মহাকাশে নভোচারীদের আনাগোনা লেগেই থাকে। কেউ থাকেন কয়েকদিন কেউবা কয়েকমাস। কিছুদিন আগেই ভারতীয় বংশোদ্ভূত সুনীতা উইলিয়ামস দীর্ঘ ৯ মাস ১৩ দিন মহাকাশে কাটিয়ে পৃথিবীতে ফিরেছিলেন। সুনীতা উইলিয়ামস জানিয়েছিলেন যে এত দীর্ঘ সময় মহাকাশে থাকার কারণে তিনি হাঁটতে, বসতে এমনকি ঘুমাতেও ভুলে গিয়েছিলেন।
Advertisement
মানুষের শরীর পৃথিবীর অভিকর্ষবলয়ের সঙ্গে মানানসইভাবে গঠিত। তাই যখন মহাকাশচারীরা দীর্ঘ সময় ধরে মাইক্রোগ্রাভিটি পরিবেশে থাকেন, তখন তাদের শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের উপর ইনক্লুডিং মস্তিষ্ক গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব পড়ে। সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে, মহাকাশে দীর্ঘসময় কাটালে মস্তিষ্কে কাঠামোগত ও কার্যক্ষম পরিবর্তন দেখা দেয়।
২০২২ সালে প্রকাশিত এক গবেষণা (জামা নিউরোলোজি) অনুযায়ী, ৬ মাসের বেশি সময় মহাকাশে কাটানো মহাকাশচারীদের মস্তিষ্কের ভেন্ট্রিকল ১৫-২৫ শতাংশ পর্যন্ত বড় হয়। নাসা হিউম্যান রিসার্চ প্রোগ্রাম নিয়মিতভাবে জ্ঞানীয় ও স্নায়বিক পরীক্ষা চালিয়ে যাচ্ছে দীর্ঘমেয়াদী মহাকাশ যাত্রার প্রভাব মূল্যায়নের জন্য। রাশিয়ার মহাকাশচারীদের উপর করা দীর্ঘ গবেষণায়ও একই ধরনের ফলাফল পাওয়া গেছে।
আসুন জেনে নেওয়া যাক মহাকাশে দীর্ঘসময় কাটালে মহাকাশচারীদের মস্তিষ্কে কী ধরনের প্রভাব পড়ে-
Advertisement
মস্তিষ্কে তরল জমাটপৃথিবীতে থাকা অবস্থায় শরীরের রক্ত ও তরল পদার্থ নিচের দিকে নেমে থাকে অভিকর্ষের কারণে। কিন্তু মহাকাশে অভিকর্ষ না থাকায় এসব তরল মস্তিষ্ক ও মাথার দিকে উঠে যায়। এতে মস্তিষ্কের চারপাশে তরলের চাপ বাড়ে। চোখের পেছনে চাপ সৃষ্টি হয় (যা দৃষ্টিশক্তি কমাতে পারে)। মাথাব্যথা বা ভারী অনুভূতি হতে পারে
মস্তিষ্কের গঠনগত পরিবর্তনএমআরআই ও নিউরোইমেজিংয়ের মাধ্যমে দেখা গেছে, দীর্ঘ সময় মহাকাশে অবস্থান করলে মস্তিষ্কের গ্রে ম্যাটার ও হোয়াইট ম্যাটারে পরিবর্তন ঘটে। মস্তিষ্ক কিছুটা উপরের দিকে সরে যায়। মস্তিষ্কের ভেন্ট্রিকল (ভেতরের ফাঁকা অংশ যেখানে তরল থাকে) প্রসারিত হয়। বিশেষ করে ভেন্ট্রিকুলার এনলার্জমেন্ট দীর্ঘ সময় মহাকাশে থাকাদের ক্ষেত্রে বেশি দেখা যায়।
জ্ঞান, স্মৃতি ও মনঃসংযোগে সমস্যাযেহেতু মস্তিষ্কের গঠন ও স্নায়ুবিক যোগাযোগে পরিবর্তন আসে, তাই মনঃসংযোগে সমস্যা হতে পারে। তথ্য মনে রাখার দক্ষতা কমে যেতে পারে, প্রতিক্রিয়া সময় ধীর হতে পারে, কিছু ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত নিতে সমস্যা হতে পারে। নাসা ও ইএসএ-এর রিপোর্ট অনুযায়ী, মহাকাশচারীদের জ্ঞানীয় কর্মক্ষমতা নিয়মিত মনিটর করা হয় এই কারণে।
মানসিক স্বাস্থ্য ও আবেগে প্রভাবদীর্ঘ সময় মহাকাশে থাকা মানে পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন থাকা, যা মানসিক দিক থেকেও চাপ সৃষ্টি করে। বিচ্ছিন্নতা ও একঘেয়েমি মানসিক চাপ সৃষ্টি করে, আলো ও রাতের চক্র অনিয়মিত হওয়ায় ঘুমের ব্যাঘাত ঘটে।ঘুম কম হলে মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতা কমে যায়, ফলে বিষণ্নতা বা উদ্বেগ তৈরি হতে পারে।
Advertisement
পুনরায় পৃথিবীতে ফিরে এসে সমস্যাযখন মহাকাশচারীরা পৃথিবীতে ফিরে আসেন, তখন শরীর আবার অভিকর্ষের সঙ্গে মানিয়ে নিতে সময় নেয়। মাথা ঘোরা বা ভারসাম্যহীনতা হয়। দাঁড়ালেই মাথা ঘোরে, কিছু ক্ষেত্রে চোখে ঝাপসা দেখা যায় বা মানসিক ধীরতা অনুভব করেন।
মহাকাশে দীর্ঘ সময় কাটানো মানব মস্তিষ্কের ওপর গভীর প্রভাব ফেলে। তবে এই প্রভাবগুলো বুঝে নিয়ে এবং গবেষণার মাধ্যমে প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব। ভবিষ্যতের মঙ্গল বা দূর-গ্রহ অভিযানে এই গবেষণা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, যাতে মহাকাশচারীরা শারীরিক ও মানসিকভাবে সুস্থ থেকে তাদের মিশন সম্পন্ন করতে পারেন।
আরও পড়ুন তুষারের শহর থেকে মহাকাশে লাইকা মানুষের জন্য ‘হিউম্যান ওয়াশিং মেশিন’ কীভাবে কাজ করবে?কেএসকে/এএসএম