বিমা কোম্পানির চেয়ারম্যান কোম্পানি থেকে নিজস্ব স্বার্থ হাসিলের জন্য তাদের অনাগত ব্যক্তিদের মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) পদে নিয়োগ করেন। কয়েকটি কোম্পানিতে আইন লঙ্ঘন করে কেউ কেউ সিইওর দায়িত্ব পালন করছেন। এসব বিমা কোম্পানি ও সিইওদের বিরুদ্ধে কঠোর কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছে না নিয়ন্ত্রক সংস্থা বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ (আইডিআরএ)।
Advertisement
নিয়ন্ত্রক সংস্থার এমন কার্যক্রম বিমা কোম্পানিগুলোকে দুর্নীতিতে উৎসাহিত করছে বলে উঠে এসেছে রাষ্ট্রীয় একটি গোপন প্রতিবেদনে।
সরকারের একটি গোয়েন্দা সংস্থার তৈরি করা এ প্রতিবেদন সম্প্রতি প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় থেকে অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগে পাঠানো হয়েছে। প্রতিবেদনটির সঙ্গে একটি চিঠি যুক্ত করে আইন লঙ্ঘন করে পাঁচ বিমা কোম্পানিতে চলতি দায়িত্ব পালনকারী সিইও এবং বিমা কোম্পানিগুলোর বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে। প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় থেকে পাওয়া প্রতিবেদন ও চিঠি আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ থেকে আইডিআরএ-কেও পাঠানো হয়েছে।
আমাদের কোম্পানিতে নিয়মিত সিইও আছেন। আপনারা কোন প্রতিবেদনের তথ্য ধরে বলছেন তা আমি বলতে পারবো না।- মার্কেন্টাইল ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্সের চেয়ারম্যান সাজ্জাদ মোস্তাফা
Advertisement
গোয়েন্দা প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, বিমা আইন, ২০১০ এর ৮০(৪) ধারা অনুযায়ী, বিমা কোম্পানির মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তার (সিইও) পদ একাধারে তিন মাসের অধিক সময়ের জন্য শূন্য রাখার বিধান নেই। তবে কর্তৃপক্ষ অপরিহার্য পরিস্থিতি বিবেচনায় উক্ত সময়সীমা আরও তিন মাস বর্ধিত করতে পারবে।
আরও পড়ুন বিমা কোম্পানিতে চলতি পদে সিইও নিয়োগ দেওয়া যাবে না অনিয়ম-দুর্নীতি করা কোম্পানির চেয়ারম্যান-পরিচালকরাই প্রার্থী সিইও নিয়োগে অনিয়ম, গার্ডিয়ান লাইফকে জরিমানাবিমা আইন-২০১০ এর ৮০(৫) ধারা মোতাবেক, নির্ধারিত সময়ের মধ্যে বিমা কোম্পানির সিইও পদ পূরণ করা না হলে কর্তৃপক্ষ প্রশাসক নিয়োগ করতে পারবে। কিন্তু গার্ডিয়ান লাইফ, সোনালী লাইফ, মার্কেন্টাইল ইসলামী লাইফ, কন্টিনেন্টাল ইন্স্যুরেন্স ও রূপালী ইন্স্যুরেন্সে চলতি দায়িত্বে থাকা মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তার মেয়াদকাল অতিবাহিত হওয়ার পরেও বিমা আইন লঙ্ঘন করে নিয়মবহির্ভূতভাবে এখনো চলতি দায়িত্ব পালন করছেন বলে প্রতিবেদনে উঠে এসেছে।
আসলে পাঁচটি কোম্পানি না, ১৯টি কোম্পানিতে সিইও নেই। সিইও সংকট তৈরি হয়েছে। এর বিভিন্ন কারণে আছে। সিইও নিয়োগের প্রবিধানমালা খুব বেশি মাত্রায় রেস্ট্রিকটেড হওয়ায় সিইও তৈরি হচ্ছে না এ সেক্টরে।-আইডিআরএর মুখপাত্র সাইফুন্নাহার সুমি
এর মধ্যে গার্ডিয়ান লাইফে শেখ রাকিবুল করিম ২০২১ সালের ১ জানুয়ারি থেকে চলতি দায়িত্ব পালন করছেন। অর্থাৎ, চার বছর ৫ মাস ধরে তিনি চলতি দায়িত্ব পালন করছেন। সোনালী লাইফে চলতি দায়িত্ব পালন করছেন মো. রফিকুল ইসলাম। তিনি ২০২৪ সালের ২ সেপ্টেম্বর থেকে এ দায়িত্ব পালন করছেন। মার্কেন্টাইল ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্সে ২০২৪ সালের ১ জুলাই থেকে সিইও পদে চলতি দায়িত্বে রয়েছেন এস কে আব্দুর রশিদ।
Advertisement
এছাড়া কন্টিনেন্টাল ইন্স্যুরেন্সে মোশাররফ হোসেন ২০২৪ সালের ১০ অক্টোবর থেকে সিইও পদে চলতি দায়িত্ব পালন করছেন। রূপালী ইন্স্যুরেন্সের সিইও পদে চলতি দায়িত্বে রয়েছেন ফৌজিয়া কামরুন তানিয়া। তিনি ২০২৩ সালের ২ জানুয়ারি থেকে দায়িত্ব পালন করছেন।
গোয়েন্দা প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, গার্ডিয়ান লাইফ চার বছরের বেশি সময় ধবে আইডিআরএর অনুমোদিত সিইও নিয়োগ না করায় চলতি বছরের ২৭ জানুয়ারি কোম্পানিটিকে পাঁচ লাখ টাকা জরিমানা করা হয় এবং শর্ত হিসেবে সিইও নিয়োগ করতে বলা হয় পরবর্তী ৬০ দিনের মধ্যে। কিন্তু ৬০ দিন অতিবাহিত হলেও বিমা কোম্পানিটি সিইও নিয়োগ করেনি। বিপরীতে আইডিআরএ এখন পর্যন্ত কোনো পদক্ষেপ নেয়নি।
রূপালী ইন্স্যুরেন্সও একইভাবে দুই বছরের বেশি সময় ধরে আইডিআরএর অনুমোদিত সিইও নিয়োগ না করায় চলতি বছরের ২৯ জানুয়ারি আইডিআরএ বিমা কোম্পানিটিকে পাঁচ লাখ টাকা জরিমানা করে এবং শর্ত হিসেবে পরবর্তী ৬০ দিনের মধ্যে সিইও নিয়োগ করতে বলা হয়। কিন্তু ৬০ দিন অতিবাহিত হলেও বিমা কোম্পানিটি সিইও নিয়োগ দেয়নি। বিপরীতে আইডিআরএ এখন পর্যন্ত কোনো পদক্ষেপ নেয়নি।
গোয়েন্দা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আইন লঙ্ঘন করে চলতি দায়িত্ব পালনকারী সিইও এবং বিমা কোম্পানিগুলোর বিরুদ্ধে আইডিআরএ কঠোর কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছে না মর্মে প্রতীয়মান। আইডিআরএর এ ধরনের কার্যক্রম বিমা কোম্পানিগুলোকে দুর্নীতিতে উৎসাহিত করছে।
এতে আরও বলা হয়েছে, বিমা কোম্পানিগুলোর চেয়ারম্যান কোম্পানি থেকে তাদের নিজস্ব স্বার্থ হাসিলের জন্য তাদের অনুগত ব্যক্তিদের সিইও পদে নিয়োগ দেয়। এক্ষেত্রে অনুগত ব্যক্তি যোগ্য না হলেও তাকে জরিমানা দিয়ে বছরের পর বছর সিইও পদে বহাল রাখা হয়। এখানে বিমা কোম্পানি যে টাকা জরিমানা দেয় তা সম্পূর্ণ গ্রাহকদের টাকা। ফলে গ্রাহক স্বার্থ ক্ষুণ্ন হওয়ার পাশাপাশি বিমা খাতের শৃঙ্খলা নষ্ট হচ্ছে।
প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, কয়েকটি বিমা কোম্পানিতে জরিমানা দিয়ে বছরের পর বছর অযোগ্য ব্যক্তিকে সিইও পদে বহাল রাখা হচ্ছে। ফলে অন্য বিমা কোম্পানিগুলোও তাদের অসৎ উদ্দেশ্য হাসিল করতে একই সুযোগ ব্যবহার করবে।
আইন লঙ্ঘন করায় সিইও এবং বিমা কোম্পানিগুলোর বিরুদ্ধে বিধি মোতাবেক ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য আইডিআরএকে নির্দেশনা/সুপারিশ করা যেতে পারে বলে গোয়েন্দা প্রতিবেদনে সুপারিশ করা হয়েছে।
এ বিষয়ে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের এক কর্মকর্তা বলেন, প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় থেকে পাওয়া গোয়েন্দা প্রতিবেদন আইডিআরএর কাছে পাঠানো হয়েছে এবং প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে বলা হয়েছে।
গার্ডিয়ান লাইফের চেয়ারম্যান স্যামুয়েল এস চৌধুরী এবং সোনালী লাইফের চেয়ারম্যান কাজী মনিরুজ্জামানের সঙ্গে কয়েক দফায় যোগাযোগের চেষ্টা করেও তাদের বক্তব্য পাওয়া যায়নি। তবে মার্কেন্টাইল ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্সের চেয়ারম্যান সাজ্জাদ মোস্তাফা জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমাদের কোম্পানিতে নিয়মিত সিইও আছেন। আপনারা কোন প্রতিবেদনের তথ্য ধরে বলছেন তা আমি বলতে পারবো না।’
আর রূপালী ইন্স্যুরেন্সে সিইও পদে দায়িত্ব পালন করা ফৌজিয়া কামরুন তানিয়ার সঙ্গে মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি ব্যস্ততা দেখিয়ে কথা বলতে অস্বীকৃতি জানান।
সার্বিক বিষয়ে আইডিআরএর মুখপাত্র সাইফুন্নাহার সুমির সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘আসলে পাঁচটি কোম্পানি না, ১৯টি কোম্পানিতে সিইও নেই। সিইও সংকট তৈরি হয়েছে। এর বিভিন্ন কারণে আছে। সিইও নিয়োগের প্রবিধানমালা খুব বেশি মাত্রায় রেস্ট্রিকটেড হওয়ায় সিইও তৈরি হচ্ছে না এ সেক্টরে। সামনে প্রবিধানমালা ঠিকঠাকভাবে তৈরি হলে এ সংকট কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হবে বলে মনে করছে কর্তৃপক্ষ (আইডিআরএ)।’
এমএএস/এএসএ/এমএফএ/জিকেএস