খেলাধুলা

মারাকানা ট্র্যাজেডির ৭৫ বছর, যেদিন স্তব্ধ হয়েছিল পুরো ব্রাজিল

মারাকানা ট্র্যাজেডির ৭৫ বছর, যেদিন স্তব্ধ হয়েছিল পুরো ব্রাজিল

ফুটবল তাদের জীবনের অংশ। ফুটবলই ধর্ম, আবেগ, ধ্যান-জ্ঞান। সোনার চামুচ মুখে নিয়ে জন্ম নিতে হয় না ব্রাজিলিয়ান শিশুদের। তারা জন্ম নেয়ার পর সামনে ফুটবলকেই দেখতে পায়। সেই দেশটি ১৯৩০ সালে বিশ্বকাপ শুরুর পর একবারও বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হতে পারেনি।

Advertisement

অবশেষে ১৯৫০ সালে সেই সুযোগ এলো। ঘরের মাঠে প্রথমবারের মত বিশ্বকাপের আয়োজক ব্রাজিল। টুর্নামেন্টের ফেবারিটও। আগের বছর ঘরের মাঠে অনুষ্ঠিত কোপা আমেরিকায় যারা ৮ ম্যাচে বরেছিল ৪৬ গোল। সেভাবেই এগিয়ে চলছিল লাতিনের দেশটির পথচলা। বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হওয়া থেকে মাত্র আর এক কদম দুরে। লিগ পদ্ধতিতে অনুষ্ঠিত টুর্নামেন্টের শেষ ম্যাচে উরুগুয়ের সঙ্গে জয়ও প্রয়োজন নেই। ড্র করলেও প্রথমবারের মত বিশ্বচ্যাম্পিয়নের মুকুট উঠে যাবে তাদের মাথায়।

আজকের এই দিন, ১৬ জুলাই ছিল সেই ম্যাচটি অনুষ্ঠিত হওয়ার দিন। আজ থেকে ঠিক ৭৫ বছর আগে। ম্যাচটি ১-১ গোলেই এগিয়ে চলছিল; কিন্তু শেষ মুহুর্তে উরুগুয়ের আলসিদেস ঘিগিয়া গোল করে সমস্ত স্বপ্ন ভঙ করে দেন ব্রাজিলিয়ানদের। মুহূর্তেই অস্বাভাবিক নীরবতায় ছেয়ে যায় পুরো মারাকানা স্টেডিয়াম। ম্যাচ ২-১ গোলে জিতে নেয় উরুগুয়ে। দ্বিতীয়বারের মত বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হলো তারা।

ব্রাজিল আবারও শিরোপাহীন। শোকে স্তব্ধ মারাকানা তখন যেন মৃত্যুপুরি। ইংলিশ রেফারি জর্জ রিডারের শেষ বাঁশি বাজার সঙ্গে সঙ্গে হার সইতে না পেরে গ্যালারি থেকে লাফিয়ে পড়েন অসংখ্য ব্রাজিল সমর্থক।

Advertisement

ব্রাজিলের ইতিহাসে মারাকানাজো বা মারাকানা ট্র্যাজেডি হিসেবেই পরিচিত হয়ে আছে সেই ঘটনা। যা ব্রাজিলিয়ানদের জাতীয় জীবনেরই অংশ হয়ে গেছে।

মারাকানার নীরব কান্না

১৯৫০ সালের ১৬ জুলাই। রিও ডি জেনিরোর মারাকানা স্টেডিয়ামে সময় যেন থমকে দাঁড়িয়েছিল। প্রায় দুই লাখ (কেউ লেখেন ১ লাখ ৯৫ হাজার, কেউ লেখেন ২ লাখ ৫ হাজার দর্শক উপস্থিত ছিল সেদিন মারাকানায়) মানুষের উচ্ছ্বাসে ভরা স্টেডিয়ামটিতে ব্রাজিলের হৃৎপিণ্ড যেন ধক ধক করছিল।

বিশ্বকাপ ফাইনাল। ব্রাজিল বনাম উরুগুয়ে। এ যেন কেবল একটি খেলা নয়, একটি জাতির স্বপ্নের পরীক্ষা। ব্রাজিলের মাটিতে, তাদের নিজেদের তৈরি বিশাল মারাকানা স্টেডিয়ামে, তারা বিশ্বকাপ জিতবে- ব্রাজিলিয়ানদের এই বিশ্বাস ছিল অটুট। কিন্তু সেদিন, ফুটবলের ইতিহাসে একটি কালো অধ্যায় লেখা হলো, যা পরবর্তীকালে ‘মারাকানাজো’ বা ‘মারাকানার ট্র্যাজেডি’ নামেই পরিচিত হলো ফুটবল বিশ্বে।

Advertisement

স্বপ্নের মঞ্চ রিও ডি জেনিরোর মারাকানা

মারাকানা স্টেডিয়ামকে বলা হয় ‘ফুটবলের মক্কা’। ছিল ব্রাজিলের গর্ব। ১৯৪৮ সালে নির্মাণ শুরু হওয়া এই স্টেডিয়াম ছিল সে সময়ের এক স্থাপত্য বিস্ময়। বিশ্বকাপ আয়োজনের জন্য ব্রাজিল এই মঞ্চ প্রস্তুত করেছিল, যেখানে তারা তাদের ফুটবল শৈলি- ‘জোগো বোনিতো’র জাদু দিয়ে বিশ্বকে মুগ্ধ করবে। সাম্বার দেশে ফুটবল শুধু খেলা নয়, এ যেন এক ধর্ম, এক আবেগ। মাঠে বল নিয়ে খেলোয়াড়দের নাচ যেন ব্রাজিলের সংস্কৃতির প্রতিচ্ছবি।

১৯৫০ সালের বিশ্বকাপে ব্রাজিল ছিল অপ্রতিরোধ্য। স্পেনকে ৬-১ গোলে এবং সুইডেনকে ৭-১ গোলে বিধ্বস্ত করে তারা শেষ ম্যাচে এসে উপনীত হয়েছিল। যেখানে তাদের প্রতিপক্ষ উরুগুয়ে। ইতিহাসে উরুগুয়ে ইতিমধ্যে একবার বিশ্বকাপ জিতে নিয়েছিল। ১৯৩০ সালে অনুষ্ঠিত প্রথম বিশ্বকাপ।

কিন্তু সেবার, ১৯৫০ সালে ব্রাজিলের মাটিতে তাদের যেন কেউ পাত্তাই দিচ্ছিল না। জয়ের ব্যাপারে ব্রাজিলিয়ানরা এতটাই আত্মবিশ্বাসী ছিল যে, পত্রপত্রিকাগুলোও নিয়ম ভেঙে আগাম খবর ছেপে ফেলেছিল।

ফাইনালের আগের দিনই সাও পাওলোর গাজেতা এসপোর্তিভার প্রথম পৃষ্ঠায় শিরোনাম হয় 'টুমরো উই উইল বিট উরুগুয়ে!' রিও'র পত্রিকা ও মুন্দো ম্যাচের দিন ব্রাজিলিয়ান খেলোয়াড়দের ছবি ছেপে ঘোষণা দিয়ে দেয় 'দিজ আর দ্য ওয়ার্ল্ড চ্যাম্পিয়নস'। রিও'র মেয়র ম্যাচের আগেই 'বিজয়ী' বীরদের স্যালুট জানিয়ে ফেলেন। শিরোপা হাতে ওঠা যেন ছিল শুধু সময়ের অপেক্ষা।

ওই ম্যাচকে ঘিরে ২২টি স্বর্ণপদক তৈরি করা হয়েছিল, যার উপর ব্রাজিলের প্রতিটি খেলোয়াড়ের নাম লেখা ছিল। রিও ডি জেনিরোর মেয়র, অ্যাঞ্জেলো মেন্ডেস ডি মোরেস খেলার দিন একটি আবেগঘন বক্তৃতা দিয়েছিলেন খেলোয়াড়দের উদ্দেশ্যে। বলেছিলেন, ‘তোমরা, খেলোয়াড়রা, যাদের কয়েক ঘন্টারও কম সময়ের মধ্যে লক্ষ লক্ষ দেশবাসী চ্যাম্পিয়ন হিসেবে স্বাগত জানাবে! তোমরা, যাদের সমগ্র গোলার্ধে কোন প্রতিদ্বন্দ্বী নেই! তোমরা, যারা অন্য কোন প্রতিযোগীকে পরাজিত করবে! তোমরা, যাদের আমি এরইমধ্যে বিজয়ী হিসেবে অভিবাদন জানাচ্ছি!’

অ্যাঞ্জেলো মেন্ডেসের তত্বাবধানে একটি বিজয়সূচক গানও তৈরি করা হয়, ‘ব্রাজিল ওস ভেনসিডোরেস (ব্রাজিল দ্য ভিক্টরস)’ এবং গানটির অনুশীলনও করা হয়েছিল, ফাইনাল শেষে ব্রাজিলে বিজয় উৎসবে গাওয়ার জন্য।

তবে সাও পাওলো এফসির চেয়ারম্যান পাওলো মাচাদো ডি কারভালহো, যিনি পরবর্তীতে ১৯৫৮ ও ১৯৬২ বিশ্বকাপে ব্রাজিল ফুটবল দলের হেড অব ডেলিগেশন ছিলেন, তিনি এ ধরনের আগাম অভিনন্দন জানানো, জয় দাবির বিরোধিতা করেছিলেন। ম্যাচের আগেই দলকে চ্যাম্পিয়ন দাবি করতে নিষেধ করেছিলেন।

ম্যাচের আগে এস্টাডিও সাও জানুয়ারিওতে দলের অনুশীলন পর্যবেক্ষণ করতে গিয়ে পাওলো বেশ কয়েকজন রাজনীতিবিদকে খেলোয়াড়দের উদ্দেশ্যে আবেগপ্রবণ বক্তৃতা দিতে দেখেন। সেইসাথে দেখেন সেখানে সাংবাদিক, আলোকচিত্রী এবং অন্যরা ‘ভবিষ্যতের চ্যাম্পিয়ন’দের দেখতে হাজির হয়ে গেছেন। পাওলো তখন কোচ ফ্লাভিও কস্তাকে খেলোয়াড়দের মনোযোগ বিঘ্নিত করার ঝুঁকি সম্পর্কে সতর্ক করেছিলেন; কিন্তু ওই সময় পাওলোকে উপেক্ষা করা হয়েছিল। তার কথাকে কেউ গুরুত্ব দেয়নি। হতাশ হয়ে, তিনি তখন তার সাথে থাকা ছেলে তুতাকে বলেছিলেন, ‘আমরা হেরে যাব’।

সেই ঐতিহাসিক ম্যাচের দিন

১৯৫০ বিশ্বকাপটি হয়েছিল অদ্ভুত নিয়মে। ইতিহাসে এই একটিই বিশ্বকাপ, যাতে কোনো ফাইনাল ছিল না। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর অনুষ্ঠিত প্রথম এই বিশ্বকাপে অংশ নিয়েছিল ১৩টি দল। টুর্নামেন্টের ওই অভূতপূর্ব ও অনন্য ফরম্যাট হয়েছিল আয়োজক ব্রাজিলের পীড়াপীড়িতেই।

চার গ্রুপে খেলা হওয়ার পর চার গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন খেলবে চূড়ান্ত রাউন্ডে। সেখানে চার দল পরস্পরের সঙ্গে খেলার পর চ্যাম্পিয়ন হবে শীর্ষে থাকা দলটি। ব্রাজিল ও উরুগুয়ের সঙ্গে চূড়ান্ত পর্বে উঠেছিল সুইডেন ও স্পেন। এই দু’দলকে ৭-১ ও ৬-১ গোলে উড়িয়ে দিয়ে রীতিমতো অপরাজেয় রূপে দেখা দিল ব্রাজিল।

১৬ জুলাই, ১৯৫০ সাল। ব্রাজিল ও উরুগুয়ে যখন শেষ ম্যাচে মুখোমুখি হলো, ফাইনাল না হয়েও সেটি হয়ে গেল অলিখিত ফাইনাল। কারণ, এই ম্যাচ দিয়েই চ্যাম্পিয়নশিপ নির্ধারণ হবে। ব্রাজিলের জন্য হিসেব ছিল, ড্র করলেও তারা চ্যাম্পিয়ন। কিন্তু আগের কোপা আমেরিকায় যারা উরুগুয়েকে ৫-১ গোলে হারিয়েছিল, তারা এই ম্যাচেও নিজেদের বিজয়ী হিসেবেই ধরে নিয়েছিল।

মারাকানা স্টেডিয়াম তখন জনসমুদ্র। দুই লাখেরও বেশি দর্শকের উল্লাসে যেন ভূমিকম্প তৈরি হচ্ছিল। কেঁপে উঠেছিল পুরো মাঠ। ব্রাজিলীয় সমর্থকদের মুখে হাসি, হাতে পতাকা, আর হৃদয়ে স্বপ্ন।

খেলা শুরু হলো। প্রথমার্ধ গোলশূন্য থাকলেও ব্রাজিল আক্রমণের ঝড় তুলছিল। দ্বিতীয়ার্ধের শুরুতেই, ৪৭তম মিনিটে ফ্রিয়াসা গোল করে ব্রাজিলকে এগিয়ে দিলেন। মারাকানা ফেটে পড়ল উল্লাসে। উৎসবের আমেজ ছড়িয়ে পড়ল। ব্রাজিলের খেলোয়াড়দের পায়ে যেন বল নাচছিল, আর দর্শকদের চিৎকারে আকাশ কাঁপছিল।

কিন্তু ভাগ্যের পরিহাস! উরুগুয়ে হাল ছাড়েনি। ৬৬তম মিনিটে হুয়ান আলবার্তো শিয়াফিনো সমতা ফেরালেন। মুহূর্তেই স্টেডিয়ামে স্তব্ধতা নেমে এল। ব্রাজিলীয় সমর্থকদের মুখে হাসি উধাও হলেও, আশা তারা ছাড়েনি। কারণ, ড্র হলেও তো চ্যাম্পিয়ন হবে তারা! ফলে ব্রাজিল আবার আক্রমণ শুরু করল।

কিন্তু সর্বনাশটা ঘটে গেলো ৭৯তম মিনিটে। রিওতে তখন বিকেল ৪টা ৩৩ মিনিট। ব্রাজিলিয়ানরা এখনও জানে সেই সময়টা। বল পায়ে অনেকটা দৌড়ে ব্রাজিলের বক্সে ঢুকে পড়েন উরুগুইয়ান ফরোয়ার্ড আলসিদেস ঘিগিয়া। ডান দিক থেকে একটি দুর্দান্ত শট নেন যা ব্রাজিলের গোলরক্ষক বারবোসাকে পরাস্ত করে। তিনি ঝাঁপিয়ে পড়েও বলটি ফেরাতে পারলেন না। গোওওওওওল! স্কোরলাইন হয়ে গেলো ২-১। ব্রাজিল হেরে গেল।

হৃদয়ভাঙা নীরবতা

খেলা শেষ হলো। আশ্চর্যজনকভাবে হঠাৎই যেন সকল ঝড় থেমে গেলো। নীরব হয়ে গেলো সব কোলাহল। ২ লাখ মানুষের মানুষের উচ্ছ্বাস যেন এক মুহূর্তে বিলীন হয়ে গেল। তারা যেন স্রেফ বোবা হয়ে গিয়েছিল। অস্বাভাবিক নীরবতা নেমে এলো মারাকানার বুকজুড়ে।

ভেঙে চুরমার হয়ে গেলো ব্রাজিলের স্বপ্ন। এই পরাজয় শুধু একটি খেলার হার ছিল না, এ যেন একটি জাতির আত্মপরিচয়ের উপর সবচেয়ে বড় আঘাত হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হলো। সংবাদপত্রগুলো যারা ব্রাজিলকে বিজয়ী ঘোষণা করেছিল, তারা তখন লিখল, ‘এটি আমাদের জাতীয় ট্র্যাজেডি।’ কেউ কেউ বলেন, ‘সেদিন মারাকানায় ব্রাজিলের ফুটবলের আত্মা কেঁদেছিল।’

পরাজয়ের পর ব্রাজিলীয় খেলোয়াড়রা মাঠে মুখ লুকিয়েছিলেন। গোলরক্ষক বারবোসা পরে এক সময় বলেছিলেন, ‘আমি সারা জীবন এই পরাজয়ের দায় বয়ে বেড়িয়েছি।’ সমর্থকদের মধ্যে কেউ কেউ কান্নায় ভেঙে পড়েছিলেন, কেউ নীরবে স্টেডিয়াম ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন। মারাকানা, যে মঞ্চটি স্বপ্নের জন্য তৈরি হয়েছিল, সেদিন তা হয়ে উঠেছিল এক বিষাদের প্রতীক।

ব্রাজিলের ইতিহাসে ফুটবল ছাপিয়ে ঘিগিয়ার সেই গোল হয়ে গেলো সর্বজনীন এক জাতীয় ট্র্যাজেডি। এই গোল নিয়ে ব্রাজিলিয়ান ক্রীড়া লেখক হোয়াও ম্যাক্সিমো লিখেছিলেন, ‘ঘিগিয়ার গোলকে নীরবতা দিয়ে বরণ করল পুরো স্টেডিয়াম। কিন্তু এমনই এর শক্তি, এমনই বিধ্বংসী এর প্রভাব যে একটি গোল, শুধুই একটি গোল যেন ব্রাজিলের ইতিহাসকে পরিষ্কার দুটি ভাগে বিভক্ত করে দিল এর আগে ও পরে।’

ইতিহাসের ক্ষতচিহ্ন

ব্রাজিলের সেই হারের জের টানতে হয় গোলরক্ষক মোয়াকির বারবোসা নাসিমেন্তোকে। দারুণ ফুটওয়ার্ক আর আত্মবিশ্বাসী বারবোসা ছিলেন নিজের সময়ে সেরা গোলরক্ষকদের একজন। কিন্তু ফাইনালের দিন ডান প্রান্ত থেকে ঘিগিয়ার শটটা ধরতে গিয়ে তিনি শুয়ে পড়েন, হাত পিছলে বল জালে জড়িয়ে যায়।

হৃদয় ভেঙে দেওয়া সেই গোলের সঙ্গে জড়িয়ে যায় তার পুরো জীবন। ‘১৯৫০’ আমৃত্যু তাড়া করে বেড়িয়েছে তাকে। সতীর্থরাও একরকম বর্জনই করেছিলেন। ব্রাজিলিয়ানরাও তাকে কখনো ক্ষমা করেনি। এমনকি ১৯৯৩ সালে বিশ্বকাপ বাছাইপর্বের খেলা চলার সময়ে ব্রাজিলের তৎকালীন খেলোয়াড়দের শুভকামনা জানাতে তাদের ট্রেনিং ক্যাম্পে গেলে, 'দুর্ভাগ্য বয়ে আনবেন' বলে তাকে সেখানে ঢুকতে দেওয়া হয়নি।

২০০০ সালের এপ্রিলে নিজের ৭৯তম জন্মদিনের ১০ দিন পর মারা যাওয়া বারবোসা এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘ব্রাজিলে যেকোনো অপরাধের শাস্তি সর্বোচ্চ ৩০ বছরের জেল। অথচ আমি কোনো অপরাধ না করেই ৪৩ বছর ধরে শাস্তি ভোগ করছি।’

মারাকানার সেই ট্র্যাজেডির সময় ব্রাজিলের জার্সি কিন্তু হলুদ ছিল না। ছিল সাদা-কালো। মারাকানাজো ট্র্যাজেডির কারণে এই জার্সিকেই দুর্ভাগ্যের প্রতীক ভাবতে শুরু করে ব্রাজিলিয়ানরা। তাদের অব্যাহত দাবির মুখে শেষ পর্যন্ত ১৯৫৩ সালে এসে ব্রাজিল সেই ‘সাদা জার্সি’কে নির্বাসনে পাঠায়। নতুন জার্সি তৈরি করে। যেখানে তাদের জাতীয় পতাকার রঙ থাকবে। অবশেষে তৈরি হয় হলুদ-আর নীলের মিশেলে বিখ্যাত জার্সিটি। যেটা পরে পেলে-গারিঞ্চা-রোমারিও-রোনালদো-রোনালদিনহোরা জিতেছেন ৫টি বিশ্বকাপ শিরোপা।

মারাকানাজো ব্রাজিলের ফুটবল ইতিহাসে একটি অমোচনীয় দাগ রেখে গেছে। এই পরাজয় ব্রাজিলীয়দের শিখিয়েছিল যে, ফুটবল কেবল খেলা নয়, এটি তাদের আবেগের একটি অংশ। পরবর্তীতে ব্রাজিল পাঁচবার বিশ্বকাপ জিতলেও, ১৯৫০ সালের ১৬ ‍জুলাইয়ের ক্ষত এখনো তাদের হৃদয়ে রয়ে গেছে। মারাকানা আজও দাঁড়িয়ে আছে, কিন্তু তার দেয়ালে যেন সেই নীরব কান্নার প্রতিধ্বনি এখনো বেঁচে আছে।

এই ট্র্যাজেডি শুধু একটি খেলার গল্প নয়, এটি একটি জাতির আশা, হতাশা আর উত্থানের গল্প। মারাকানাজো ব্রাজিলকে শিখিয়েছিল- পড়ে যাওয়ার পরেও উঠে দাঁড়াতে হয় এবং ব্রাজিল তাই করে দেখিয়েছে, বারবার।

আইএইচএস/