১৮ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত কোটা আন্দোলনের হটস্পট ছিল রাজধানীর উত্তরা। শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আন্দোলনে যুক্ত হয় সর্বস্তরের মানুষ। সে সময় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে নিহত হন ৭০ জনের মতো, আহত হন আরও অনেকে। তবে শেখ হাসিনাকে হটিয়ে ক্ষান্ত হন তারা।
Advertisement
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ভিডিওতে শহীদ মীর মাহফুজুর রহমান মুগ্ধের কণ্ঠ এখনও ভেসে আসে, ‘পানি লাগবে পানি’। ১৮ জুলাই উত্তরার আজমপুরে কপালে গুলি লেগে শহীদ হন মুগ্ধ।
শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা চালালে বিক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতার পাল্টা হামলায় ১৯ জুলাই গুরুতর আহত হন গাজীপুর সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র জাহাঙ্গীর আলম। এ সময় জাহাঙ্গীরের পিএস ও গাছা থানার যুবলীগ নেতা জুয়েল মোল্লাকে পিটিয়ে মেরে বটগাছে ৩ ঘণ্টা ঝুলিয়ে রাখা হয়। পরে বিজিবি গিয়ে গাছ থেকে তার মরদেহ উদ্ধার করে।
হামলা পাল্টা হামলা চলতে থাকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত। অবশেষে জয়ী হয় ছাত্র-জনতা। প্রতিরোধের মুখে পিছু হঠতে বাধ্য হয় সরকার। পদত্যাগ করে গোপনে দেশ ছাড়েন চার বারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
Advertisement
আরও পড়ুন:
আমরা কোনো একটি রাজনৈতিক দলের হতে চাই নাজুলাই শহীদ দিবসে রাষ্ট্রীয়ভাবে পালিত হচ্ছে শোকগণঅভ্যুত্থানের বর্ষপূর্তিতে ‘কইলজ্যা কাঁপানো ৩৬ দিন’২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টের এই আন্দোলনের একবছর হচ্ছে। আজ ১৬ জুলাই শহীদ দিবস পালন করছে দেশ। উত্তরার সেসব দিনের ঘটনা এখনও চোখে ভাসে স্থানীয়দের। চোখের সামনে নির্বিচারে ছাত্রদের ওপর গুলির ঘটনা ভুলতে পারেননি রাজধানীর মানুষ।
রাজধানীর উত্তরায় রাজলক্ষ্মী-আজমপুর এলাকায় রাস্তার পাশে জুতার দোকান রয়েছে সাইফুল ইসলামের। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, আন্দোলনের পুরো সময় আমি এই এলাকায় ছিলাম। যেদিন শেখ হাসিনার পতন হয় সেদিন আমি দেড়টার দিকে বাসা থেকে বের হই। আব্দুল্লাহপুর দিয়ে বিজয় মিছিল করতে করতে হাউজ বিল্ডিং পর্যন্ত এসেছিলাম। তখন আনুমানিক ২টা ১০ থেকে ২টা ২০। ওখান থেকে হাঁটতে হাঁটতে বিএনএস সেন্টার হাউজ বিল্ডিং আসছি। এরপর আমরা থানায় যাবো এই সময় এখানে পুলিশের একটা জলকামান ছিল। পরে ছাত্ররা সেই গাড়ি চেক করতে যায় আর হামলা শুরু হয়। পরে আমরা উত্তরার ৭ নম্বর সেক্টর দিয়ে ঘুরে আবার এখানে আসি। এরপর বিল্ডিংয়ের ছাদে আশ্রয় নেই। সেখানেই আছরের নামাজ আদায় করি। পরে আমরা এখান থেকে নেমে দেখি রাজলক্ষ্মীর ওখানে গুলিবিদ্ধ দুই-তিনটা লাশ পড়ে আছে। পরে আমরা লাশগুলো নেওয়ার অনেক চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু পারি নাই। পরে পুলিশ গুলি করতে করতে এখান থেকে এয়ারপোর্টের দিকে গেলো। পুলিশ যাওয়ার পর আমরা মেইন রোডে এসে দুইটা আহত ছেলেকে রিকশা দিয়ে হাসপাতালে পাঠিয়ে দিয়েছি। তাদের মধ্যে একজনের অবস্থা খুবই নাজুক ছিল। পরে এখান থেকে আমরা এদিক-সেদিক ঘুরছি। পরে লোকজন ছিল তারা আমাদের বললো ভাই এদিক দিয়ে আইসেন না, গুলি করছে। তখন আমরা আবার পিছিয়ে গিয়ে রাজলক্ষ্মী ব্রিজ দিয়ে পার হয়ে শাহজালাল ব্যাংকের সামনে অবস্থান করলাম। এখানে আমার সামনে আমার পরিচিত একজনের গুলি করে ফেলে দিলো। পরে তাকে একটা মোটরসাইকেলে ওঠায় দিলাম, নিয়ে গেলো কুয়েত মৈত্রীতে। এভাবেই রাত সাড়ে ৯টা পর্যন্ত এখানেই ছিলাম।
আরও পড়ুন:
Advertisement
সাইফুল আরও বলেন, এখানে দুজন পুলিশ সদস্য ছিল যারা আন্দোলনে খুব ঝামেলা করছিল। পরে সেনাবাহিনী এসে পুলিশ সদস্যদের এখান থেকে সরিয়ে দেয়। আমরাও সেনাবাহিনীর সঙ্গে বিজয় মিছিল করতে করতে এখানে আসছি। ওরা (পুলিশ সদস্যরা) সেনাবাহিনীদেরও মানেনি। না মানার পরে রাতে ওদের দুজনকে ধরে (দুই পুলিশ সদস্যকে) রাস্তায় মারা হয়। মারার পরে ঝুলানো হয়েছিল এখানে।
রিকশাচালক আবুল কালাম জাগো নিউজকে বলেন, আন্দোলনের সময় এসব রাস্তায় প্রচুর মানুষ ছিল। ছাত্ররা রাস্তায় ছিল তাদের সঙ্গে সাধারণ মানুষও ছিল। একদিকে পুলিশ, আরেকদিকে আন্দোলনকারীরা। দুইপক্ষের মধ্যে হামলা-পাল্টা হামলা হয়েছিল। পুলিশকে গুলি করতে দেখেছি। অনেক আন্দোলনকারী হতাহত হয়। আমাদের রিকশায় অনেক আহতদের হাসপাতালে নিয়ে গেছি। দূর থেকে দেখেছি হঠাৎ করে এখানেই এক আন্দোলনকারীর পায়ে গুলি লাগে আর সে রাস্তায় পরে যায়। পরে সবাই ধরাধরি করে হাসপাতালে নিয়ে যায়। আমাদের মধ্যেও তখন ভয় ছিল। কখন এসে গায়ে গুলি লাগে। তাই দূরে দূরে থাকছি। আমার বয়সে আমি এমনটা আগে আর দেখি নাই।
আরও পড়ুন:
পোস্টকার্ডের মাধ্যমে স্মৃতিকথা সংগ্রহ করছে তথ্য মন্ত্রণালয়যুক্ত হচ্ছে ‘জুলাই গণঅভ্যুত্থান’ কোটা, বাদ পড়ছে মুক্তিযোদ্ধা কোটা‘আরে বেটা লাশ ফালাই রাখছি, দেখছ না? এইডা তোল’ফুটপাতে বিভিন্ন ধরনের ভর্তা বিক্রেতা মো. আবদুল রশিদ জাগো নিউজকে বলেন, এখানে প্রচুর গুলা-গুলি হয়েছে। আমরা তখন পেছনের রাস্তায় ছিলাম। রাজলক্ষ্মী জসিম উদ্দিন রোড পর্যন্ত পুলিশ ছাত্র-ছাত্রীরা দৌড়াদৌড়ি করতো। আমরা একদিন এদিক থেকে রাস্তায় ঢুকছি দেখি অনেক পোলাপান। সে সময় কাঁচা আম ভর্তা বিক্রি করতাম। তা গাড়ি নিয়ে রাস্তায় ঢুকছি ঢুকে দেখি রাস্তা দিয়ে দৌড়াদৌড়ি হচ্ছে। পরে আমরা আর সাহস করে রাস্তায় আসি নাই। পেছনের রাস্তা দিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছি। দৌড়াদৌড়ি হলেও টুকটাক বেচাকেনা হচ্ছে। ছাত্ররা এসে কেনাকাটা করছে।
তিনি বলেন, অনেক মানুষ দেখছি দৌড়াদৌড়ি করতে করতে আহত হয়েছে, তাদেরকে নিয়ে মেডিকেলে যাওয়া হচ্ছে। পাশে একটা হাসপাতাল আছে ওখানে অনেক আহত রোগী নিয়ে যাওয়া হয়েছিল।
খোকন নামে স্থানীয় এক সরবত বিক্রেতা জাগো নিউজকে বলেন, আন্দোলনের সময় একদিন রাস্তায় দোকান লাগাইছি তার কিছুক্ষণ পর দেখি এখানকার অবস্থা সিরিয়াস। দৌড়াদৌড়ি লেগে গেছে। পরে এখান থেকে দৌড়ে পেছনে চলে গেছি। দাঁড়িয়ে ছিলাম, শুধু গুলির শব্দই শোনা যায়।
কেআর/এসএনআর/জেআইএম