সুমি খাতুন। শহীদ আবু সাঈদের ছোট বোন। সবচেয়ে আদরের বোন। জুলাই গণঅভ্যুত্থানে ‘ভাইকে হারানোর বিনিময়ে’ রংপুর বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগে একটি ছোট পদে চাকরি পেয়েছেন। তবে ভাইয়ের রক্তের বিনিময়ে পাওয়া এ চাকরি তার কাছে সম্মান নয়, বরং এক গভীর বেদনার প্রতীক—এমনটাই বলেন সুমি।
Advertisement
বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরির পাশাপাশি একটি কোয়ার্টারে থাকার ব্যবস্থাও হয়েছে সুমির। সেই বাসার সামনেই কথা হয় জাগো নিউজের সঙ্গে।
সুমি বলেন, ‘এই চাকরিটা আমার কাছে বেদনাদায়ক। সবচেয়ে খারাপ লাগে তখনই, যখন ভাবি ভাইয়ের আত্মত্যাগের বিনিময়ে আমি একটা চাকরি করছি…’
একটু থেমে নরম গলায় বলেন, ‘কিন্তু কী করবো? জীবন তো থেমে থাকে না। চলার জন্যই নিতে হয়েছে।”
Advertisement
আবু সাঈদের সঙ্গে সুমির জন্মের ব্যবধান মাত্র দেড় থেকে দুই বছর। তাই বন্ধনটাও ছিল খুব গভীর। আবু সাঈদ লেখাপড়ায় এগিয়ে গেলেও সুমিকে অল্প বয়সেই বিয়ে দিয়ে দিতে হয়। দ্রুতই সন্তানের মা হন তিনি। স্বামীর সংসারও অভাব-অনটনের।
তবু ভাই সাঈদ ছিলেন ছায়ার মতো। বোনের কোনো কষ্ট জানলেই ছুটে আসতেন। দূরে থাকলেও খোঁজ নেওয়া থেমে থাকতো না কখনো। সুমি জানতেন—এই দুনিয়ায় একজন আছে, যিনি সব পরিস্থিতিতে তার পাশেই থাকবেন। কিন্তু হঠাৎ ভাইকে হারিয়ে দিশেহারা সুমি।
গত বছরের অক্টোবরে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ইংরেজি বিভাগের সেমিনার অ্যাটেন্ডেন্ট হিসেবে চাকরি দেয় তাকে।তবে সুমি বলেন, ‘আমার ভাইয়া তো এমন চাকরি করতো না। তার স্বপ্ন ছিল বিসিএস ক্যাডার হওয়ার। মেধাটাও ছিল সে রকম।’
ভাইয়ার বন্ধুদের দেখলে তার কথা আরও বেশি মনে পড়ে। মনে হয়, আবু সাঈদ ভাইয়া থাকলে এদের সঙ্গেই ক্লাসে যেত, পরীক্ষায় এদের কারও না কারও সামনে বা পেছনে বসতো
Advertisement
পুরোনো দিনের কথা মনে করে বলেন, ‘আমার মা-বাবা নিরক্ষর। ‘ক’ আর ‘খ’—কোনটা তাও বলতে পারেন না। ভাইয়াকে কখনো পড়তে বসতে বলেননি কেউ। সে নিজেই নিজের ইচ্ছায় এতদূর এসেছে।’
আরও পড়ুন
আমরা কোনো একটি রাজনৈতিক দলের হতে চাই না নতুন ঘর উঠেছে, সংসারে টাকা আসে, শুধু নেই আবু সাঈদ! আবু সাঈদ মহাকাব্যের নায়ক, তাকে নিয়ে গল্প-কবিতা লেখা হবে বেরোবিতে চাকরি পেলেন আবু সাঈদের বোনসুমি জানান, ছাত্রাবস্থাতেই আবু সাঈদ টিউশন করে সংসারে সাহায্য করতো। তার টাকায় সুমির খরচ চলতো, মায়ের চিকিৎসা হতো, বাবার হাতেও তুলে দিতো কিছু।
‘ভাইয়া টিউশনি করে চলতো, তাই আব্দার করতে সংকোচ হতো। তারপরও যদি কিছু বলতাম, সেটা পূরণ করতে চেষ্টা করতো। ভাইয়া এমনই ছিল।’ — বলেন সুমি।
এই বিভাগেই পড়তো আবু সাঈদ। এখানে তার স্মৃতি খুঁজে ফেরে সুমি। আবু সাঈদের বন্ধুরা গত একবছর ক্লাস করেছে। সম্প্রতি মাস্টার্স পরীক্ষাও দিয়েছে। তাদের দেখে আবু সাঈদকে মনে পড়ে সুমির।
‘ভাইয়ার বন্ধুদের দেখলে তার কথা আরও বেশি মনে পড়ে। মনে হয়, আবু সাঈদ ভাইয়া থাকলে এদের সঙ্গেই ক্লাসে যেত, পরীক্ষায় এদের কারও না কারও সামনে বা পেছনে বসতো।’ বলেন তিনি।
সুমি বলেন, ‘যতদিন ধরে বুঝতে শিখেছি, ভাইয়া আমাকে খুব আদর করতো। আমার প্রতি তার ছিল এক বিশেষ টান।’
দাখিল পরীক্ষার সময় থেকে আবু সাঈদ টিউশনির টাকা দিয়ে সুমিকে পড়াতেন। বাবার বয়স হয়ে গেছে, তাই ভাইয়াই তখন দায়িত্ব নিয়েছিলেন।
‘ভাইয়া বলেছিল—তোর যা লাগবে, আমাকে বলবি। এমনকি পাড়ার এক দোকানে বলে গিয়েছিল, আমি যা চাই তা যেন বাকিতে দিয়ে দেয়। ভাইয়া পরে এসে বকেয়া শোধ দিতো।’
সবশেষ দেখা হয় ঈদের সময়। কোরবানি ঈদের ছুটিতে ভাইয়া সুমির শ্বশুরবাড়ি গিয়ে তাকে বাড়িতে নিয়ে আসেন। ঈদের দুদিন পর, দুপুরে রংপুর ফিরে যান। তারপর আর দেখা হয়নি। তবে নিয়মিত ফোনে খোঁজ-খবর নিতেন।
‘মঙ্গলবার, ১৬ জুলাই ভাইয়া মারা যায়। তার আগে শুক্রবার আমার সঙ্গে শেষবারের মতো কথা হয়েছিল। বলেছিল, বৃহস্পতিবার বিকেলে আসবে। সেদিন আমাকে যেতে বলেছিল... কিন্তু আর আসা হয়নি ভাইয়ার।’
গত বছরের ১৬ জুলাইয়ের সেই মুহূর্তটি এখনো ভুলতে পারেন না সুমি খাতুন। স্মরণ করে বলেন, ‘সেদিন আমি বড় বোনের বাড়িতে বেড়াতে গিয়েছিলাম। দুপুরে বাড়ি ফেরার প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম, এমন সময় চাচাতো বোন ফোন করে জানালো—আবু সাঈদ ভাই মারা গেছে। বিশ্বাসই হয়নি। জিজ্ঞেস করলাম, কীভাবে? বললো, পুলিশের গুলিতে।’
সুমি বলেন, ‘আমি অবাক হয়ে গেলাম। ভাবছিলাম—আবু সাঈদ ভাই তো কোনো উচ্ছৃঙ্খল ছেলে না, না-ই বা কারও সঙ্গে ঝামেলা করে। পুলিশ কেন তাকে গুলি করবে?’
তার চোখে জল চলে আসে, ‘ভাইয়া আমাকে এত ভালোবাসতো, একটা মুহূর্তে কি ওর মনে হয়নি—আমার কথা? আমি যে অপেক্ষা করছিলাম...’
সেদিন যখন ভাইয়ার মরদেহ বাড়িতে নেওয়া হলো, মুখটা দেখে ভাবছিলাম, কতটা আঘাত পেলে একটা সুস্থ মানুষ এমনভাবে মারা যায়? সামান্য আঘাতে মানুষ সরে যায়, অথচ ভাইয়া এত আঘাত পেয়েও সরে যায়নি
সুমি বলেন, ‘সেদিন যখন ভাইয়ার মরদেহ বাড়িতে নেওয়া হলো, মুখটা দেখে ভাবছিলাম, কতটা আঘাত পেলে একটা সুস্থ মানুষ এমনভাবে মারা যায়? সামান্য আঘাতে মানুষ সরে যায়, অথচ ভাইয়া এত আঘাত পেয়েও সরে যায়নি।’
একটু থেমে বলেন, ‘মনে হয়, ভাইয়া বুঝেই গিয়েছিল ও চলে যাবে... তাই হয়তো আমাকে এত ভালোবেসে গেছে।’
সুমি বলেন, ‘আবু সাঈদ ভাইয়ার বন্ধুরা আমাকে খুব স্নেহ করেন। বলেন—‘আমরা একেকজন আপনার ভাই।’ এটা শুনে ভালো লাগে।’
কিন্তু পরক্ষণেই তার কণ্ঠ নরম হয়ে আসে, ‘আমার ভাই ছিল আমার সবচেয়ে কাছের মানুষ। আমি সব কিছু বলতে পারতাম তাকে। আমার যে কোনো সমস্যায় সে-ই ছিল আমার ভরসা।’
একটু থেমে বলেন, ‘আজ হয়তো অনেক ভাই পেয়েছি, কিন্তু তাদের কেউই আবু সাঈদ ভাইয়ার মতো না। ভাইয়া তো একজনই ছিলেন…’
এই প্রতিবেদন তৈরিতে সহায়তা করেছেন জাগো নিউজের রংপুর প্রতিনিধি জিতু কবীর ও বেগম রোকেয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিবেদক ফারহান সাদিক সাজু।
জেপিআই/এএসএ/এমএস