মতামত

মা-বাবার নামে কেন মামলা করলো সন্তান?

মা-বাবার নামে কেন মামলা করলো সন্তান?

সামাজিক মাধ্যমে মেহরিন নামে একজন কিশোরীর ভিডিও ঘুরে বেড়াচ্ছে যে নিজের বাবা-মায়ের বিরুদ্ধে মামলা করেছে এবং ইংরেজিতে জোরালো কণ্ঠে বলছে যে, ‘আমি মা-বাবার পাপেট নই, আমার সুরক্ষা চাই।’ দুটি কারণে মেহরিনের মামলাটি সামাজিক মাধ্যমে উৎসাহ সৃষ্টি করেছে। প্রথমত মেয়েটি কম বয়সী, দেখেই বোঝা যাচ্ছে সে এখনো বাবা-মায়ের ওপর নির্ভরশীল। এরপরও সে বাবা-মায়ের বিরুদ্ধে অভিযোগ করছে। আর মেয়েটি ইংরেজিতে কথা বলছে, যা সচরাচর কম শোনা যায়। ধারণা করা যায় সে ইংরেজি মিডিয়ামের স্টুডেন্ট।

Advertisement

অলরেডি সমাজের মানুষ মেহরিনকে নিয়ে নানান কথা বলতে শুরু করেছেন। বলছেন, আজকালকার পোলাপান এত বেয়াদব যে বাবা-মায়ের বিরুদ্ধে মামলা ঠুকতেও একবার ভাবে না। এই মেয়ে থাকবে কোথায়? বাবা-মা ছাড়া কে তাকে আশ্রয় দেবে? মেহরিনকে কেন্দ্র করে এখনকার আরও শিশু-কিশোর, তরুণদের চরিত্র বিশ্লেষণ করা হচ্ছে।

বয়স হয়ে যাওয়ার পর সম্পত্তি নিয়ে বাবা-মায়ের বিরুদ্ধে মামলা করে ছেলেমেয়ে। কিন্তু ১৯ বছর বয়সে মামলা করার ঘটনা নতুনই বলা যায়। শারীরিক ও মানসিক হেনস্তা থেকে নিজের সুরক্ষা চেয়ে মা-বাবার বিরুদ্ধে মামলা করা মেয়ে মেহরিন আহমেদ আদালতে বলেছে, ‘বাবা-মা আমাকে কেন গালি দেবে? কেন তারা আমাকে শারীরিক ও মানসিকভাবে হেনস্তা করে? আমি আমার সুরক্ষা চাই।’

মেহরিনের অভিযোগ, ‘বাবা-মায়ের মাধ্যমে আমি জন্মগ্রহণ করেছি, সেটা আমার কোনো দোষ নয়। আমি তাদের পুতুল নই। আমাকে কেন গালি দিবে? আমাকে শারীরিক-মানসিকভাবে নির্যাতন করা হয়েছে। আমি ভালোভাবে খেতে ও ঘুমাতে পারি না। আমাকে মানসিক হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিল, ব্রেইন অ্যান্ড মাইন্ড হাসপাতালে দুই বছর রাখা হয়েছিল। সেখানে আমাকে মানসিক ও শারীরিকভাবে হেনস্তা করা হয়েছে। কেন আমাকে ওই হাসপাতালে রাখা হয়েছিল, আমি জানতে চাই।’

Advertisement

বাদীপক্ষের আইনজীবী বলেন, ‘আদালত উভয় পক্ষের বক্তব্য শুনেছেন। বয়ঃসন্ধিকাল থেকেই বাদী পরিবারের সদস্যদের অবহেলা ও মানসিক নির্যাতনের শিকার। তাই পারিবারিক সহিংসতা প্রতিরোধ ও সুরক্ষা আইন ২০১০ অনুযায়ী সুরক্ষা আদেশ ও জীবনযাপনের প্রয়োজনীয় ব্যয়ভারের জন্য আবেদন করা হয়েছে।’

অনেক বাবা-মা তাদের জীবনের স্বপ্ন, ব্যর্থতার দায় থেকে সন্তানদের ওপর অতিরিক্ত প্রত্যাশা চাপিয়ে দেন, বিশেষ করে পড়াশোনা ও ক্যারিয়ারের ক্ষেত্রে। যখন তাদের প্রতিনিয়ত ভালো ফলাফল, প্রতিযোগিতায় জয়ী হওয়া বা সামাজিকভাবে ‘সফল’ হওয়ার জন্য চাপ দেওয়া হয়, তখন সেই চাপ কিশোরদের মধ্যে হতাশা ও ক্ষোভের জন্ম দিতে পারে।

মেহরিনের এ ঘটনাটা নতুন মনে হলেও ঠিক নতুন নয়। তবে সুরক্ষা চেয়ে মামলা করার বিষয়টি নতুন। খোঁজ নিলে দেখা যাবে আমাদের অনেকের ঘরেই অভিভাবকদের সাথে সন্তানের যুদ্ধ চলছে। বিশেষ করে এই যুগের টিনএজদের সাথে। যারা টিনএজের বাচ্চা সামলেছেন, তারা জানেন এরা কতটা স্বাধীনচেতা, কতটা স্পষ্টবাদী এবং হুইমজিক্যাল।

টিনএজ বা কৈশোর একটি সংবেদনশীল সময়, যখন শিশু-কিশোররা শারীরিক, মানসিক এবং সামাজিক পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যায়। এ সময়ে অনেক কিশোর-কিশোরী তাদের বাবা-মায়ের প্রতি ক্ষুব্ধ বা বিরক্ত হয়ে ওঠে। এর পেছনে বিভিন্ন সামাজিক, মানসিক এবং পারিবারিক কারণ রয়েছে।

Advertisement

এ সময় তারা এতটাই আবেগপ্রবণ থাকে যে বাবা-মায়ের শাসন, নিষেধ বা নিয়ন্ত্রণ তাদের কাছে মনে হয় নিপীড়ন। কৈশোরে এসে তারা স্বাধীনতা ও স্বকীয়তা প্রতিষ্ঠা করতে চায়। নিজে সিদ্ধান্ত নিতে, নিজের পছন্দ প্রকাশ করতে এবং জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে নিজস্বতা বজায় রাখতে চায়।

অন্যদিকে ঠিক এই সময়ই বাবা-মায়েরা সন্তানের সুরক্ষার জন্য অতিরিক্ত নিয়ন্ত্রণ আরোপ করেন। পড়াশোনা, বন্ধু নির্বাচন বা বাইরে যাওয়ার ক্ষেত্রে কঠোর নিয়ম আরোপ করেন। এই নিয়ন্ত্রণ টিনএজড শিশুদের মনে ক্ষোভের জন্ম দেয়, কারণ তারা মনে করে তাদের ব্যক্তিগত স্বাধীনতা খর্ব করা হচ্ছে।

আজকের আধুনিক প্রযুক্তিভিত্তিক সমাজে বাবা-মা এবং কিশোর-কিশোরীদের মধ্যে চিন্তাভাবনার ফারাক স্পষ্ট হয়ে উঠছে। বাবা-মা অনেক সময় বর্তমান সময়ের সামাজিক মাধ্যম, ডিজিটাল গেম বা আধুনিক সংস্কৃতির প্রতি কিশোরদের আগ্রহ বুঝতে পারেন না। ফলে কিশোর বয়সী সন্তানরা মনে করে তাদের বাবা-মা তাদের জগৎ সম্পর্কে জানেন না, তারা পিছিয়ে পড়া এবং সে কারণেই তাদের চাওয়া-পাওয়া বুঝতে ব্যর্থ হচ্ছেন।

এই কথা ঠিক যে বাবা-মায়ের বেড়ে ওঠার ধরন, তাদের সময়কার বন্ধুত্ব, প্রেম, সেক্স, আদব-কায়দার ধরন, সামাজিকতা, আত্মীয়দের সাথে সম্পর্ক, পোশাক, খাবারের ইচ্ছা, টাকা খরচের প্রবণতা, ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা, দায়িত্বপালন কোনোটাই এখনকার শিশু-কিশোরদের সাথে খাপ খায় না, বরং ব্যবধান অনেক। মূলত এই ব্যবধান থেকেই অভিভাবকদের সাথে সন্তানের সম্পর্কেও অবনতি হচ্ছে।

অনেক বাবা-মা তাদের জীবনের স্বপ্ন, ব্যর্থতার দায় থেকে সন্তানদের ওপর অতিরিক্ত প্রত্যাশা চাপিয়ে দেন, বিশেষ করে পড়াশোনা ও ক্যারিয়ারের ক্ষেত্রে। যখন তাদের প্রতিনিয়ত ভালো ফলাফল, প্রতিযোগিতায় জয়ী হওয়া বা সামাজিকভাবে ‘সফল’ হওয়ার জন্য চাপ দেওয়া হয়, তখন সেই চাপ কিশোরদের মধ্যে হতাশা ও ক্ষোভের জন্ম দিতে পারে।

বাবা-মায়ের মধ্যে দ্বন্দ্ব, ঝগড়াঝাঁটি বা বিবাহবিচ্ছেদ শিশু-কিশোরদের মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর গভীর প্রভাব ফেলে। যখন তারা তাদের বাবা-মায়ের মধ্যে ঝগড়া বা অসম্মানজনক আচরণ দেখে, তখন তারা মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয় এবং এই ক্ষোভ বাবা-মায়ের প্রতি প্রকাশ পায়। পারিবারিক অশান্তি সন্তানের মধ্যে অসহায়ত্ব ও ক্ষোভের অনুভূতি বাড়ায়।

বিভিন্ন গবেষণা বলছে দিনে চার-পাঁচ ঘণ্টার বেশি গেম খেলা বা সামাজিক মাধ্যমে সময় কাটানো কিশোরদের মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে এবং তাদের মধ্যে বিষণ্নতা ও বিরক্তি বাড়ায়। কিন্তু বাবা-মা যখন প্রযুক্তি ব্যবহারে সীমাবদ্ধতা আরোপ করেন, তখন কিশোররা এটিকে তাদের স্বাধীনতার ওপর হস্তক্ষেপ বলে মনে করে ও ক্ষোভ প্রকাশ করে।

শিশু ও টিনএজ শিশুর প্রতি অবহেলা বা অতিরিক্ত যত্ন দুই-ই ভয়াবহ বিপদ ডেকে আনে। বাবা-মায়ের অমনোযোগিতা শিশুর মধ্যে প্রত্যাখ্যানের অনুভূতি তৈরি করে। অন্যদিকে অতিরিক্ত আস্কারা শিশুকে পথভ্রষ্ট করে। পরবর্তী পর্যায়ে সুরক্ষা দিতে চাইলে টিনএজড সন্তানদের মনে হতে পারে যে তাদের স্বাধীনতা হরণ করা হচ্ছে।

মেহরিনের ঘটনা এরকম কোনো সমস্যা থেকে সৃষ্টি হতে পারে। অন্যদিকে সন্তান যখন মাদকাসক্ত হয়ে পড়ে, তখন সে বাবা-মায়ের কোনো আদরযত্ন, সুরক্ষাকে সহজভাবে গ্রহণ করতে পারে না। সেক্ষেত্রে বাবা-মায়ের গায়ে হাত তোলা, তাদের হত্যা করার মতো ঘটনাও ঘটে।

তবে সঠিক যোগাযোগ, স্বাধীনতা দেওয়া এবং পারিবারিক সম্পর্কের উন্নতির মাধ্যমে এ ক্ষোভ অনেকাংশে কমানো সম্ভব। বাবা-মায়ের উচিত তাদের সন্তানকে বোঝা এবং তাদের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তোলা। ফলে কিশোররা তাদের ক্ষোভ প্রকাশের পরিবর্তে বাবা-মায়ের সঙ্গে তাদের অনুভূতি ভাগ করে নিতে পারবে, যা একটি সুস্থ ও সুখী পারিবারিক পরিবেশ তৈরি করবে।

মনোবিজ্ঞানীরা বলেন, মস্তিষ্কের যে অংশটি সিদ্ধান্তগ্রহণ ও আবেগ নিয়ন্ত্রণের কাজ করে, কৈশোরে তা পুরোপুরি বিকশিত হয় না। এ কারণে কিশোররা অনেক বেশি আবেগপ্রবণ হয়। বাবা-মায়ের নিয়ন্ত্রণের বিরুদ্ধে বিদ্রোহী হয়ে ওঠে। বলা যায়, এটি তাদের স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠার স্বাভাবিক প্রক্রিয়ার অংশ।

এরিক অ্যারিকসনের মতো মনোবিজ্ঞানীরা বলেন, কৈশোরে ‘আইডেন্টিটি বনাম রোল কনফিউশন’ পর্যায়ে কিশোররা নিজেদের পরিচয় খুঁজে পেতে চায়। বাবা-মায়ের অতিরিক্ত নিয়ন্ত্রণ বা হস্তক্ষেপ তাদের এই প্রক্রিয়ায় বাধা সৃষ্টি করে, ফলে তারা ক্ষুব্ধ হয়। কিশোরদের মধ্যে উদ্বেগ বা বিষণ্ণ থাকলে তারা প্রায়ই তাদের কাছের মানুষ, বিশেষ করে বাবা-মায়ের প্রতি ক্ষোভ প্রকাশ করে।

তাই সমাজ মনোবিজ্ঞানীরা মনে করেন বাবা-মায়ের উচিত সন্তানের পাশে থাকা, কাছে থাকা। এর মানে এই নয় যে প্রশ্রয় দিয়ে মাথায় তোলা, বরং পাশে থেকে শিশু-কিশোর সন্তানের অভাব-অভিযোগ, সমস্যার কথা শোনা। বাবা-মায়ের সঙ্গে কম যোগাযোগ, অতিরিক্ত সমালোচনা বা অবহেলা কিশোরদের মধ্যে ক্ষোভের জন্ম দেয়। শিশু মনোবিজ্ঞান বলে যদি বাবা-মায়ের সঙ্গে সন্তানের নিরাপদ যোগ না থাকে, তবে তারা অস্থির হয়ে উঠতে পারে।

তাই তারা পরামর্শ দেন, বাবা-মায়ের উচিত সন্তানের সবধরনের কথা শোনা এবং তাদের অনুভূতি বোঝার চেষ্টা করা। এটি তাদের মধ্যে বিশ্বাস তৈরি করে এবং ক্ষোভ কমায়। সেইসাথে সন্তানকে শুরুতেই বুঝিয়ে বলতে হবে কী করা যাবে, কী যাবে না। কোনটা ভালো, কোনটা মন্দ। নীতি-নৈতিকতার বোধটা শুরুতেই দিয়ে দিতে পারলে সমস্যা কম হবে। স্বাধীনতা দিতে হবে যেমন সত্য, তেমনি এর পাশাপাশি নিয়ম-কানুন জানাতে হবে।

আজকাল শিশু-কিশোররা খুব বেশি স্বাধীনতাপ্রিয়। সেই সাথে প্রযুক্তির প্রতি আগ্রহ তাদের চিন্তাভাবনার মধ্যে পাশ্চাত্যের প্রভাব ফেলেছে। সেজন্য খুব সাবধানে ডিল করতে হবে অভিভাবকদের। সন্তানের ভালো আচরণ বা অর্জনের জন্য প্রশংসা করে তাদের আত্মবিশ্বাস বাড়াতে হবে। তাতে বাবা-মায়ের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক উন্নত হবে।

যদি সন্তানের মধ্যে অস্থিরতা, বিষণ্ণতা, ক্ষোভ, রাগ অতিরিক্ত বা অস্বাভাবিক মনে হয়, তবে বকাবকি না করে মনোবিজ্ঞানী বা কাউন্সেলরের সাহায্য নেওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়। কগনিটিভ বিহেভিয়ারাল থেরাপি শিশু-কিশোরদের আবেগ নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করতে পারে।

যেহেতু সন্তানের কোনো ক্ষতি হলে বাবা-মা সবচেয়ে কষ্ট পান, তাই তাদেরই উচিত সন্তানের বিকাশমূলক পর্যায় বোঝা এবং তাদের সঙ্গে সুস্থ সম্পর্ক গড়ে তোলা। সন্তানের সঙ্গে খোলামেলাভাবে ও শ্রদ্ধা রেখে কথা বলা, তাদের মতামত গুরুত্ব দেওয়া এবং তাদের সমস্যার কথা শোনা খুব ভালো পন্থা তাদের রাগ নিয়ন্ত্রণের।

মোট কথা, সন্তানকে সময় দিতে হবে এবং তারাও যেন বাবা-মায়ের পাশে থাকে, সে ব্যবস্থাও করতে হবে। এমনভাবে সম্পর্কের সুতা এমনভাবে টানতে হবে, যেন তা ছিঁড়ে না যায়। দিনের শেষে সন্তানই মানুষের জীবনের সবচেয়ে দামি সম্বল। নয়তো মেহরিনের মা ও বাবার মতো মামলার মুখোমুখি আমরা যে কেউ হতে পারি।

লেখক : যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ ও কলাম লেখক।

এইচআর/এমএফএ/জেআইএম