দেশজুড়ে

প্রতি বছর মেরামত, প্রতি বছর বাঁধে ভাঙন

প্রতি বছর মেরামত, প্রতি বছর বাঁধে ভাঙন

• ৮ বছরে বাঁধ মেরামতে খরচ সাড়ে ৭ কোটি টাকা • ক্ষতি থামাতে হয় না স্থায়ী সমাধান• বন্যার আগে খোঁজ থাকে না পাউবোর• নতুন বাঁধ সেনাবাহিনীকে দিয়ে করার কথা ভাবছে সরকার

Advertisement

বছরের পর বছর ফেনীর হাজার হাজার পরিবারের করুণ দশার কারণ এখন বাঁধ। প্রতি বছর মেরামত হলেও মেলে না স্থায়ী সমাধান। প্রতিবারই আশ্বাস দিয়ে দায় এড়িয়ে যায় সংশ্লিষ্টরা। ২০১৭ সাল থেকে এখন পর্যন্ত প্রায় সাড়ে ৭ কোটির বেশি টাকা গচ্ছা গেছে শুধু মেরামতেই। ২০২৪ এর ভয়াবহ বন্যার বছর না যেতেই আবারো একই দশা।

নদীর বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ ভেঙে এখনো জনপদে ঢুকছে পানি। গত ৭ জুলাই রাত থেকেই শুরু হয় এই ভাঙন। পানির প্রবল তোড়ে তছনছ হয় চারপাশ। চোখের নিমিষেই গ্রামের পর গ্রাম তলিয়ে যায়, পানিবন্দি হন ১১২টি গ্রামের হাজার হাজার মানুষ। পানি নেমে যেতেই ফুটে উঠেছে ফেনীর উত্তরের উপজেলা ফুলগাজী, পরশুরাম, ছাগলনাইয়া ও সদরের শত শত পরিবারের করুণ চিত্র। দৃশ্যমান হচ্ছে ক্ষতচিহ্ন।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, মুহুরী, কহুয়া ও সিলোনিয়া নদী প্রতি বছর এই জনপদের লাখো পরিবারের জন্য দুঃখ নিয়ে আসে। অথচ এসব নদীর আগ্রাসন থেকে রক্ষায় ২০০৪-০৫ অর্থবছরে ১৩৭ কোটি টাকা ব্যয়ে ১২২ কিলোমিটার অংশে মাটি দিয়ে দীর্ঘ বাঁধ নির্মাণ শুরু করে পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো)। ২০১১ সালে বাঁধের নির্মাণকাজ শেষ হলে পরের কয়েক বছর বন্যামুক্ত ছিল স্থানীয়রা।

Advertisement

‘আমার মনে পড়ে না, কখনো পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্তারা এসে বাঁধ দেখে গেছেন। শুধু বাঁধ ভেঙে বন্যা হলে পাউবোর কর্মকর্তারা এসে হাঁকডাক ছাড়েন।’

কিন্তু ২০১৩ সালে বাঁধের ৩ স্থানে ভেঙে যায়। পরে তা মেরামত করা হয়। এরপর প্রতিবছর ভাঙে বাঁধের বিভিন্ন স্থান। সেই বাঁধ ভাঙার কারণেই প্রতিবছর পড়তে হয় বন্যার কবলে। ভোগান্তি পোহাতে হয় প্রতি বর্ষা মৌসুমে। ক্ষতি ছাড়িয়ে যায় কোটি টাকার।

হিসাব বলছে, ২০১৭ সাল থেকে প্রতি বছর ভাঙনে সাড়ে ৭ কোটির বেশি টাকা খরচ হয়েছে বাঁধ মেরামতে। অথচ কোনো সংস্কারই টেকসই হয়নি।

পাউবোর তথ্য মতে, ২০১৭-১৮ সালে ৭টি ভাঙন মেরামতে ব্যয় হয় ৩৯ লাখ ১২ হাজার টাকা, ২০১৮-১৯ সালে ২২টি মেরামতে ১ কোটি ৬৯ লাখ ২০ হাজার টাকা, ২০১৯-২০ সালে ১৫টি মেরামতে ২৯ লাখ ৮৩ হাজার টাকা, ২০২০-২১ সালে ৮টি মেরামতে ১ কোটি ১৫ লাখ টাকা, ২০২১-২২ সালে ১৫টি ভাঙন স্থান মেরামতে ১ কোটি ৬১ লাখ টাকা, ২০২২-২৩ সালে ৬টি ভাঙন স্থান মেরামতে ৭১ লাখ টাকা ও ২০২৩-২৪ সালে ৯টি ভাঙন স্থান মেরামতে ১ কোটি ৩৩ লাখ টাকা ব্যয় হয়।

Advertisement

‘প্রতিবছর বাঁধের সংস্কার কাজ করলেও টেকসই হয় না। সংস্কারের পরও বাঁধের একই স্থান বার বার ভাঙছে। বাঁধ সংস্কারে দুর্নীতির কারণেই সমস্যার স্থায়ী সমাধান হচ্ছে না।’

তবুও শুধু ২০২৪ সালের ভয়াবহ বন্যায় জেলার বিভিন্ন খাতের ক্ষতি হয় ৩ হাজার কোটি টাকার বেশি। তাই স্থায়ী বাঁধ নির্মাণের দাবি এলাকাবাসীর।

আরও পড়ুন- ফেনীতে বাঁধ নির্মাণ প্রকল্প সেনাবাহিনীকে দেওয়ার কথা ভাবছে সরকার পানি কমতেই বেরিয়ে আসছে বন্যার ক্ষত ফেনীতে এখনো নিমজ্জিত সাড়ে ৫ হাজার হেক্টর জমির ফসল ফেনীতে বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি, ধীরগতিতে কমছে পানি

স্থানীয় লোকজনের অভিযোগ, বেড়িবাঁধ সংস্কারে বিভিন্ন পর্যায়ে দুর্নীতি হচ্ছে। এ কারণে সুফল মিলছে না। এছাড়া পাউবোর কর্মকর্তারা ঠিকভাবে মাঠপর্যায়ে কাজ করেন না। প্রতিবছর বন্যায় বাঁধের কী পরিমাণ স্থান ভাঙতে পারে, পানি উন্নয়ন বোর্ড তা আগ থেকে নির্ধারণ করে ব্যবস্থা নেয় না। মাঠপর্যায়ে কর্মকর্তারা যদি নিয়মিত বাঁধের স্থানগুলো পরিদর্শন করে ঝুঁকিপূর্ণ স্থান নির্ধারণ করতেন, তাহলে বন্যার আগে স্থানীয় লোকজন সতর্ক হতে পারতেন। জানমালের ক্ষতি কমতো।

মুহুরী নদীর বাঁধ সংলগ্ন বাসিন্দা আবদুল হক বলেন, আমার মনে পড়ে না, কখনো পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্তারা এসে বাঁধ দেখে গেছেন। শুধু বাঁধ ভেঙে বন্যা হলে পাউবোর কর্মকর্তারা এসে হাঁকডাক ছাড়েন।

পরশুরামের বাসিন্দা আবু ইউসুফ বলেন, প্রতিবছর বাঁধের সংস্কার কাজ করলেও টেকসই হয় না। সংস্কারের পরও বাঁধের একই স্থান বার বার ভাঙছে। বাঁধ সংস্কারে দুর্নীতির কারণেই সমস্যার স্থায়ী সমাধান হচ্ছে না। বন্যার আগে বাঁধের ঝুঁকিপূর্ণ স্থান নির্ণয় করে ব্যবস্থা গ্রহণ কিংবা বন্যা-পরবর্তী বাঁধের সংস্কার কাজের গুণগত মান যাচাই করা বোর্ডের কর্মকর্তাদের দায়িত্ব। অথচ সেই দায়িত্ব তারা পালন করছেন না।

‘টানা বর্ষণে সৃষ্ট বন্যায় বাঁধের কতগুলো স্থান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তার তথ্য পানি উন্নয়ন বোর্ড থেকে জেলা প্রশাসনকে যেভাবে দেওয়া হয় সেভাবে প্রশাসন গণমাধ্যমকে সরবরাহ করে।’

ফেনীর অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক ইসমাইল হোসেন বলেন, টানা বর্ষণে সৃষ্ট বন্যায় বাঁধের কতগুলো স্থান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তার তথ্য পানি উন্নয়ন বোর্ড থেকে জেলা প্রশাসনকে যেভাবে দেওয়া হয় সেভাবে প্রশাসন গণমাধ্যমকে সরবরাহ করে।

গাফিলতির কথা অস্বীকার করে ফেনী পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী আকতার হোসেন মজুমদার বলেন, পানি থাকায় ভাঙনের প্রকৃত চিত্র পাওয়া যায়নি। আগে শুধু ভাঙন স্থলের সংখ্যা জানতে পেরেছি। শুক্রবার থেকে পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তারা সরেজমিন ঘুরে ভাঙনের চূড়ান্ত পরিসংখ্যান দিয়েছেন। সেজন্য ৪ দিন ধরে ২০টি ভাঙনের তথ্য থাকলেও এখন বেড়ে হয়েছে ৩৬টি।

এদিকে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ফারুক ই আজম গত শনিবার বন্যা পরিস্থিতি পরিদর্শনে এসে বলেন, মুহুরী ও কহুয়া নদীর দুই তীরের ১২২ কিলোমিটার বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের পুরোটাই ঝুঁকিপূর্ণ। তাই ৭,৩৪০ কোটি টাকার নতুন প্রকল্প সেনাবাহিনীকে দিয়ে বাস্তবায়ন করার কথা ভাবছে সরকার।

এফএ/এএসএম