ময়মনসিংহের সর্বদক্ষিণের লাল মাটির উঁচু এলাকা ভালুকা। এই উপজেলায় এবার প্রচুর কাঁঠাল উৎপাদন হয়েছে। স্বাদে-গন্ধে আলাদা, রসে টইটম্বুর মিষ্টি এসব কাঁঠাল বিক্রি হচ্ছে একেবারেই সস্তায়। পাইকাররা ঠিকই এসব কাঁঠাল সস্তায় কিনে বিক্রি করছেন লাভে। তবে আশানুরূপ লাভ করতে পারছেন না কৃষকসহ ব্যবসায়ীরা। কারণ, প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানা না থাকায় সংরক্ষণের অভাবে পচে নষ্ট হচ্ছে বিপুল পরিমাণ কাঁঠাল।
Advertisement
স্থানীয়রা জানান, উপজেলার সিডস্টোর বাসস্ট্যান্ড, আংগারগাড়া বাজার, উথুরা মাহার বাজার, বাটাজোর, কাচিনা, ভালুকা পুরোনো বাসস্ট্যান্ড, মল্লিকবাড়ি, চমিয়াদী, রাজৈ, পনাশাইল, কেয়াদী, ভরাডোবা বাসস্ট্যান্ড, পারুলদিয়া, আশকা, মাস্টারবাড়িসহ বিভিন্ন এলাকায় কাঁঠালের হাট বসেছে। প্রতিদিন বিভিন্ন এলাকা থেকে ঠেলাগাড়ি, রিকশা, অটোরিকশা, গরু-মহিষের গাড়ি, পিকআপসহ বিভিন্ন বাহনে কাঁঠাল নিয়ে আসছেন চাষিরা। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত কৃষক, আড়তদার ও রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলা-উপজেলা থেকে ছুটে আসা পাইকারদের মধ্যে চলছে বেচাকেনা। তবে ভালুকায় কোনো হিমঘর বা ফল সংরক্ষণের ব্যবস্থা না থাকায় বিপাকে পড়েছেন কৃষক ও ব্যবসায়ীরা।
‘ভালুকার সিডস্টোর বাজারে প্রতিদিন অর্ধকোটি টাকার কাঁঠাল বিক্রি হয়। তবে সংরক্ষণের অভাবে প্রতিবছর এলাকার লাখ লাখ টাকার কাঁঠাল পচে নষ্ট হচ্ছে। একটি প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানা স্থাপন করলে কাঁঠাল অনেকদিন সংরক্ষণ করে রাখা যেতো। ফলে স্থানীয় কৃষক ও আড়তদাররা ন্যায্য দাম পেতেন।’
সরেজমিন বেশ কয়েকটি বাজারে দেখা যায়, চাষিদের কেউ অটোরিকশায়, কেউ ভ্যানে, আবার কেউ পিকআপে করে কাঁঠাল নিয়ে বাজারের আড়তদারের কাছে এসেছেন। আড়তদাররা ছোট-বড় কাঁঠালগুলো আলাদা করে বিভিন্ন দামে কিনছেন। এরপর স্থানীয় পাইকাররাসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা পাইকাররা সস্তায় ট্রাক ভর্তি করে এসব কাঁঠাল নিয়ে যাচ্ছেন। যথাযথভাবে সংরক্ষণের অভাবে অনেক কাঁঠাল পচে গেছে। অনেকগুলো পচে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে।
Advertisement
উপজেলার সিডস্টোর বাজারে কাঁঠাল বিক্রির সময় কথা হয় স্থানীয় কৃষক জহিরুল ইসলামের সঙ্গে। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘কাঁঠাল গাছের খুব একটা যত্ন করি না। তবুও আমার ২৪টি গাছে প্রচুর কাঁঠাল ধরেছে। বেশিরভাগ গাছের কাঁঠাল পেকে যাওয়ায় পাইকারদের কাছে বিক্রি করেছি। কারণ, সংরক্ষণ করতে না পারায় কাঁঠাল পচে যাচ্ছে।’
আরও পড়ুন:
কেঁচো সারে স্বাবলম্বী মাদারীপুরের রাশিদা ঝিনাইদহে বিদেশি ফল চাষে সম্ভাবনা, আগ্রহী কৃষকেরা ধান-গমের জমিতে চাষ হচ্ছে আম-লিচু-ড্রাগন মেহেরপুরে মিয়াজাকি আম চাষ, বিশ্বে কেজি ২ লাখ টাকাআফসার আলী নামের আরেকজন বলেন, ‘গত তিনদিনে ২৬০ পিস কাঁঠাল বিক্রি করেছি। আড়তদার কিংবা পাইকাররা যে দাম দেন তাই নিতে হচ্ছে। এতে কাঁঠাল চাষিসহ ক্রেতারা ঠকলেও লাভবান হচ্ছে আড়তদারসহ পাইকাররা।’
‘আমরা চেষ্টা করছি কীভাবে কাঁঠাল দিয়ে বিভিন্ন ধরনের পণ্য যেমন-জেলি, চিপস তৈরি করা যায়। এতে কৃষকরা কাঁঠালের বাড়তি দাম পাবেন। অনেকে বাণিজ্যিকভাবে কাঁঠাল উৎপাদনে আগ্রহী হবেন।’
Advertisement
সরকারি উদ্যোগে কাঁঠালের প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানা গড়ে তোলার দাবি জানিয়ে সিডস্টোর এলাকার বাসিন্দা শিক্ষক জসিম উদ্দিন বলেন, ‘দ্রুত পচনশীল সুস্বাদু এ ফলের সংরক্ষণের ব্যবস্থা না থাকায় বাধ্য হয়ে খুবই কম দামে বিক্রি করছেন চাষিরা। উপজেলায় একটি কাঁঠাল প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানা হলে উৎপাদনকারীরা কাঁঠালের ন্যায্য দাম পেতেন। এতে ক্রেতা-বিক্রেতা উভয়ই লাভবান হতেন। অনেকে বাণিজ্যিকভাবে কাঁঠাল উৎপাদনে আগ্রহী হতেন।’
সিডস্টোর বাজারের আড়তদার তোফায়েল ইবনে জামাল। তিনি বলেন, এই উপজেলায় উৎপাদিত কাঁঠাল ঢাকা, কুমিল্লা, সিলেট, নোয়াখালী, পটুয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, মুন্সিগঞ্জ, সুনামগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, কিশোরগঞ্জের পাইকারদের কাছে বিক্রি করা হচ্ছে। দীর্ঘ ২৭ বছর ধরে কাঁঠাল বেচাকেনা করছি। প্রতি মৌসুমে দুই থেকে আড়াই লক্ষাধিক পিস কাঁঠাল বিক্রি করেছি। এবারও এই লক্ষ্য পূরণ হবে বলে মনে হচ্ছে।
উৎপাদনকারীদের কাছ থেকে কম দামে কিনে অন্য পাইকারদের কাছে বেশি দামে বিক্রি করা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘কাঁঠাল কাঁচা অবস্থায় কেনার কিছুদিনের মধ্যেই পেকে যায়। পরে পাকাগুলো কিছুদিন রাখলেই পচন ধরে। তাই কৃষকদের কাছ থেকে কম দামে কেনা হয়। কাঁঠালগুলো পেকে যাওয়ার আগেই দূর-দূরান্ত থেকে আসা পাইকারদের কাছে কিছুটা লাভে বিক্রি করছি।’
মোহাম্মদ হাবিবুর রহমান হাবি নামের আরেকজন আড়তদার বলেন, ‘এ বাজারে প্রতিদিন অর্ধকোটি টাকার কাঁঠাল বিক্রি হয়। তবে সংরক্ষণের অভাবে প্রতিবছর এলাকার লাখ লাখ টাকার কাঁঠাল পচে নষ্ট হচ্ছে। একটি প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানা স্থাপন করলে কাঁঠাল অনেকদিন সংরক্ষণ করে রাখা যেতো। ফলে স্থানীয় কৃষক ও আড়তদাররা ন্যায্য দাম পেতেন।’
আরও পড়ুন:
খেজুরের বীজ থেকে শাহিনের অভিনব ‘কফি’ উদ্ভাবন হাঁস পালনে নারীদের রোল মডেল খোকসার শিরিনা শস্যের নামকরণে বিদেশি শব্দের আধিক্য কেন? বাণিজ্যিক পান চাষে আগ্রহ হারাচ্ছেন কৃষকেরাসিলেট থেকে আসা পাইকার মো. খোরশেদুল্লাহ বলেন, ‘এই উপজেলার লাল মাটিতে উৎপাদিত কাঁঠালগুলোর স্বাদ অনেক ভালো। রসে টইটম্বুর মিষ্টি এসব কাঁঠালের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। তাই এখান থেকে প্রতি সপ্তাহে ৫-৬ ট্রাক কাঁঠাল নিয়ে বিক্রি করছি। তবে ট্রাক দিয়ে কাঁঠাল আনা-নেওয়ার খরচসহ শ্রমিকদের খরচ বাদ দিলে খুব বেশি লাভ করা সম্ভব হয় না।’
স্থানীয় কৃষি বিভাগ সূত্রে জানা যায়, এবছর ময়মনসিংহে দুই হাজার ৩২৪ হেক্টর জমিতে কাঁঠাল আবাদ হয়েছে। এতে উৎপাদন হয়েছে এক লাখ ৮৫ হাজার ৯৬০ মেট্রিক টন। এরমধ্যে ভালুকায় ৩৮৫ হেক্টর জমিতে কাঁঠাল আবাদ হয়েছে। উৎপাদন হয়েছে ৪৩ হাজার ৯০০ মেট্রিক টন। লাল মাটি হওয়ায় স্বাদে-গন্ধে অনন্য এ উপজেলার কাঁঠাল।
‘সুস্বাদু এ ফলটি দ্রুত পচনশীল হওয়ায় ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন চাষিরা। সরকারি উদ্যোগে কাঁঠালের প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানা গড়ে উঠলে উৎপাদনকারীরা ন্যায্য মূল্য পাবেন। পাশাপাশি সুস্বাদু এ ফলটি দীর্ঘদিন সংরক্ষণ করা যাবে। আমরা বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের অবগত করেছি।’
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা নুসরাত জামান বলেন, ‘আমরা চেষ্টা করছি কীভাবে কাঁঠাল দিয়ে বিভিন্ন ধরনের পণ্য যেমন-জেলি, চিপস তৈরি করা যায়। এতে কৃষকরা কাঁঠালের বাড়তি দাম পাবেন। অনেকে বাণিজ্যিকভাবে কাঁঠাল উৎপাদনে আগ্রহী হবেন।’
এ বিষয়ে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর ময়মনসিংহের উপপরিচালক ড. নাছরিন আক্তার বানু জাগো নিউজকে বলেন, পাইকাররা যেভাবে দাম নির্ধারণ করেন, সে দামেই বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন কাঁঠাল উৎপাদনকারীরা। সুস্বাদু এ ফলটি দ্রুত পচনশীল হওয়ায় ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন তারা। সরকারি উদ্যোগে কাঁঠালের প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানা গড়ে উঠলে উৎপাদনকারীরা ন্যায্য মূল্য পাবেন। পাশাপাশি সুস্বাদু এ ফলটি দীর্ঘদিন সংরক্ষণ করা যাবে। আমরা বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের অবগত করেছি।
এমডিকেএমএসআর/এমএস