ঝিনাইদহের মহেশপুরের দরিদ্র পরিবারের সন্তান মতিয়ার রহমান সাগর। উন্নত জীবনযাত্রার স্বপ্ন বুনে পাড়ি জমিয়েছিলেন মরুর দেশ লিবিয়ায়। ইচ্ছা ছিল লিবিয়া থেকে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে স্থায়ী হবেন ইতালিতে। কিন্তু ভেনিস নগরীর দেশে যাওয়ার সেই স্বপ্ন মতিয়ার রহমান সাগরের জীবনে এনেছে ঘোর অমানিশা।
Advertisement
আন্তর্জাতিক মানবপাচার চক্রের দালালদের খপ্পরে পড়ে নিভে যেতে বসেছিল সাগরের জীবনপ্রদীপ। ভাগ্য সহায়, দুই বছরের বন্দিদশা থেকে সেই মতিয়ার রহমান সাগর ফিরেছেন মায়ের কোলে। গত ৯ জুলাই দেশে ফেরেন মতিয়ার রহমান সাগর।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ঝিনাইদহের মহেশপুর উপজেলার কাজিরবেড় ইউনিয়নের নিশ্চিন্তপুর গ্রামের দরিদ্র পরিবারের সন্তান মতিয়ার রহমান সাগর। দুই ভাইয়ের মধ্যে সাগর বড়। তাই, অল্প বয়সেই পরিবারের হাল ধরতে পাড়ি জমিয়েছিলেন দূর প্রবাসে।
সরেজমিনে জানা যায়, বন্দিদশা থেকে দেশে ফেরার পরে প্রতিবেশী ও আত্মীয় স্বজনরা ভিড় করছেন সাগরের বাড়িতে। মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে আসা সাগরের মাথায় বুলিয়ে দিচ্ছেন মমতার পরশ।
Advertisement
সাগরের বাবা ইছাহাক নবী দালাল বলেন, ‘ভালো চাকরির আশায় ২০২৩ সালের আগস্টে ছেলেকে লিবিয়ায় পাঠাই। লিবিয়ায় গিয়ে প্রথমে একটি হাসপাতালে কাজ করতো। সেখানে মাসে ২০ হাজার টাকা বেতনে কাজ করতো সাগর। এরপর ভালো বেতনের প্রলোভন দেখিয়ে আমার ছেলেকে ইতালি পাঠানোর কথা বলে দালাল চক্রের সদস্যরা। তারা আমার কাছ থেকে ৮ লাখ টাকা দাবি করে। জমি বিক্রি করে দালালদের সেই টাকা দেওয়া হয়।’
তিনি আরও বলেন, ‘দালালদের টাকা দেওয়ার পরে এক সপ্তাহ পেরিয়ে গেলেও ছেলের কোনো খোঁজখবর পাচ্ছিলাম না। পরে একটি ভিডিও আসে মোবাইল ফোনে। সাগরকে মারধর করার ভিডিও। তখন জানতে পারি আন্তর্জাতিক মানবপাচার চক্রের খপ্পরে পড়েছে আমার ছেলে। চক্রের সদস্যদের নির্মম নির্যাতনে জীবনমৃত্যুর সন্ধিক্ষণে দিন কাটে সাগরের। তাকে নির্যাতন করে সেই ভিডিও ও ছবি দালালরা আমাদের কাছে পাঠিয়ে মোটা টাকা মুক্তিপণ দাবি করে। সন্তানকে দেশে ফেরাতে চাষের জায়গা জমিসহ বসতভিটা বিক্রি করে পর্যায়ক্রমে ৪০ লাখ টাকা লিবিয়ার মাফিয়াদেরকে দিতে হয়েছে।’
কান্নাজড়িত কণ্ঠে সাগরের মা মিনারা খাতুন বলেন, ‘বড় আশা করে ছেলেকে বিদেশ দিয়েছিলাম। ভেবেছিলাম ছেলেকে বিদেশ পাঠাতে পারলে বিদেশে গিয়ে ইনকাম করবে, টাকা পাঠাবে। দালাল মুজাম, রবিজুল ও আশরাফুল আন্তর্জাতিক মাফিয়াদের সঙ্গে মিলে আমার ছেলেকে জিম্মি করে ৪৪ লাখ টাকা মুক্তিপণ নিয়েছে। জমিজমা বিক্রি করে আজ আমরা নিঃস্ব।’
তিনি বলেন, ‘আমরা ভেবেছিলাম ছেলের মুখ আর দেখা হবে না। কিন্তু আল্লাহ রহম করেছেন। টাকা গেছে, জমিজমা গেছে তবু আমার সন্তানকে ফিরে পেয়েছি। আমার আর কোনো দুঃখ নেই।’
Advertisement
কথা হয় লিবিয়ায় বন্দি জীবন কাটানো মতিয়ার রহমান সাগরের সঙ্গে। সাগর জাগো নিউজকে বলেন, ‘দালালরা প্রথমে ইন্ডিয়ার চেন্নাই শহরে আমাকে নিয়ে যায়। চেন্নাই থেকে দুবাই, দুবাই থেকে মিশর, তারপর লিবিয়ার বেনগাজি শহরে আমাকে একটা ঘরে আটকিয়ে রাখা হয়। আটকে রাখার পর আমার পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করে। তারা ৮ লাখ টাকা হাতিয়ে নেয়।’
তিনি আরও বলেন, ‘টাকা দেওয়ার পর আমার বাবা-মা দালালদের চাপ দিলে তারা তাদের এজেন্টের মাধ্যমে আমাকে আন্তর্জাতিক মাফিয়াদের কাছে বিক্রি করে দেয়। তিন মাস আটকে রেখে মুক্তিপণ বাবদ ৩৬ লাখ টাকা হাতিয়ে নেয়। মরুভূমির মাঝে এক নির্জন ঘরে বন্দি করে আমার ওপর নির্যাতন চালায়। প্রায় তিন মাস চলে অবর্ণনীয় নির্যাতন। পরিবারের কাছে নির্যাতনের ভিডিও পাঠিয়ে মাফিয়ারা শুধু টাকা দাবি করতো।’
সাগর তার কথা বলার মাঝে নির্যাতনের চিহ্ন ও ছবি দেখাতে থাকেন। একটি ছবিতে দেখা যায় কঙ্কালসার দেহ। যা দেখলে যে কারও হৃদয় কেঁপে উঠবে।
সাগর বলেন, ‘আমার কঙ্কালসার দেহের ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হলে বাংলাদেশ সরকার ও একটি এনজিও আমাকে উদ্ধারের উদ্যোগ নেয়। পরে মানবাধিকার সংস্থা ও একটি আন্তর্জাতিক এনজিও আমাকে উদ্ধার করে দেশে ফেরত পাঠায়। আমার মতো কেউ যেন প্রলোভনে পড়ে বিদেশে না যায়। বিশেষ করে লিবিয়ায় কেউ যেন না যায়।’
লিবিয়ায় জিম্মি দশা থেকে দেশে ফেরা মতিয়ার রহমান সাগর প্রসঙ্গে মহেশপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) খাদিজা আক্তার জাগো নিউজকে বলেন, ‘মতিয়ার রহমান সাগরের সার্বিক খোঁজখবর নেওয়া হচ্ছে। এ বিষয়ে একটি এনজিও কাজ করছে। আমরা প্রশাসনিকভাবে তার পুনর্বাসনসহ সার্বিক সহযোগিতার চেষ্টা করবো।’
শাহজাহান নবীন/এসআর/এএসএম