রাজশাহীতে একসময় বিয়ে, সামাজিক অনুষ্ঠান বা বাড়ির নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস ছিল কাঁসা-পিতলের। রাজশাহীর বাজারে কাঁসা- পিতলের পাত্রের প্রচলন ছিল ব্যাপক। চাহিদাও ছিল তুঙ্গে। কিন্তু সময়ের পরিক্রমায় সেই ঐতিহ্য আজ হারাতে বসেছে। বিশেষ অনুষ্ঠান ছাড়া তেমন বেচাবিক্রি নেই কাঁসা পণ্যের।
Advertisement
রাজশাহীর বাজারগুলোতে এখন আর আগের মতো কাঁসা পণ্যের বিক্রি নেই। অনেক দোকানপাটও বন্ধ হয়ে গেছে। তবে কেউ কেউ বাপ-দাদার ঐতিহ্য ধরে রেখেছেন এখনো।
‘১০ বছর আগে যেভাবে আমাদের দোকান থেকে কাঁসা-পিতল বিক্রি হতো, এখন আর সেভাবে বিক্রি নেই। দিন দিন ক্রেতা কমছে। আগে রাজশাহীতে কাঁসা-পিতলের কিছু কারখানা থাকলেও এখন আর নেই। ফলে চাঁপাইনবাবগঞ্জসহ আশপাশের জেলা থেকে পণ্য এনে বিক্রি করতে হচ্ছে। তবে তাতেও লাভ হচ্ছে না।’
রাজশাহীর সাহেব বাজারের মেসার্স সিয়াম মেটালিক হাউজ তাদের তিন পুরুষের ব্যবসা এখনো ধরে রেখেছে। আরডিএ মার্কেটের ভেতরে বেশ পুরোনো কাঁসার দোকান এটি। আগে অনেক দোকান থাকলেও এখন এটিই সবচেয়ে পুরোনো দোকান।
Advertisement
কথা হয় দোকানের মালিক ইরফান রহমানের সঙ্গে। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘এইটা আমার দাদার ব্যবসা। দাদার কাছ থেকে বাবা পেয়েছেন। বাবার কাছ থেকে আমি পেয়েছি। তবে আগের তুলনায় ব্যবসা মন্দা। প্লাস্টিক, সিরামিকস ও মেলামাইনের পণ্য পাওয়া এখন খুব সহজ। সেই তুলনায় কাঁসার দাম বেশি। ছাই-বালু ছাড়া পরিষ্কার করা যায় না। এজন্য কাঁসার ব্যবহার ও বিক্রি কম।’
আরও পড়ুন ঢাকার নগর জাদুঘর দেখতে যায় না ‘কেউ’ গ্রামবাংলার ম্লান হওয়া মুখচ্ছবি ফরিদপুরের এক যৌথ পরিবারে রোজ এক হাঁড়িতে রান্না হয় ৩০ জনের খাবার হারিয়ে যাচ্ছে গ্রামীণ ঐতিহ্যের মাটির ঘরইরফান রহমান বলেন, ‘আমাদের কারিগর সংকট আছে। নতুন করে কারিগর পাওয়া যায় না। যারা কাজ করেন তাদের মজুরিও কম। এসব জিনিসের চাহিদাও কম। নতুন প্রজন্ম চাই না। তবে আশার কথা হলো, আবার নতুন করে চাহিদা বাড়ছে।’
ব্যবসায়ী ইরফান রহমানের তথ্যমতে, রাজশাহীতে আগে ৫০-৬০টি কাঁসা-পিতলের দোকান ছিল। জেলা-উপজেলা পর্যায়েও দোকান ছিল। এখান আছে মাত্র পাঁচটি দোকান।
‘বর্তমানে কম দামের প্লাস্টিক ও মেলামাইনের পণ্য সহজলভ্য হয়ে পড়ায় সাধারণ মানুষ আর বেশি দামে কাঁসা-পিতলের জিনিসপত্র কিনতে চান না। একসময় বিয়ের উপহার হিসেবে কাঁসার থালা-বাসনের কদর থাকলেও এখন তার জায়গা নিয়েছে মেলামাইন ও অন্যান্য আধুনিক পণ্য।’
Advertisement
ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এখানো কিছু সনাতন ধর্মাবলম্বীদের বিয়ে অনুষ্ঠানে কাঁসা-পিতল পণ্যের চাহিদা আছে। থালা বাটি, গ্লাস বিক্রি হয়। তবে আগে মতো নয়।
রাজশাহীর বাজারে বর্তমানে ভালোমানের কাঁসা পণ্য দুই হাজার ৬৫০ টাকা ও একটু নিম্নমানের দুই হাজার টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। কাঁসা-পিতলের পাত্র ব্যবহার স্বাস্থ্যসম্মত বলেও জানান ব্যবসায়ীরা।
রাজশাহীর লক্ষ্মীপুর বাজারে কাঁসা পণ্যের ব্যবসায়ী ইলিয়াস হোসেন জাগো নিউজকে বলেন, ‘১০ বছর আগে যেভাবে আমাদের দোকান থেকে কাঁসা-পিতল বিক্রি হতো, এখন আর সেভাবে বিক্রি নেই। দিন দিন ক্রেতা কমছে। আগে রাজশাহীতে কাঁসা-পিতলের কিছু কারখানা থাকলেও এখন আর নেই। ফলে চাঁপাইনবাবগঞ্জসহ আশপাশের জেলা থেকে পণ্য এনে বিক্রি করতে হচ্ছে। তবে তাতেও লাভ হচ্ছে না।’
আরও পড়ুন বিলুপ্তির পথে বাড়িয়াদীর কোন্দা শিল্প গ্রামীণ বাংলার বিলুপ্তপ্রায় খেলা ঝুড়ি-কুলায় বাঁশের ঐতিহ্য টিকিয়ে রেখেছেন দুর্গা রাণীতিনি জানান, বর্তমানে কম দামের প্লাস্টিক ও মেলামাইনের পণ্য সহজলভ্য হয়ে পড়ায় সাধারণ মানুষ আর বেশি দামে কাঁসা-পিতলের জিনিসপত্র কিনতে চান না। একসময় বিয়ের উপহার হিসেবে কাঁসার থালা-বাসনের কদর থাকলেও এখন তার জায়গা নিয়েছে মেলামাইন ও অন্যান্য আধুনিক পণ্য। সরকারের পক্ষ থেকে প্রণোদনা ও কারিগরি সহায়তা পেলে এই ঐতিহ্যবাহী শিল্পটিকে বাঁচিয়ে রাখা সম্ভব।
কথা হয় রাজশাহীর সাহেব বাজরের দোকনে কাসার থালা কিনতে আসা আবু সুফিয়ানের সঙ্গে। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমার ভাগিনা হয়েছে। সামনে তার মুখে ভাত অনুষ্ঠান। আমার মায়ের শখ তাকে কাঁসার থালায় ভাত খাওয়াবে। তাই নিতে এলাম। একটি থালার দাম পড়লো ৮০০ টাকা।’
তিনি বলেন, ‘এগুলো আগে মা-বাবাকে ব্যবহার করতে দেখেছি। কিন্তু এখন আর কেউ এত দাম দিয়ে কিনতে চায় না। আমাদের বাড়িতে শখ করে দুই একটা কেনা হয়।’
এ বিষয়ে রাজশাহী ব্যবসায়ী সমন্বয় পরিষদের সাধারণ সম্পাদক সেকেন্দার আলী জাগো নিউজকে বলেন, ‘কাঁসা এক সময়কার বহুল ব্যবহৃত জিনিস। কিন্তু একটি সময় এটিকে নিয়ে মানুষ অপপ্রচার চালায়। তারা মনে করেন, এগুলো শুধু হিন্দুরাই ব্যবহার করে। এটি থেকেই এটির ব্যবহার কমে যায়। পাশপাশি ভারতেও পাচার হয়।’ তিনি বলেন, ‘এখন এটির চাহিদা কম। এজন্য প্রচার চালাতে হবে। মানুষকে বোঝাতে হবে এটি স্বাস্থ্যসম্মত।
ঐতিহ্যবাহী এই শিল্পের সুরক্ষায় সেকেন্দার আলী বলেন, অনেক কারিগর কাজ ছেড়ে দিয়েছেন। নতুন করে কাজ শেখানোর কেউ নেই। ফলে এটি বিলুপ্তির দিকেই যাচ্ছে। তবে আমাদের সবার উচিত সম্মিলিত প্রচেষ্টায় এটিকে আবারও ফিরিয়ে আনা।
এসআর/জিকেএস