দেশজুড়ে

তৌহিদের শার্ট: রক্তে লেখা প্রতিরোধ

তৌহিদের শার্ট: রক্তে লেখা প্রতিরোধ

১৬ জুলাই, ২০২৪। বাংলাদেশের ছাত্র আন্দোলনের ইতিহাসে এক নির্মম দিন। সেদিন রংপুর বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের (বেরোবি) ছাত্র আবু সাঈদ পুলিশের গুলিতে শহীদ হন। তবে রংপুরের সেই রক্তাক্ত দুপুর শুধু একজন ছাত্রের মৃত্যুই দেখেনি—রক্তে ভিজে গিয়েছিল আরও অনেক স্বপ্ন, আরও অনেক সাহস।

Advertisement

তাদেরই একজন, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র তৌহিদুল ইসলাম তুহিন। সেদিনের গুলির ক্ষত আজও বহন করে চলছেন শরীরে। আর একখানা রক্তমাখা শার্ট, যা হয়ে উঠেছে তার জীবনের, তার সময়ের এবং একটি আন্দোলনের নীরব স্মারক।

গত ২ জুলাই, এক রোদেলা দুপুরে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি ছাউনির নিচে বসে কথা হয় জুলাই আন্দোলনের সম্মুখসারির যোদ্ধা, তৌহিদুল ইসলাম তুহিনের সঙ্গে। তার হাতে ছিল সেই শার্টটি।

তৌহিদ স্মৃতি টেনে আনছিলেন, শোনাচ্ছিলেন গুলির মুহূর্ত, সহযোদ্ধা আবু সাঈদের মৃত্যু, আতঙ্কের রাত, আর বিছানায় কাটানো দিনগুলোর কথা।

Advertisement

তার কণ্ঠে ছিল তীব্রতা, আবার ছিল স্থিরতাও। কিন্তু তার চেয়েও জোরে যেন কথা বলছিল নীরব শার্টটা। যেন একাকী বহন করে চলেছে সেই দিনটির গর্জন—পুলিশের ট্রিগার টেপা আঙুল, রাস্তার ধুলোয় লুটিয়ে পড়া শরীর, প্রিয়জনের কান্না, আর রাষ্ট্রীয় চোখ রাঙানির অজানা ভয়।

তৌহিদ বলেন, ‘এখন অনেকে এই শার্টটা নিতে চেয়েছে। জুলাই আন্দোলনের স্মারক হিসেবে রাখতে চেয়েছে কেউ, কেউ চেয়েছে সংগঠনের সংগ্রহে। আমি দিইনি। এটা আমার কাছে সাহসের আরেক নাম, এটা আমার বেঁচে থাকার অনুপ্রেরণা।’

তৌহিদ জানান, সহযোদ্ধা আবু সাঈদকে বিশ্ববিদ্যালয়ের যে গেটের সামনে পুলিশের প্রকাশ্য গুলি করে হত্যা করে, সেখানকার এক মিছিলের সম্মুখ ভাগে তিনিও ছিলেন। তাদের মিছিল খামার মোড় ও লালবাগ পার্কের মোড় ঘুরে ১ নম্বর গেটের দিকে যাচ্ছিল, যেটাকে এখন সবাই ‘আবু সাঈদ গেট’ নামে চেনে।

আরও পড়ুন

Advertisement

আমরা কোনো একটি রাজনৈতিক দলের হতে চাই না নতুন ঘর উঠেছে, সংসারে টাকা আসে, শুধু নেই আবু সাঈদ! আবু সাঈদ মহাকাব্যের নায়ক, তাকে নিয়ে গল্প-কবিতা লেখা হবে বেরোবিতে চাকরি পেলেন আবু সাঈদের বোন

তারা ক্যাম্পাসে প্রবেশ করতে চাইলেও বাধা হয়ে দাঁড়ায় পুলিশ এবং ভেতরে অবস্থান নেয় ছাত্রলীগের কিছু সদস্য। মুহূর্তেই উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। ‘আমরা পাঁচ মিনিটও পাইনি’ বলেন তৌহিদ, ‘মাত্র দুই থেকে তিন মিনিটের মাথায় কোনো পূর্ব সতর্কতা ছাড়াই পুলিশ গুলি চালাতে শুরু করে।’

তখন আশ্রয় নেওয়ার মতো কোনো জায়গা ছিল না। গুলির সামনে পড়ে যান তৌহিদ। ঘাড়, কান, মাথায় গুলির আঘাত। মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। শরীর থেকে ঝরে পড়া রক্তে তার গায়ের সাদা শার্ট মুহূর্তেই রক্তিম হয়ে ওঠে। গুরুতর আহত অবস্থায় তাকে লালবাগে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানেই দেওয়া হয় প্রাথমিক চিকিৎসা, তারপর ভর্তি হন রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ৬ নম্বর ওয়ার্ডে।

‘জুলাই মাস মানেই এখন একটা রক্তাক্ত শার্ট। স্মৃতি বলতে এটাই বেঁচে আছে আমার কাছে’ বলেন তৌহিদ।

তৌহিদ ৬ নম্বর ওয়ার্ডের যে বিছানায় চিকিৎসাধীন ছিলেন, কিছুক্ষণ পর সেখানে আহত অবস্থায় আনা হয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের ছাত্র আবু সাঈদকে। এর কিছুক্ষণ পর তাকে মৃত ঘোষণা করেন চিকিৎসক। এরপর হাসপাতাল থেকে অসুস্থ অবস্থায় বাড়িতে ফিরে যান তৌহিদ। সেদিন পরিবারের অবস্থাও ছিল ভয়াবহ। তাদের চোখেমুখে ছিল সন্তানের জন্য যন্ত্রণা। তৌহিদ বলেন, ‘মা-বাবার চোখের দিকে তাকাতে পারছিলাম না।’ কারণ তখন পুলিশ বা তাদের সহযোগী বাহিনী থেকে বাঁচতে ক্যাম্পাস থেকে পালিয়ে বাড়ি গেলেও তৌহিদকে ‘শিবির’ ট্যাগ দিয়ে পুলিশের কাছে তথ্য সরবরাহ করা হয়।

বগুড়া জেলার আদমজিতে বাবা-মাকে নিয়ে রাত কাটাতেন আতঙ্কে। নিজের রুমে ঘুমাতে পারতেন না। একসময় নিজের ঘরও নিরাপদ মনে হয়নি।

জুলাই ফাউন্ডেশন থেকে এককালীন অর্থসহায়তা পেয়েছেন তিনি। তার রক্তাক্ত মুখ, রক্তে ভেজা শার্ট আর ব্যান্ডেজ মোড়া মাথার ছবি সেদিন ভাইরাল হয়েছিল—মানুষের বিবেকে দিয়েছিল প্রবল নাড়া। তবে পরিবারের জন্য সেই ছবিগুলো ছিল এক দুঃস্বপ্ন, এক আতঙ্ক।

‘আমি একজন নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান। কোনোদিন এসব রাজনৈতিক ব্যাপারে যুক্ত হইনি। আন্দোলনে গিয়েছিলাম নিজের ন্যায্য অধিকার আদায়ের জন্য।’ বলেন তৌহিদ।

‘কিছুদিন পর চাকরির বাজারে ঢুকতে যাচ্ছিলাম—কিন্তু তখন মনে হচ্ছিল, এই কোটা ব্যবস্থার কারণে আমার ভবিষ্যৎটাই অনিশ্চিত হয়ে যাচ্ছে। তাই গিয়েছিলাম আন্দোলনে—নিজের অধিকারটুকু নিশ্চিত করতে।’

‘আমি একজন ছাত্র। আমি জনগণের অংশ। দেশের একজন নাগরিক। আর আমার মতো লাখ লাখ শিক্ষার্থী তখন রাস্তায় নেমেছিল ঠিক একই কারণে।’ বলেন তৌহিদ।

তবে নতুন করে ‘জুলাই যোদ্ধাদের’ জন্য কোটা চালুর ঘোষণায় অসন্তোষ প্রকাশ করেন তুহিন।

তিনি বলেন, ‘আমরা আন্দোলন করেছি মেধার ভিত্তিতে চাকরির জন্য। যদি আবার কোটা ফিরে আসে, আর আমরা জুলাইয়ের আহতরা সেই কোটায় চাকরি নিই—তাহলে তো আমাদের আন্দোলনের মাহাত্ম্যই হারিয়ে যাবে। কারণ এদেশের ৯৫ শতাংশ মানুষ এই আন্দোলনের পক্ষে ছিল।’

তবে তুহিন মনে করেন, শহীদ পরিবারগুলোর জন্য স্থায়ীভাবে কিছু করার ব্যবস্থা রাখা যেতে পারে। ‘আমাদের আন্দোলনের মূল আকাঙ্ক্ষা ছিল বৈষম্য দূর করা—একটি এমন বাংলাদেশ, যেখানে ন্যায্যতা থাকবে। কিন্তু এখনো সেটা নিশ্চিত হয়নি। তবে আমি আশাবাদী।’ বলেন এই জুলাই যোদ্ধা।

তার মাথার পেছনে এখনো কিছু গুলির স্প্লিন্টার রয়ে গেছে, যেগুলো অপারেশন করেও বের করা সম্ভব নয় বলে জানিয়েছেন চিকিৎসক। আজও সেই রক্তমাখা শার্টটি নিজের কাছে রেখে দিয়েছেন তুহিন। রাখতে চান আমৃত্যু।

‘যদি বলেন এই শার্টের মূল্য কত—সেদিন আমি মৃত্যুকে আলিঙ্গন করে ফিরে এসেছি’ বলেন তুহিন।

‘এটা শুধু এক টুকরো কাপড় নয়, এটা একটা প্রতিবাদের প্রতীক, রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের দলিল। আমি মৃত্যু পর্যন্ত এই শার্টটা নিজের কাছে রাখতে চাই। আবারও যদি কোনো অন্যায় দেখি, সেই প্রতিবাদের শক্তিটা আমি এই রক্তাক্ত শার্ট থেকেই নেবো।’

জেপিআই/ফারহান সাদিক সাজু/এএসএ/এসএফএ/এমএস