তাহসিন হামিমআমরা প্রতিদিন ঘুম থেকে উঠে ফোনের যেই অ্যাপটি প্রথম খুলে থাকি, সেটিই হতে পারে আমাদের জীবনের সবচেয়ে বড় ‘ডিজিটাল শত্রু’। ফেসবুক, কেবল একটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম নয়, এটি এখন একটি শক্তিশালী মনোবৈজ্ঞানিক ও তথ্য বিশ্লেষণকারী যন্ত্র, যা আমাদের ব্যক্তিগত তথ্য সংগ্রহ করে তা বিশ্লেষণ করে আমাদের রিয়েল-টাইম বিহেভিয়ারের ভিত্তিতে আমাদেরকে ‘ম্যানিপুলেট’ করছে, কখনো বুঝতে না দিয়েই।
Advertisement
নিশ্চয়ই খেয়াল করেছেন কোনো একটি বিষয় নিয়ে কারো সঙ্গে কথা বলছেন, কিংবা সার্চ করছেন সেই বিষয়ের পোস্ট, কনন্টেন্টে ভরে যাচ্ছে নিউজফিড। তারপর আপনি পোস্ট দেখে সেখানে ঢুকে গেলেন। একটু খেয়াল করেছেন কি, কীভাবে ফেসবুক জানলো আপনার কথা, আর আপনাকে যে ফেসবুক নিয়ন্ত্রণ করছে সেটা কি বুঝতে পারছেন?
এখন প্রশ্ন হলো আপনার ব্যক্তিগত তথ্য কীভাবে সংগ্রহ করে ফেসবুক?ফেসবুক আমাদের ফোন থেকে বিস্ময়কর পরিমাণে তথ্য সংগ্রহ করে, যেমন-
>> আমাদের লোকেশন ডাটা>> মাইক্রোফোন এক্সেস (আপনি কথা বললেই কিছুক্ষণ পরে তার সম্পর্কিত অ্যাড!)>> আপনার স্ক্রিনে কোথায় কতক্ষণ চোখ রেখেছেন, সেই আই ট্র্যাকিংয়ের ধারণা>> আপনি কাদের সঙ্গে কথা বলেন, কী টাইপ করেন এমনকি কী লেখার পর আবার ডিলিট করেন>> আপনার ফোনের অন্য অ্যাপগুলোর ব্যবহার প্যাটার্ন (যদি পারমিশন দেওয়া থাকে)>> ফটো ও ভিডিও পাঠানোর ডাটা, যেখানে সময়, স্থান, ডিভাইসের তথ্য থাকে>> এমনকি আপনি যেসব ওয়েবসাইট ভিজিট করেন ফেসবুক পিক্সেলের মাধ্যমে সেগুলোর ডাটাও সংগ্রহ করা হয়
Advertisement
এইসব তথ্য বিশ্লেষণ করে ফেসবুক জানে, আপনি কখন কষ্টে আছেন, কখন অবসাদগ্রস্ত, কবে আপনার জন্মদিন, কখন আপনি ছুটির মুডে আছেন এবং এমনকি আপনার রাজনৈতিক মতাদর্শ।
ফেসবুক কীভাবে এই শক্তিশালী অ্যালগরিদম ব্যবহার করে?ফেসবুকের নিয়ন্ত্রণের মূল অস্ত্র হলো এর অদৃশ্য, অথচ অসাধারণভাবে দক্ষ অ্যালগরিদম। এটি কেবল কম্পিউটার কোড নয়, বরং এক ধরনের ‘ডিজিটাল ব্রেইন’ যা প্রতিনিয়ত আমাদের আচরণ, চিন্তা ও অনুভূতির গভীর বিশ্লেষণ করে আমাদের পছন্দ-অপছন্দ, আবেগ-অবসাদ, বিশ্বাস ও মতাদর্শের উপর ভিত্তি করে আমাদের সামনে কনটেন্ট সাজিয়ে দেয়।
এই অ্যালগরিদমগুলো যেভাবে কাজ করে১. এনগেজমেন্ট বেজড ফিল্টারিংআপনি কোন পোস্টে লাইক দেন, কোন ভিডিওতে বেশি সময় থাকেন, কার পোস্টে কমেন্ট করেন এইসব তথ্য বিশ্লেষণ করে অ্যালগরিদম বুঝে নেয় আপনি কী দেখতে ভালোবাসেন। এরপর সেই ধরনের কনটেন্টই নিয়মিত আপনার ফিডে ঠেলে দেয়, যাতে আপনি আরও বেশি সময় অ্যাপে থাকেন।
২. মেশিং লার্নিংফেসবুক প্রতিদিন তাদের ব্যবহারকারীর কোটি কোটি আচরণ বিশ্লেষণ করে শেখে। এই ‘মেশিং লার্নিং’ প্রযুক্তি ব্যবহার করে ফেসবুকের অ্যালগরিদম নিজেই সিদ্ধান্ত নিতে শেখে কাকে কী দেখালে সে খুশি হবে, ক্লিক করবে, শেয়ার করবে কিংবা ক্ষুব্ধ হয়ে প্রতিক্রিয়া জানাবে।
Advertisement
৩. ভবিষ্যদ্বাণীমূলক বিশ্লেষণফেসবুক শুধু আপনি কী দেখছেন তাই নয়, ভবিষ্যতে আপনি কিসে আগ্রহী হবেন, সেটিও পূর্বাভাস দিতে পারে। আপনি হয়তো এখনো কিছু সার্চ করেননি, কিন্তু আপনার আগের ব্যবহার দেখে ফেসবুক আপনাকে সেই কনটেন্ট আগেই দেখিয়ে দেয়, যেন আপনি ভাবেন, ‘বাহ! এটাই তো আমি খুঁজছিলাম!’
৪. অনুভূতি শনাক্তকরণআপনার লেখার ভাষা, পোস্টের ইমোজি, কমেন্টের টোন বিশ্লেষণ করে বুঝে নেয় আপনি খুশি, কষ্টে, বিরক্ত না রাগান্বিত। এরপর সে অনুযায়ী আবেগ-নির্ভর কনটেন্ট সামনে আনে, যা আপনার প্রতিক্রিয়া বা এনগেজমেন্ট বাড়িয়ে তোলে।
৫. সামাজিক গ্রাফ বিশ্লেষণআপনার বন্ধুদের পছন্দ, তারা কী দেখছে বা শেয়ার করছে সেই তথ্য ব্যবহার করে আপনাকেও একই ধরনের কনটেন্টে সংযুক্ত করে। এতে আপনি ভাবেন, ‘আমার বন্ধু দেখছে, মানে আমিও দেখবো।’ ফলে আপনি নিজেই অ্যালগরিদমের ফাঁদে পড়েন।
বাংলাদেশে এর ভয়াবহ প্রভাববাংলাদেশে প্রযুক্তি সচেতনতার অভাব থাকায় মানুষ বুঝতেই পারে না যে তারা কীভাবে ম্যানিপুলেট হচ্ছে। এখানকার পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ। মব সৃষ্টি হচ্ছে এখন সোশ্যাল মিডিয়াতেই। কাউকে ট্রোল করা, হেয় করার একটি বড় প্ল্যাটফর্ম হয়ে দাঁড়িয়েছে ফেসবুক। সেই ব্যক্তির কার্যকলাপ বা আসল ঘটনা জানার আগেই ছড়িয়ে পড়ছে নেতিবাচক খবর। এছাড়া-
রাজনৈতিক মিথ্যাচার: একপক্ষীয় কনটেন্ট ছড়িয়ে দিয়ে জনমত নিয়ন্ত্রণ করা হয় সহজ হয়ে পড়েছে।ধর্মীয় উসকানি বেছে বেছে হিংসাত্মক পোস্ট দেখানো হচ্ছে নির্দিষ্ট গোষ্ঠীকে নিশানা করে।কিশোরদের মানসিক অবনতি: গ্ল্যামারাইজড কনটেন্ট দেখিয়ে তাদের মধ্যে হতাশা ও আত্মসমালোচনার প্রবণতা বাড়াচ্ছে।
ভুয়া খবর ও গুজব: প্রচুর ভুয়া লিংক ও ভিডিও দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে কারণ এআই বুঝে যায় আপনি এই ধরনের কনটেন্টে ক্লিক করছেন।
কীভাবে এড়ানো যায় এই ক্ষতি?>> ফেসবুক অ্যাপে সব ধরনের অপ্রয়োজনীয় পারমিশন বন্ধ করুন। যেমন-লোকেশন, মাইক্রোফোন, ক্যামেরা, ফোন লিস্ট সব পারমিশন রিভিউ করুন।
>> নোটিফিকেশন বন্ধ রাখুন যতটুকু সম্ভব। ফেসবুক নোটিফিকেশনের মাধ্যমে মস্তিষ্ককে ট্রিগার করে।
>> নিয়মিত ডিজিটাল ডিটক্স করুন। দিনে নির্দিষ্ট সময়ের বেশি ব্যবহার না করার অভ্যাস গড়ে তুলুন।
>> ভিন্ন মতাদর্শের কনটেন্ট দেখুন। একপক্ষীয় তথ্য দেখলে নিজেই সার্চ করে যাচাই করুন।
>> প্রাইভেসি সেটিংস সর্বদা আপডেট রাখুন। ফেসবুকের প্রতিটি প্রাইভেসি সেটিং বুঝে বুঝে কাস্টমাইজ করুন।
>> সচেতন হোন, পরিবার-বন্ধুবান্ধবকে সচেতন করুন। সচেতনতাই সাইবার নিরাপত্তার প্রথম ধাপ।
ফেসবুক আমাদের জীবনে ইতিবাচক প্রভাবও ফেলেছে, তবে এর ‘অন্ধকার দিকটা’ অনস্বীকার্য। বাংলাদেশে এই বিষয় নিয়ে গবেষণা, সাংবাদিকতা এবং জনসচেতনতা কার্যক্রম বাড়ানো প্রয়োজন। নয়তো আমরা একটি লক্ষহীন ডিজিটাল দাসত্বের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি যেখানে আমরা নিজেরাই জানি না কে আমাদের নিয়ন্ত্রণ করছে।
আরও পড়ুনফেসবুক অ্যাকাউন্টকে পেজে রূপান্তরিত করবেন যেভাবেরিলস হিসেবে দেখাবে ফেসবুকের সব ভিডিওলেখক: শিক্ষার্থী, বিএসসি ইন সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ারিং, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি
কেএসকে/জেআইএম