ড্রোন শোতে জুলাইয়ের স্মৃতিচারণ ও জুলাই পুনর্জাগরণ উপলক্ষে চট্টগ্রামের কাজির দেউড়ি স্টেডিয়ামে প্রদর্শিত হয়েছে হাজারো ম্যাজিকেল ড্রোন শো। ড্রোন শোর মাধ্যমে তুলে ধরা হয়েছে আওয়ামী সরকারের আমলে গুম, খুন, শাপলা ম্যাসাকারসহ জুলাইয়ের সময়ের নানা স্লোগান তথা ‘আওয়াজ উড়া’, ‘চলে আসুন ষোলশহর’, ‘শাহাদাতের আকাঙ্ক্ষায় শান্ত’, ‘শহীদ নূর মোস্তফা’, ‘বউতদিন হাইয়ো, আর ন হাইয়ো’, ‘কথায় কথায় বাংলা ছাড়, বাংলা কি তোর বাপ দাদার’সহ নানান কিছু।
Advertisement
বুধবার (১৬ জুলাই) রাত ১১টা ১৫ মিনিটে প্রদর্শিত এসব ড্রোনের মাধ্যমে জুলাইয়ের গল্প ফুটে ওঠে। এর আগে জুলাই অভ্যুত্থানকে নিয়ে নির্মিত ‘জুলাই বিষাদ সিন্ধু’, ‘দীপক কুমার গোস্বামী স্পিকিং’ ও ‘জুলাই বীরগাথা’ প্রদর্শিত হয়। এসময় হাজারো দর্শক তা উপভোগ করেন।
জানা যায়, বিকেল থেকে স্টেডিয়াম প্রাঙ্গণে বানানো মঞ্চে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয়। একে একে গান পরিবেশন করেন বে অব বেঙ্গল, ব্যান্ডদল চিম্বুক, শিল্পী হান্নান ও মাশা, কণ্ঠশিল্পী পারসা মাহজাবীন ও ব্যান্ডদল শিরোনামহীন। গান পরিবেশনের এক ফাঁকে জুলাই আন্দোলনে শহীদ ফয়সাল আহমেদ শান্তর মা কহিনুর আক্তার ছেলের চলে যাওয়া নিয়ে স্মৃতিচারণ করেন।
শহীদ শান্তর মা বলেন, আমার ছেলে দেশের জন্য প্রাণ দিয়েছে। ছেলেকে এখন আর ফিরে পাবো না। কিন্তু আমার ছেলের হত্যাকারীদের বিচার যেন এ মাটিতে হয়।
Advertisement
তিনি বলেন, ওর টিউশনি ছিল বিকেল ৩টা থেকে। তবে আন্দোলনে যোগ দিতে এক ঘণ্টা আগেই সেই টিউশনি শেষ করে ছেলে। তারপর আমার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে যায় মুরাদপুরে। বলে যায় আমি সন্ধ্যায় আসবো। চা আর পরোটা বানিয়ে রেখো। কথামতো চা-পরোটা বানাচ্ছিলাম। এমন সময়ে পরিচিত একজন ফোন করে দ্রুত তৈরি হতে বলেন। জানান, শান্তর গায়ে গুলি লেগেছে, হাসপাতালে যেতে হবে।
তিনি আরও বলেন, তখনো জানতাম না ছেলে নাই। ভেবেছিলাম, হয়তো রাবার বুলেট শান্তর পায়ে লেগেছে। দ্রুতই চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আসি কিন্তু এসে কোনোমতেই ছেলের কাছে যেতে পারিনি। এক পুলিশ কর্মকর্তা এসে বারবার আমাকে জেরা করে নানান কিছু জেনে নেন। কিন্তু কোনোভাবেই আমার ছেলের হদিস দেন না। একপর্যায়ে পুলিশ আমাকে পাঁচলাইশ থানায় নিয়ে যায়। সেখানে বিভিন্ন কাগজে সই করতে বলে। তখনই বুঝতে পারি ময়নাতদন্তের জন্য অনুমতিপত্রে আমার সই নেওয়া হচ্ছে। বুকটা ভেঙে যায় আমার। জানতে পারি, আমার ছেলের পায়ে নয়, গুলি করা হয়েছে বুকে। এরপর আমি জ্ঞান হারাই। আমার ছেলে রক্তকে খুব ভয় পেতো। সে জন্য কোরবানিতে গরু জবাই করার সময় আমরা তাকে লুকিয়ে রাখতাম। বাসায় কখনো ওর ভয়ে মুরগি জবাই করতাম না। আমার সেই নিরীহ ছেলেটাকে গুলি করে রক্তাক্ত করা হলো।
শহীদ শান্তর মা বলেন, অনেক কাকুতি করলাম, শোনেনি। খুব ইচ্ছে ছিল শান্তর কবর হবে তারই প্রিয় চট্টগ্রাম শহরে। কিন্তু তখনকার প্রশাসন সেই অনুরোধ রাখেনি। এমনকি যে শহরের আলো-হাওয়ায় বেড়ে উঠেছে শান্ত, সেই শহরে তার জানাজাও পড়তে দেওয়া হয়নি।
তিনি আরও বলেন, আমার ছেলের মরদেহ পুলিশ প্রটোকল দিয়ে বরিশালের বাবুগঞ্জের গ্রামের বাড়িতে নিয়ে গেছে। আহ! এভাবে যদি বেঁচে থাকতে নিরাপত্তা দিতো, হাজারো মায়ের বুক খালি হতো না! এখন তো আর ছেলেকে পাবো না। শুধু একটাই চাওয়া– যে হাজারো ছাত্রজনতা প্রাণ দিলো, তাদের রক্তের বিনিময়ে যেন বাংলাদেশটা সুন্দরভাবে চলে।
Advertisement
অনুষ্ঠানে জুলাই আন্দোলনে শহীদ ফারুকের স্ত্রী, শহীদ ওয়াসিমের বাবাসহ শহীদ পরিবারের সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন। তারা শান্ত’র মায়ের মতো তাদের সন্তান হারানোর সেই কঠিন মুহূর্তের স্মৃতি তুলে ধরেন।
কঠোর নিরাপত্তার মধ্য দিয়ে অনুষ্ঠিত এ অনুষ্ঠানে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক উপদেষ্টা ফারুক-ই-আজম ও সংস্কৃতি উপদেষ্টা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী, চট্টগ্রামের বিভাগীয় কমিশনার ড. মো. জিয়াউদ্দীন ও জেলা প্রশাসক ফরিদা খানমসহ সংশ্লিষ্টরা উপস্থিত ছিলেন। জেলা প্রশাসনসূত্র জানায়, জুলাই পুনর্জাগরণ উপলক্ষে পুরো জুলাই মাসজুড়ে অনুষ্ঠান রয়েছে।
বিএ/এমএস