দেশজুড়ে

শিশুশ্রম কমছে, বদলে যাচ্ছে শ্রমের ধরন

শিশুশ্রম কমছে, বদলে যাচ্ছে শ্রমের ধরন

* যশোরের তিন এলাকায় শ্রমে যুক্ত দশ হাজার শিশু* আগে গ্যারেজ বা কারখানায় কাজ শিখলেও এখন অটোরিকশা চালাচ্ছে শিশুরা* অবৈধ কর্মকাণ্ডে টাকার প্রবাহ বেশি থাকায় ঝুঁকছে শিশুরা* যুক্ত হচ্ছে কিশোর গ্যাং কিংবা সন্ত্রাস কর্মকাণ্ডে* সচেতনতায় নিরাপদ হচ্ছে কর্ম পরিবেশ

Advertisement

যশোর সদর উপজেলার নূরপুর গ্রামের আরিফ হোসেনের ছেলে মিনারুল ইসলাম বাপ্পী (১৫)। ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি হয়েও আর লেখাপড়া করতে পারেনি। একদিকে অসুস্থতায় টাইলস মিস্ত্রি বাবার আয়-রোজগার বন্ধ; অন্যদিকে জোগাড় হয়নি স্কুলের পোশাক-বেতন। তাই বাধ্য হয়ে ঢুকে পড়েছে মোটরসাইকেল গ্যারেজে। বাপ্পী এখন কাজ করে যশোরের নিউমার্কেট এলাকার নওশাদ মোটরবাইক ওয়ার্কসপে।

নিউমার্কেট ট্রাকস্ট্যান্ড বস্তির বাসিন্দা পিকুল হোসেনের ছেলে ফরহাদ হোসেন (১৪)। বাবা রিকশাচালক, মা গৃহকর্মীর কাজ করেন। বাবা হঠাৎ দুর্ঘটনায় অসুস্থ হয়ে পড়ায় রিকশা চালানো বন্ধ হয়ে যায়। বাবার সেবা করতে গিয়ে মায়েরও কাজ কমে যায়। বাধ্য হয়ে স্কুল ছেড়ে ওয়ার্কসপে কাজ নেয় ফরহাদ। ইঞ্জিন মেরামতের হেলপার হিসেবে কাজ শুরু করলেও তার মন পড়ে থাকতো স্কুলে। গাড়ির লোহার জিনিসপত্রে হাতুড়ি পেটানোর শব্দ হলে ফরহাদের মনে হতো বুঝি স্কুলের ঘণ্টা বাজছে!

শুধু বাপ্পী কিংবা ফরহাদ নয়; এভাবেই অসংখ্য শিশু শৈশবেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে ঝরে যুক্ত হচ্ছে শিশুশ্রমে। বেসরকারি সংস্থার জরিপ অনুযায়ী, যশোরের তিনটি অঞ্চলে প্রায় দশ হাজার শিশু শ্রমিক রয়েছে। তবে সরকারি পর্যায়ে জেলাভিত্তিক কোনো তথ্য-উপাত্ত পাওয়া যায়নি। যদিও যশোরে শিশুশ্রম কমছে বলে দাবি সরকারি-বেসরকারি দুটি সেক্টরেরই।

Advertisement

‘এই জেলায় শিশুশ্রম উল্লেখযোগ্য মাত্রায় হ্রাস না পেলেও শিশুশ্রম বৃদ্ধির হার কমে এসেছে। কারণ বাবা-মা শিশুশ্রমের নেতিবাচক দিক এবং শিক্ষার গুরুত্বের বিষয়ে সচেতন হয়েছে। নিয়োগকর্তারা শিশুশ্রম বিষয়ক আইন ও নীতিমালা সম্পর্কে জানতে পারার কারণে তাদের মধ্যে শিশুদের কাজে নিয়োগ প্রদানের ব্যাপারে আগ্রহ হ্রাস পাচ্ছে।’

তবে সংশ্লিষ্টদের তথ্য, শিশুশ্রম এখন প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায় থেকে যেমন অপ্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে ঝুঁকছে, তেমনি স্কুল ঝরেপড়া একটি অংশ ঝুঁকছে কিশোর গ্যাং ও মাদক সংশ্লিষ্টতায়।

যশোরে প্রায় দশ বছর ধরে শিশুশ্রম নিয়ে কাজ করছে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা আব্দুর রশিদ খান ঠাকুর ফাউন্ডেশন (এআরকেটিফ)। সংস্থাটি গত বছর সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাসে যশোর পৌরসভা, নওয়াপাড়া পৌরসভা এবং নাভারণ বাজার এলাকার শিশু শ্রমিকের (বয়স, সেক্টর এবং লিঙ্গভিত্তিক) সংখ্যা, শিশুশ্রমের কারণ, ধরন এবং প্রভাব জানার জন্য একটি জরিপ পরিচালনা করে। জরিপের তথ্য অনুযায়ী, যশোর পৌরসভা ও নওয়াপাড়া পৌরসভা এবং নাভারণ এই তিন এলাকায় মোট ৯ হাজার ৯৮০ জন শিশু শ্রমের সঙ্গে যুক্ত। এর মধ্যে যশোর পৌরসভায় ৪ হাজার ৯৯৩ জন, নওয়াপাড়া পৌরসভা এলাকায় ৩ হাজার ৪৮৮ এবং নাভারণ বাজার এলাকায় ১ হাজার ৪৯৯ জন।

আরও পড়ুন- সৈকতে পর্যটন শিল্পের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাড়ছে শিশুশ্রম দেশে ১৭ লাখ শিশু শ্রমিকের ১২ লাখ ঝুঁকিপূর্ণ কাজে: শ্রম সচিব নারী ও শিশু নির্যাতন মহামারি পর্যায়ে: উপদেষ্টা শারমীন মুরশিদ গৃহকর্মীদের সমস্যা ও সুরক্ষায় করণীয় বয়স কত হলে কিশোর বলা যায়

জরিপের তথ্য অনুযায়ী, ৯ হাজার ৯৮০ জন শিশু শ্রমিকের মধ্যে ৩ হাজার ৯৩৮ জনের বয়স ১৪ বছরের কম এবং ৬ হাজার ৪২ জনের বয়স ১৪ বছর থেকে ১৮ বছরের মধ্যে। এদের মধ্যে ৫ হাজার ৭০০ জন ছেলে শিশু এবং ৪ হাজার ২৮০ জন মেয়ে শিশু। এসব শিশু শ্রমিক মোট ৫৩টি সেক্টরে কাজ করে।

Advertisement

‘আগে মোটরসাইকেল গ্যারেজে অনেক শিশু শ্রমিক আসতো। এখন এ সংখ্যা কমেছে। আবার কাজের পরিবেশও অনেক ভালো হয়েছে। এখন আর কেউ যখন তখন মারধর করে না। এখন ১৪-১৫ বছরের ছেলেরা স্কুল ছাড়লে রিকশা-ইজিবাইক নিয়ে নেমে যায়।’

যশোরের শিশুশ্রম প্রসঙ্গে আব্দুর রশিদ খান ঠাকুর ফাউন্ডেশনের প্রকল্প সমন্বয়কারী আব্দুর রহমান জানান, তাদের জরিপ অনুযায়ী যশোর পৌরসভা, নওয়াপাড়া পৌরসভা এবং নাভারণ বাজার এলাকায় ৯ হাজার ৯৮০ জন শিশু শ্রমের সঙ্গে যুক্ত। তবে এটি কিন্তু গোটা যশোরের চিত্র নয়। যদিও যশোর জেলায় এই তিনটি এলাকায় শিল্প-কলকারখানা বা শ্রম সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান সবচেয়ে বেশি।

যশোরের শিশুশ্রম প্রসঙ্গে আব্দুর রশিদ খান ঠাকুর ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক প্রদীপ মার্সেল রোজারিও বলেন, দীর্ঘ নয় বছর যশোর জেলায় ফিল্ড পর্যায়ে শিশুশ্রম নিয়ে কাজ করার অভিজ্ঞতা থেকে বলা যায়, এ জেলায় শিশুশ্রম উল্লেখযোগ্য মাত্রায় হ্রাস না পেলেও শিশুশ্রম বৃদ্ধির হার কমে এসেছে। কারণ বাবা-মা শিশুশ্রমের নেতিবাচক দিক এবং শিক্ষার গুরত্বের বিষয়ে সচেতন হয়েছে। নিয়োগকর্তাগণ শিশুশ্রম বিষয়ক আইন ও নীতিমালা সম্পর্কে জানতে পারার কারণে তাদের মধ্যে শিশুদের কাজে নিয়োগ প্রদানের ব্যাপারে আগ্রহ হ্রাস পাচ্ছে।

শিশু শ্রমের সঙ্গে যুক্ত আব্দুল্লাহ (১৪) যশোর সদর উপজেলার ছোট গোপালপুর গ্রামের রংমিস্ত্রি জয়নাল মোল্লার ছেলে। নিউমার্কেটে মোটরসাইকেল গ্যারেজে কাজ করা আব্দুল্লাহ জানায়, ফাইভ পাস করার পর স্কুলে ভর্তি হতে চাইলে প্রাইভেট পড়তে হয় বলে বাবা আর স্কুলে দেননি। তাই মোটরসাইকেলের কাজ শিখছি।

‘সামগ্রিকভাবে শিশুশ্রম নিয়ে সচেতনতা বাড়ছে। এ কারণে শিশুশ্রমের হার কমছে। পাশাপাশি কর্মস্থলে কর্মপরিবেশও উন্নত হচ্ছে। নির্যাতনের ঘটনা কমছে; বাড়ছে সুরক্ষাসামগ্রী ব্যবহার। তবে শিশুশ্রমকে নির্মূল করতে হলে সম্মিলিত উদ্যোগ দরকার।’

উপশহর এলাকার সুরাইয়া সুমাইয়া ভলকানাইজিংয়ের স্বত্বাধিকারী সাইদুজ্জামান মুকুল বলেন, আগে মোটরসাইকেল গ্যারেজে অনেক শিশু শ্রমিক আসতো। এখন এই সংখ্যা কমেছে। আবার কাজের পরিবেশও অনেক ভালো হয়েছে। এখন আর কেউ যখন তখন মারধর করে না। এখন ১৪-১৫ বছরের ছেলেরা স্কুল ছাড়লে রিকশা-ইজিবাইক নিয়ে নেমে যায়। আবার আগে যে বয়সের ছেলেরা কাজে আসতো, তারা বখাটেপনা, কিশোর গ্যাং, আড্ডাবাজি, মাদকের সঙ্গেও জড়িয়ে যাচ্ছে।

দীর্ঘদিন ধরে বেসরকারি সংস্থায় কাজ করা একজন কর্মকর্তা জানান, এখন শিশুশ্রমের ধরন পাল্টে যাচ্ছে। আগে দরিদ্র পিতা-মাতারা কিশোরদের কাজ শেখার জন্য বিভিন্ন গ্যারেজ-কল-কারখানায় পাঠাতেন। মূল লক্ষ্য ছিল কাজ শেখা। কিন্তু এখন যারা শিশুশ্রমে যুক্ত হচ্ছে তাদের নগদ প্রাপ্তির দিকে দৃষ্টি বেশি। ফলে যেখানে বেশি টাকা মিলছে, সেখানেই তারা যুক্ত হচ্ছে। এজন্য কেউ কেউ ব্যাটারি রিকশা চালাচ্ছে। আর বর্তমান সময়ে অবৈধ কর্মকাণ্ড বিশেষ করে মাদক বা সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে টাকার প্রবাহ বেশি থাকায় একটি অংশ সেদিকেই ঝুঁকছে।

যশোর জেলা শিশু বিষয়ক কর্মকর্তা সাধন কুমার দাস জানান, যশোর জেলায় অসংখ্য মিল-কল-কারখানার পাশাপাশি বেনাপোল-নওয়াপাড় বন্দর শিল্পাঞ্চল রয়েছে। শ্রমঘন এসব অঞ্চলে শিশু শ্রমের প্রবণতাও রয়েছে। তবে সরকারি পর্যায়ে শিশুশ্রম সংশ্লিষ্ট পরিসংখ্যান না থাকলেও শিশুশ্রম নিয়ে নিয়মিত সভা ও মনিটরিং করা হয়। এই জেলায় এখন শিশুশ্রমের সংখ্যা যেমন কমছে তেমনি কর্মপরিবেশও উন্নত হচ্ছে বলেও তিনি উল্লেখ করেন।

কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর যশোরের উপ-মহাপরিদর্শক (ডিআইজি) আরিফুল ইসলাম জানান, সামগ্রিকভাবে শিশুশ্রম নিয়ে সচেতনতা বাড়ছে। এ কারণে শিশুশ্রমের হার কমছে। পাশাপাশি কর্মস্থলে কর্মপরিবেশও উন্নত হচ্ছে। নির্যাতনের ঘটনা কমছে; বাড়ছে সুরক্ষাসামগ্রী ব্যবহার। তবে শিশুশ্রমকে নির্মূল করতে হলে সম্মিলিত উদ্যোগ দরকার। দারিদ্র্যসহ যেসব সংকটে শিশু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছেড়ে কর্মমুখী হচ্ছে, সেই সংকট দূর করে শিশুর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে গমন নিশ্চিত করতে হবে। একইসঙ্গে তার পরিবারকে সামাজিক সুরক্ষা বেষ্টনীতে নেওয়া বা আর্থিক সুরক্ষা বলয়ে নিয়ে আসতে হবে।

তিনি আরও উল্লেখ করেন, জেলা পর্যায়ে শিশুশ্রমে যুক্ত শিশুদের পরিসংখ্যান বা সংখ্যাগত তথ্য তাদের নেই। তবে আব্দুর রশিদ খান ঠাকুর ফাউন্ডেশনের জরিপ সম্পর্কে তারা অবগত।

এফএ/জেআইএম