স্বাস্থ্য

দক্ষ নার্স পাঠাতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করেছি

দক্ষ নার্স পাঠাতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করেছি

উজমা চৌধুরী। দেশের অন্যতম শিল্পগোষ্ঠী প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের পরিচালক (ফাইন্যান্স)। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্রের ডালাসের ইউনিভার্সিটি অব টেক্সাস থেকে অ্যাকাউন্টিংয়ে স্নাতক করেছেন। টেক্সাসে নিবন্ধিত সার্টিফায়েড পাবলিক অ্যাকাউন্ট্যান্ট তিনি। যুক্তরাষ্ট্রের পেট্রোলিয়াম শিল্পে সাত বছরের বেশি সময় কাজ করার অভিজ্ঞতা তার। আমেরিকান উইমেন্স সোসাইটি ফর সিপিএ-র হিউস্টন চ্যাপ্টারের সেক্রেটারি হিসেবে চার বছর দায়িত্ব পালন করেছেন উজমা চৌধুরী। ব্যবসা-বাণিজ্যের পাশাপাশি তিনি সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের শিক্ষা কর্মসূচি (ইউসেপ) বাংলাদেশের বোর্ড অব গভর্নরসের ভাইস চেয়ারপারসন এবং মেট্রোপলিটন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজেরও (এমসিসিআই) পরিচালক।

Advertisement

উজমা চৌধুরী বেশ কয়েক বছর ধরে কাজ করছেন স্বাস্থ্য খাতে। তার বাবার নামে নাটোরে ‘আমজাদ খান চৌধুরী মেমোরিয়াল হাসপাতাল’ করেছে প্রাণ-আরএফএল গ্রুপ। ২০২০ সালে প্রতিষ্ঠা করা হয় ‘আমজাদ খান চৌধুরী নার্সিং কলেজ’। এরই মধ্যে উত্তরবঙ্গে আলো ছড়াচ্ছে এ প্রতিষ্ঠানটি। ২৫ জন শিক্ষক-শিক্ষিকা এবং ১৮ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী ও স্মার্ট ল্যাবে সমৃদ্ধ এ প্রতিষ্ঠানে অধ্যয়ন করে নার্স হতে যাচ্ছেন ১৩০ জন।

ভবিষ্যতে আমরা প্রচুর সম্ভাবনা দেখছি। নার্সদের বিদেশে পাঠানোর সম্ভাবনা আসছে। আমরা সেটা কাজে লাগাতে চাই। দেশ-বিদেশে প্রশিক্ষিত জনবল সরবরাহ করে মানুষের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন ও দেশের জন্য বৈদেশিক আয় বাড়াতে চাই।

নাটোরে গিয়ে হাসপাতাল, নার্সিং কলেজ, দক্ষ জনশক্তি তৈরিসহ বিভিন্ন বিষয়ে কথা হয় আমজাদ খান চৌধুরী নার্সিং কলেজের গভর্নিংবডির চেয়ারম্যান উজমা চৌধুরীর সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন জাগো নিউজের জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক সালাহ উদ্দিন জসিম।

Advertisement

সাক্ষাৎকারে উজমা চৌধুরী বলেন, বাবার স্বপ্ন পূরণে জন্মস্থানে তাদের এ উদ্যোগ। কিছুটা পিছিয়ে থাকা এ অঞ্চলকে এগিয়ে দিতে চান। নাগরিকদের দক্ষতা দিয়ে জীবনমান উন্নত করতে চান। এজন্য দেশ-বিদেশের উপযোগী করে গড়ে তুলতে নার্সিং কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন।

জাগো নিউজ: এত এত ব্যবসার মধ্যে হাসপাতাল সেবায় যুক্ত হলেন কেন?

উজমা চৌধুরী: আমার বাবা ও আমরা নাটোরে বড় হয়েছি। আমাদের মূল কারখানা নাটোরে। আমাদের এগ্রিকালচার পণ্য নাটোর থেকেই কিনি। বিশেষ করে, যে আমের জুস দিয়ে পৃথিবীতে জাগরণ তৈরি করতে পেরেছি, সেটা কিন্তু নাটোরের পণ্য। আমার বাবার স্বপ্ন ছিল এই নাটোরে একটি হাসপাতাল করার, যাতে এখানকার মানুষদের স্বল্পমূল্যে স্বাস্থ্যসেবা দেওয়া যায়। সেজন্য জমিও কিনে রেখে যান। আমরা সেখানেই হাসপাতাল গড়ে তুলেছি, এখনো চালাচ্ছি।

উত্তরবঙ্গ বা নাটোর জেলার নারীদের স্বাবলম্বী হওয়ার সুযোগ। এটা করে বিদেশেও যেতে পারবে। দেশে বসেও ভালো আয় করতে পারবে। পরিবারকে সহায়তা করতে পারবে।

Advertisement

এটা চালাতে গিয়ে আমরা বড় ধাক্কা খেলাম। দেখলাম দেশে শিক্ষিত ও প্রশিক্ষিত নার্সের অভাব। এজন্য আমরা মেডিকেল কলেজ না করে নার্সিং কলেজ দিয়ে শুরু করেছি। কারণ, আমাদের মনে হয়েছে স্বাস্থ্যসেবার জন্য নার্সিংটাই বেশি প্রয়োজন।

আরও পড়ুন নাটোরে আমজাদ খান চৌধুরী নার্সিং কলেজের যাত্রা  কৃতী শিক্ষার্থীদের সংবর্ধনা দিলো আমজাদ খান চৌধুরী নার্সিং কলেজ  ফলাফল বিপর্যয়/বেসরকারি নার্সিং কলেজে ভর্তি হতে পারছেন না শিক্ষার্থীরা 

আমাদের দেশে নার্সিং সেবাটা উপেক্ষিত। ডাক্তারদের আমরা সবাই খুব বড় চোখে দেখি অথচ ডাক্তার একটা রোগীকে দেখেন সপ্তাহে একবার বা খুব বেশি প্রয়োজন হলে সপ্তাহে দুবার দেখতে পারেন। কিন্তু একজন রোগীকে সুস্থ করে তুলতে ২৪ ঘণ্টা নার্সের প্রয়োজন হয়।

জাগো নিউজ: নার্সিং কলেজে কী পরিমাণ বিনিয়োগ হয়েছে, কোন পর্যায়ে নিতে চান? উজমা চৌধুরী: হাসপাতাল ও নার্সিং ওতপ্রোতভাবে জড়িত। নার্সিং শিক্ষাটা হাতে-কলমে শিক্ষার বিষয়। তাই হাসপাতালের পাশেই আমরা একটি তিনতলা ভবন করেছি। সেখানে কিছু ল্যাব আছে। এছাড়া আমাদের হাসপাতালের অস্ত্রোপচার, রেডিওলজিসহ যে জিনিসগুলো বেসিক দরকার সেখানে সুযোগ রাখছি হাতে-কলমে শেখার জন্য। নার্সিং কলেজে আমাদের বিনিয়োগ ১০ কোটি, আর হাসপাতালে ২০ কোটি টাকা। এটা দিয়েই আমরা তাদের গড়ে তুলতে পারছি।

বর্তমানে আমাদের দেশের অনেক ছাত্র যারা এইচএসসি পড়ে বের হচ্ছে, তাদের একটা স্কিল ডেভেলপমেন্টের মাধ্যমে যদি বিদেশে পাঠাতে পারি, তাহলে তাদের ঝাড়ুদার হিসেবে যেতে হবে না। লেবার হিসেবে যেতে হবে না। তাদের স্কিলড করে আরেকটু উন্নত জায়গায় পাঠাতে পারবো।

ভবিষ্যতে আমরা প্রচুর সম্ভাবনা দেখছি। নার্সদের বিদেশে পাঠানোর সম্ভাবনা আসছে। আমরা সেটা কাজে লাগাতে চাই। দেশ-বিদেশে প্রশিক্ষিত জনবল সরবরাহ করে মানুষের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন ও দেশের জন্য বৈদেশিক আয় বাড়াতে চাই।

জাগো নিউজ: পাস করা নার্সদের বিদেশে সংযোগ করে দেওয়ার জন্য আপনাদের কোনো উদ্যোগ আছে কি না? উজমা চৌধুরী: আমরা ফরেন মার্কেটের সঙ্গে সংযোগ স্থাপনের চেষ্টা করছি। সৌদি আরবের সঙ্গে কথা বলেছি। অনেক দেশে আমাদের সেলস হাব আছে, সেখানে মানুষ যায়, আমরা চাকরি দিচ্ছি। আমরা আরও আলোচনার মাধ্যমে সেসব জায়গায় কাজের সুযোগ তৈরির চেষ্টা করছি। যেমন কাতার, সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাতে আমরা সম্ভাবনা দেখতে পাচ্ছি। তবে সৌদি-বাংলা চেম্বার অব কমার্সের মাধ্যমে আমরা একধাপ এগিয়ে আছি। তাদের সঙ্গে আমাদের আলোচনা চলমান।

অন্য দেশগুলোর সঙ্গেও আমরা কথা বলা শুরু করেছি। তবে এখনো বলার মতো কিছু হয়নি। আমাদের প্রধান উপদেষ্টাও কদিন আগে জাপান সফর করে আসছেন, সেখানেও তিনি অনেক সম্ভাবনা দেখতে পেয়েছেন। ওনার যে নার্সিং ইনস্টিটিউট আছে, সেখান থেকে বিদেশ যাওয়া শুরু হয়েছে। আমরা যদি নার্স গড়ে তুলতে পারি, নাটোরসহ উত্তরবঙ্গ থেকে যাওয়ার ভালো সুযোগ দেখছি।

জাগো নিউজ: তাহলে তো আপনাদের চিন্তা অনেক বড়, কিন্তু নাটোরের মতো জায়গায় এত শিক্ষার্থী কোথায় পাবেন?

উজমা চৌধুরী: আমাদের নাটোরের প্রাণ ফ্যাক্টরিতে ১২ হাজার কর্মী। এর মধ্যে সাড়ে ৯ হাজার নারী। এদের সন্তানরা তথা আমাদের নতুন প্রজন্ম যদি এখানে পড়ালেখা করে, এর বাইরে আশপাশের জেলা থেকেও যদি আসে, তাদের পরিবারের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের পথ আমরা শিখিয়ে দিতে চাই।

আপনারা জানবেন, আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে আমাদের এই উত্তরবঙ্গে এখনো অন্য জায়গার তুলনায় একটু পিছিয়ে। এখনো বিদেশে কম লোক যায়। আমাদের ব্যবসা-বাণিজ্যের সংখ্যা কম। লেখাপড়া শিখে বড় হওয়ার সুযোগ কম। অথচ তাদের কিন্তু ক্যাপাবিলিটি আছে। তারা আরও ভালো কাজ করতে পারে, ওয়ার্কার লেভেল থেকে উঠতে পারে।

তাদের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের জন্য স্কিল ডেভেলপ করে দেওয়া দরকার। এমন একটা প্রফেশন দেওয়া দরকার যেটা থেকে এমনভাবে আয় করতে পারে, যাতে একটা পরিবার ভালোভাবে চলতে পারে। যেহেতু আয় কম, পরিবারের নারীর কথা বলা বা সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতাও কম আমি মনে করি, নার্সিং পেশা হতে পারে এই উত্তরবঙ্গ বা নাটোর জেলার নারীদের স্বাবলম্বী হওয়ার সুযোগ। এটা করে বিদেশেও যেতে পারবে। দেশে বসেও ভালো আয় করতে পারবে। পরিবারকে সহায়তা করতে পারবে।

আজকের দিনে আমরা বিদেশে পাঠাচ্ছি নির্মাণশ্রমিক, ঝাড়ুদার, গৃহকর্মী। বিদেশে নার্সের প্রচুর চাহিদা রয়েছে। কেন নার্স পাঠাচ্ছি না? নারীদের সঙ্গে নিয়ে প্রাণ আজ পৃথিবীর অন্যতম সেরা এগ্রিকালচারাল কোম্পানি হতে পেরেছে। সেই নারীদের কিন্তু ক্যাপাসিটি আছে। আমাদের দরকার, তাদের স্কিল ধরে দেওয়া, তাদের অ্যাটিচিউডটা ডেভেলপ করা, তাহলে তারা বিদেশে গিয়ে ভালো পয়সা আয় করতে পারবে।

জাগো নিউজ: নারীরা তো বিদেশ যেতে অনাগ্রহী, পুরুষদের কি সুযোগ আছে? উজমা চৌধুরী: অবশ্যই আছে। সেটার জন্য আমাদের বড় আরেকটা ইনস্টিটিউট করতে হবে। আরও বেশি নার্স তৈরি করে বিদেশ যাওয়ার উপযোগী করে গড়ে তোলা প্রয়োজন। এজন্য আন্তর্জাতিক কোনো প্রতিষ্ঠানের অ্যাফিলিয়েটেড সনদ হাতে তুলে দিতে পারলে, সে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে নিজের পথ তৈরি করে নিতে পারবে। তাকে স্কিল করাটা আমাদের দায়িত্ব, বাকি কাজটুকু সে নিজেই করতে পারবে। আমাদের প্রতিটি ফ্যাক্টরির সঙ্গে হাসপাতাল আছে। সেখানেও নার্সদের প্রশিক্ষণের সুযোগ আছে।

এখন নার্সিং কলেজে সরকারি নিয়মে ৮০ শতাংশ মেয়ে নিতে হয়। ছেলে ২০ শতাংশ। আমরা নারী নিতে আগ্রহী। আমরা মেয়েদের গড়ে তুলবো। কিন্তু বর্তমানে আমাদের দেশের অনেক ছাত্র যারা এইচএসসি পড়ে বের হচ্ছে, তাদের একটা স্কিল ডেভেলপমেন্টের মাধ্যমে যদি বিদেশে পাঠাতে পারি, তাহলে তাদের ঝাড়ুদার হিসেবে যেতে হবে না। লেবার হিসেবে যেতে হবে না। তাদের স্কিলড করে আরেকটু উন্নত জায়গায় পাঠাতে পারবো। বাংলাদেশ থেকে প্রচুর ডাক্তার বিদেশে যান। প্রচুর ব্যবসায়ী যান। ছাত্রদের স্কিলড করে পাঠাতে পারলে তারা বাংলাদেশকে আরও স্বাবলম্বী করতে পরবে বৈদেশিক আয়ের মাধ্যমে।

জাগো নিউজ: নার্সিং কলেজ করে কী কী চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়েছেন?

উজমা চৌধুরী: নার্স তৈরিতে বাংলাদেশে সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো- সামাজিকভাবে আমরা নার্সের পেশাটা খাটো করে দেখি। নার্স পেশায় সাধারণত মেয়েদের আনা হয়। এই মেয়েরা একেবারেই নিম্ন-মধ্যবিত্ত শ্রেণি থেকে আসা। এখানে পরিবর্তন চাইলে সামাজিকভাবে নার্সের মর্যাদা দিতে হবে এবং এর প্রয়োজনীয়তা বোঝাতে হবে। এর বাইরেও কিছু সমস্যা আছে, প্রক্রিয়া বা পদ্ধতিগত। আশা করি সরকার ও অংশীজনের সহায়তায় আমরা ধীরে ধীরে সেগুলো কাটিয়ে উঠতে পারবো।

এসইউজে/এএসএ/এমএফএ/জিকেএস