জাতীয়

অপরাধী দ্রুত শনাক্তে নিয়ামক হয়ে উঠছে সিসিটিভির ফুটেজ

অপরাধী দ্রুত শনাক্তে নিয়ামক হয়ে উঠছে সিসিটিভির ফুটেজ

একটা সময় কোনো অপরাধ ঘটলে অপরাধী শনাক্তে বেগ পেতে হতো আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পাল্টে গেছে সেই চিত্র। প্রযুক্তির বিকাশের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এখন অপরাধ দমনে আরও দক্ষ হয়ে উঠেছে। বিশেষ করে ক্লোজড সার্কিট (সিসি) ক্যামেরা প্রযুক্তি ব্যবহারে অপরাধী শনাক্ত ও গ্রেফতার প্রক্রিয়া আগের তুলনায় অনেক সহজ হয়েছে। এতে দ্রুত সময়ে আইনের আওতায় আসছে অপরাধীরা।

Advertisement

রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় চুরি, ছিনতাই, খুন, সন্ত্রাসী হামলা কিংবা সংঘবদ্ধ অপরাধ চক্রে জড়িতদের শনাক্তে সিসি ক্যামেরা ফুটেজ এখন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দাবি, সিসি ক্যামেরায় ধরা পড়া দৃশ্যের ভিত্তিতে অপরাধীর পরিচয়, গতিপথ, এমনকি সহযোগীদেরও শনাক্ত করা যাচ্ছে দ্রুত সময়ের মধ্যে।

সম্প্রতি রাজধানীর কাকরাইল, মগবাজার ও গুলিস্তানে তিন পৃথক ছিনতাইয়ের ঘটনায় সিসি ক্যামেরার ফুটেজ বিশ্লেষণ করে ৭২ ঘণ্টার মধ্যে ছয় অপরাধীকে গ্রেফতার করে মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। অপরাধীদের মোটরসাইকেলের নম্বর, পোশাক ও মুখাবয়ব মিলিয়ে প্রযুক্তির সহায়তায় তাদের অবস্থান শনাক্ত করা সম্ভব হয়।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় বেশ কিছু সিসি ক্যামেরা নষ্ট করে ফেলে দুর্বৃত্তরা। এর মধ্যে মোহাম্মদপুর, বাড্ডা, রামপুরা, ভাটারা, মিরপুর, উত্তরা, মতিঝিল ও যাত্রাবাড়ী এলাকার বেশিরভাগ সিসি ক্যামেরা নষ্ট করে ফেলা হয়। ফলে এসব এলাকায় সংঘটিত অপরাধে জড়িতদের শনাক্তে বেগ পেতে হচ্ছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের।

Advertisement

ঢাকা মহানগর পুলিশের উচ্চপদস্থ এক কর্মকর্তা জানান, বর্তমানে রাজধানীর প্রধান সড়ক, মোড় ও গুরুত্বপূর্ণ স্থানে অনেক সিসি ক্যামেরা রয়েছে। ফলে যে কোনো ঘটনার পর পরই আমাদের পর্যাপ্ত ভিজ্যুয়াল তথ্য মেলে। এতে অপরাধী শনাক্ত ও গ্রেফতারে সময় কম লাগে। অনেক সময় অপরাধীরা মুখ ঢেকে রাখলেও হাঁটার ভঙ্গি, উচ্চতা, পোশাক বা অন্যান্য সূত্র ধরে প্রযুক্তির মাধ্যমে তাদের শনাক্ত করা সম্ভব হয়।

তবে প্রযুক্তির এই সুফল আরও কার্যকর করতে নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ, ভালো মানের ক্যামেরা স্থাপন এবং পর্যাপ্ত আলোর ব্যবস্থা থাকা জরুরি বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।

মগবাজারে চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে ছিনতাইয়ের দৃশ্য ধরা পড়ে সিসি ক্যামেরায়

২০১২ সালে ডিএমপি কমিশনারের উদ্যোগে রাজধানীতে সিসি ক্যামেরা স্থাপন প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়। ওই সময় সম্পূর্ণ বেসরকারি অর্থায়নে ‘ল অ্যান্ড অর্ডার কো-অর্ডিনেশন কমিটি’ বা এলওসিসি নামের একটি ট্রাস্ট গড়ে তোলা হয়। ট্রাস্টের অধীন গুলশান, বনানী, নিকেতন, বারিধারা ও ডিওএইচএস এলাকায় এক হাজার ৪০০ ক্যামেরা স্থাপন করা হয়। গুলশানে একটি আধুনিক মনিটরিং সেন্টার স্থাপন করে সেখান থেকেই করা হয় মনিটর। এছাড়া ডিএমপির অপারেশনস বিভাগ, আইসিটি বিভাগ ও এমআইএস শাখার মাধ্যমে নবাব আব্দুল গনি রোডে সেন্ট্রাল কমান্ড অ্যান্ড কন্ট্রোল সেন্টার থেকে মনিটর করা হয় সাত শতাধিক সিসি ক্যামেরা।

Advertisement

পুলিশ সদর দপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালে সিসি ক্যামেরার ফুটেজ বিশ্লেষণের মাধ্যমে এক হাজার ৪০০টির বেশি মামলার রহস্য উদঘাটন হয়েছে। আগের বছরের তুলনায় যা ৩৫ শতাংশ বেশি।

গুরুত্বপূর্ণ স্থান বিবেচনায় রাজধানীতে পাঁচ শতাধিক সিসি ক্যামেরা বসানোর পরিকল্পনা রয়েছে পুলিশের। আধুনিক প্রযুক্তির এসব ক্যামেরায় অপরাধী শনাক্তের ফেস ডিটেক্টর, গাড়ির নম্বর প্লেট চিহ্নিত করার প্রযুক্তি, স্বয়ংক্রিয় অ্যালার্ম সিস্টেমসহ ১১ ধরনের সুবিধা থাকবে। এ প্রকল্পের অন্যতম উদ্দেশ্য পুলিশের ডিজিটাল টহল নিশ্চিত করা।

তবে সিসিটিভির কার্যকারিতার পাশাপাশি কিছু সীমাবদ্ধতাও রয়েছে। অনেক সময় দুর্বল রেজ্যুলেশনের কারণে অপরাধীর মুখ স্পষ্ট দেখা যায় না। কেউ কেউ মুখ ঢেকে ক্যামেরার আওতা এড়িয়ে যায়। এছাড়া, কিছু এলাকায় এখনো পর্যাপ্ত সিসিটিভি কাভারেজ নেই।

আরও পড়ুনচাঁদা না দিলেই দোকান বন্ধ, ব্যবসায়ীদের মারধর‘আরে বেটা লাশ ফালাই রাখছি, দেখছ না? এইডা তোল’অ্যাপে ট্র্যাপ, টাকা গায়েব

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নগরজুড়ে সিসি ক্যামেরা স্থাপন ও রক্ষণাবেক্ষণ আরও জোরদার করা গেলে অপরাধ দমন অনেকটাই সহজ হবে। একই সঙ্গে জনগণের নিরাপত্তা নিশ্চিতেও এটি বড় ভূমিকা রাখবে।

১১ জুলাই শ্যামলীতে ছিনতাইয়ের দৃশ্য/ সিসিটিভি ফুটেজ থেকে নেওয়া

জানা গেছে, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় বেশ কিছু সিসি ক্যামেরা নষ্ট করে ফেলে দুর্বৃত্তরা। এর মধ্যে মোহাম্মদপুর, বাড্ডা, রামপুরা, ভাটারা, মিরপুর, উত্তরা, মতিঝিল ও যাত্রাবাড়ী এলাকার বেশিরভাগ সিসি ক্যামেরা নষ্ট করে ফেলা হয়। ফলে এসব এলাকায় সংঘটিত অপরাধে জড়িতদের শনাক্তে বেগ পেতে হচ্ছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের।

ডিএমপির এক কর্মকর্তা বলেন, অপরাধীরা অপরাধ করে সব সময় ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকার চেষ্টা করে। সিসিটিভি কাভারেজ রয়েছে এমন জায়গা এড়িয়ে চলার চেষ্টা করে তারা। কাভারেজ নেই এমন জায়গা বাছাই করে চুরি-ছিনতাই, হত্যা, মারামারিসহ নানান অপরাধ ঘটায়। এমন বেশ কয়েকটি ঘটনার কূলকিনারা করতে পারছেন না গোয়েন্দা পুলিশের কর্মকর্তারা। সিসিটিভি ফুটেজ দেখে অপরাধী শনাক্ত হলেও অনেক সময় তাদের গ্রেফতার করে আইনের আওতায় আনতে পারছেন না আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা। যদিও অপরাধ করে কেউ পার পাচ্ছে না। তদন্ত এবং বিভিন্ন বিষয় পর্যালোচনা করতে সময় লাগলেও তাদের আইনের আওতায় আনা হচ্ছে।

সিসি ক্যামেরা শুধু অপরাধ তদন্তেই নয়, অপরাধ প্রতিরোধেও বড় ভূমিকা রাখে। অপরাধীরা জানে তারা নজরদারির আওতায়- এটাই তাদের অনেক সময় অপরাধ করতে নিরুৎসাহিত করে। -সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল তানভীর হাসান জোহার

আরেক পুলিশ কর্মকর্তা জানান, গুলশান-বারিধারা ডিপ্লোম্যাটিক জোন হওয়ায় সেখানে সবচেয়ে বেশি সিসি ক্যামেরা বসানো হয়েছে। এই ক্যামেরার কারণে অনেক উপকারও পাচ্ছে পুলিশ। রাজধানীর অন্য এলাকার তুলনায় এ এলাকায় অপরাধও কম।

তিনি বলেন, রাজধানীর পল্লবী এলাকায় গত বছরের ১৬ মার্চ সন্ধ্যায় ফয়সাল নামের এক যুবককে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। সেই দৃশ্য ধরা পড়ে সিসি ক্যামেরায়। ক্যামেরা থেকে ছবি নিয়ে সহজেই খুনিদের গ্রেফতার করতে সক্ষম হয় র্যাব।

ডিএমপি সূত্র বলছে, গুরুত্বপূর্ণ স্থান বিবেচনায় রাজধানীতে পাঁচ শতাধিক সিসি ক্যামেরা বসানোর পরিকল্পনা রয়েছে পুলিশের। আধুনিক প্রযুক্তির এসব ক্যামেরায় অপরাধী শনাক্তের ফেস ডিটেক্টর, গাড়ির নম্বর প্লেট চিহ্নিত করার প্রযুক্তি, স্বয়ংক্রিয় অ্যালার্ম সিস্টেমসহ ১১ ধরনের সুবিধা থাকবে। এ প্রকল্পের অন্যতম উদ্দেশ্য পুলিশের ডিজিটাল টহল নিশ্চিত করা।

উত্তরায় কোটি টাকা ছিনতাইয়ে গ্রেফতার ৫১৪ জুন সকালে রাজধানীর উত্তরায় র্যাবের পোশাক পরে নগদের ডিস্ট্রিবিউটর আব্দুর রহমানের কাছ থেকে এক কোটি ১৮ লাখ ৭১ হাজার টাকা ছিনিয়ে নেয় দুর্বৃত্তরা। ঘটনার সিসি ক্যামেরার ফুটেজ বিশ্লেষণ ও তথ্যপ্রযুক্তির সহায়তায় জড়িত পাঁচজনকে গ্রেফতার করে পুলিশ। পাশাপাশি তাদের কাছ থেকে নগদ অর্থ ও ছিনতাইয়ের সময় ব্যবহৃত মাইক্রোবাস উদ্ধার করা হয়।

আরও পড়ুনআন্দোলন এখন গলার কাঁটা, ‘গণক্ষমা’ পেতে চান এনবিআর কর্মকর্তারাআগ্নেয়াস্ত্রের লাইসেন্স কীভাবে পাওয়া যায়, ব্যবহারের নিয়ম কীকড়া বার্তায়ও থামছে না ‘মব’, ১০ মাসে হত্যা ১৭৪

মগবাজারে ছিনতাইয়ের ঘটনায় গ্রেফতার ৩১৮ মে বিকেলে রাজধানীর মগবাজারে চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে এক শিক্ষার্থীর ব্যাগ ছিনতাইয়ের একটি ভিডিও ভাইরাল হয়। এ ঘটনার ১০ দিন পর জড়িত তিন ছিনতাইকারীকে গ্রেফতার করে পুলিশ। এছাড়া দুটি চাপাতি ও একটি মোটরসাইকেল উদ্ধার করে পুলিশ।

সিসি ক্যামেরা দেখে গ্রেফতার জোড়া খুনের আসামি৯ মে সাইকেল কেনার টাকার জন্য রাজধানীর শেওড়াপাড়ায় খালার বাসায় আসে ১৪ বছরের কিশোর মো. গোলাম রব্বানী খান ওরফে তাজ। খালার অগোচরে মানিব্যাগ থেকে তিন হাজার টাকা বের করার সময় ধরা পড়ে যায় তাজ। মাকে বলে দিতে চাওয়ায় টেবিলে রাখা ছুরি দিয়ে প্রথমে বড় খালাকে, পরে সেজো খালাকেও ছুরিকাঘাত করে সে। এরপর শিল দিয়ে আঘাত করে দুই খালাকে হত্যা করে পালিয়ে যায় ১৪ বছরের এই কিশোর। পরবর্তীসময়ে সিসি ক্যামেরার ফুটেজ দেখে ১২ মে তাকে গ্রেফতার করে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)।

কথা হয় আইটি বিশেষজ্ঞ আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর (সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল) তানভীর হাসান জোহার সঙ্গে। জাগো নিউজকে তিনি বলেন, সিসি ক্যামেরা শুধু অপরাধ তদন্তেই নয়, অপরাধ প্রতিরোধেও বড় ভূমিকা রাখে। অপরাধীরা জানে তারা নজরদারির আওতায়- এটাই তাদের অনেক সময় অপরাধ করতে নিরুৎসাহিত করে।

এসব বিষয়ে জানতে চাইলে ডিএমপির ডিসি (মিডিয়া) মুহাম্মদ তালেবুর রহমান জাগো নিউজকে বলেন, রাজধানীতে অপরাধ নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে ক্লোজড সার্কিট ক্যামেরা। ডিএমপি থেকে ক্যামেরাগুলো পরিচালনা করা হয়। যেসব ক্যামেরা নষ্ট, সেগুলো মেরামত করা হচ্ছে। সিসি ক্যামেরার ফুটেজ দেখে জড়িত অপরাধীদের শনাক্তের পর দ্রুতই গ্রেফতার করে আইনের আওতায় আনা যাচ্ছে।

ডিবির যুগ্ম কমিশনার (দক্ষিণ) মোহাম্মদ নাসিরুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, সম্প্রতি ঢাকা মহানগরীতে সিসি ক্যামেরা দেখে অনেক অপরাধীকে আইনের আওতায় আনতে পেরেছে ডিবি। সিসি ক্যামেরা ছাড়াও অন্যান্য প্রযুক্তির সহায়তায় আইনের আওতায় আনা হচ্ছে অপরাধীদের।

তিনি বলেন, নগরবাসীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে শুধু আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নয়, বেসরকারি পর্যায়েও দোকান, বাসাবাড়ি, গেট, গলি ও মার্কেটে সিসি ক্যামেরার ব্যবহার বাড়ছে। ফলে অপরাধী শনাক্ত এখন আগের চেয়ে অনেকটাই সহজ।

টিটি/কেএসআর/এমএফএ/জেআইএম