠছে।
এ বিষয়ে জানতে চাওয়া হয় আরএফএল হাউজওয়্যারের হেড অব মার্কেটিং ইশফাকুল হকের কাছে। জাগো নিউজকে তিনি বলেন, ‘আমাদের দুটি ব্র্যান্ডের খেলনা রয়েছে- প্লে-টাইম ও জিম অ্যান্ড জলি। দুটিই আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা সীমা যাচাই করে বিশ্বের ৪০টির বেশি দেশে রপ্তানি করা হয়। এসব খেলনা এক্সপোর্টের জন্য বিভিন্ন কমপ্লায়েন্স সার্টিফিকেট প্রয়োজন হয়। আমাদের প্রতিটি প্রোডাক্ট সীসা ও লেডমুক্ত।’
ইশফাকুল হক আরও বলেন, ‘বাজারে ছাড়ার আগে আমরা ক্লিনিক্যাল টেস্ট করি, যাতে ক্ষতিকর কোনো পদার্থ না থাকে। যেহেতু এটা শিশুদের পণ্য এবং তারা মুখে দিতে পারে, তাই আমরা সর্বোচ্চ সতর্কতা মেনে খেলনা তৈরি করি। আমাদের খেলনাগুলো এক থেকে ৮ বছর বয়সী শিশুদের উপযোগী এবং থার্ড পার্টি অডিটের পরই রপ্তানির অনুমতি দেওয়া হয়।’
আরএএস/এমএমএআর/জেআইএম