ফিচার

ভালোবাসার আশ্রম হোক প্রতিটি পরিবার

ভালোবাসার আশ্রম হোক প্রতিটি পরিবার

কবির হোসেন মিজি

Advertisement

একজন মা, কতটা ত্যাগ স্বীকার করে নিজের স্বপ্ন বিসর্জন দিয়ে সন্তানকে বড় করে তোলেন। নিজের আরামের ঘুম হারাম করে সন্তানকে ঘুমপাড়ানি গান শোনান রাতভর। একজন বাবা, যিনি ছেঁড়া পাঞ্জাবি পরে সন্তানকে ভালো জামা কিনে দেন। সেই মা-বাবার শেষ আশ্রয় যদি হয় নিঃসঙ্গ ঘর, নাম তার ‘বৃদ্ধাশ্রম’। তবে আমাদের এ সমাজের কোথাও যেন এক অসহ্য শূন্যতা জমে ওঠে।

আমাদের চারপাশে দিন দিন বাড়ছে বৃদ্ধাশ্রম। আগে যা ছিল শুধুই অসহায়দের ঠাঁই; আজ তা হয়ে উঠেছে শিক্ষিত, স্বচ্ছল সন্তানদের পরিকল্পিত মুক্তির জায়গা। একদিন যে মা সন্তানের মুখে প্রথম হাসি দেখার জন্য পৃথিবীর সব কষ্ট ভুলে গিয়েছিলেন; আজ সেই মা চোখে জল নিয়ে বৃদ্ধাশ্রমের জানালার ধারে বসে থাকেন। চোখেমুখে একটাই প্রশ্ন, আমার ছেলে কি আর কোনোদিন এসে বলবে না, ‘চলো মা, ঘরে ফিরি?’

একটি নীরব কান্নার নাম বৃদ্ধাশ্রম। এখানে আছে তিন বেলা খাবার, ওষুধ, বিছানা। নেই পরিচিত কোনো কণ্ঠস্বর, নেই নাতি-নাতনির হইহুল্লোড় আর পায়ের আওয়াজ। নেই সেই চেনা ভাতের গন্ধ। নেই ‘তুমি ভালো আছো মা’ প্রশ্নটি। বৃদ্ধাশ্রমে মা-বাবা থাকেন কিন্তু বাঁচেন না। তারা শুধু অপেক্ষা করেন, কখন ফোন আসবে। কেউ তাদের দেখতে আসবে। বেশিরভাগ সময়ই আসে শুধু নীরবতা।

Advertisement

এ নীরবতাই তাদের প্রতিদিন একটু একটু করে মেরে ফেলে। বদলে যাওয়া সমাজ, বদলে যাওয়া সম্পর্কের কারণে তারা জীবিত হয়েও মৃতের মতো বেঁচে থাকেন। মানুষ নিজের পরিবার গড়তে গিয়ে শেকড় ভুলে যাচ্ছে। বাবা-মায়ের জন্য সময় নেই, জায়গা নেই, ভালোবাসার স্থান নেই। বাড়ি বানানো হয় কিন্তু ঘরের এক কোণও বরাদ্দ থাকে না তাদের জন্য; যারা গোটা জীবন সন্তানের ঘর বানাতে ব্যস্ত ছিলেন।

আরও পড়ুন যে প্রেম গিলে ফেলে আপনার স্বাধীনতা  কেমন পোশাক পরবেন অফিসে 

শিক্ষা, পেশা, আয়—সব উন্নত হয়েছে কিন্তু হৃদয়ের দরজাগুলো যেন দিন দিন বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। সন্তানের ব্যস্ততা নাকি মূল্যবোধের অবক্ষয়? অনেকে বলেন, সময় নেই, শহরের ফ্ল্যাট ছোট, সন্তানদের লেখাপড়া। এ ছোট ঘরে জায়গা কম। তবে কি মা-বাবার মুখে হাসি না ফোটানোই সবচেয়ে বড় ব্যস্ততা হয়ে দাঁড়িয়েছে? আমরা ছেলেমেয়েদের ভালো স্কুলে ভর্তি করাই। দামি খেলনা কিনি, বিদেশে পড়াতে পাঠাই। সেই শিশুই যদি দেখে, তার দাদা-দাদিকে একা ফেলে রাখা হয় বৃদ্ধাশ্রমে। তবে তার কাছ থেকে আমরা ভবিষ্যতে কী আশা করতে পারি?

বাড়ি শুধু চার দেওয়ালে গড়া হয় না। পরিবার গড়ে ওঠে ভালোবাসা, দায়িত্ব আর স্নেহে। যে ঘরে মা-বাবা নেই; সে ঘর হয়তো দামি আসবাবপত্রে ভর্তি কিন্তু সেখানে নেই দোয়ার বরকত। নেই চোখ ভিজিয়ে দেওয়া গল্পের সন্ধ্যা। বাবা-মায়ের অভাব শুধু শূন্যতা নয়, এক ধরনের অসন্তান জীবন, যেখানে সব আছে, তবু কিছু নেই।

সমাধান খুঁজতে হলে ফিরে তাকাতে হবে হৃদয়ের চোখ দিয়ে। পরিবারে ছোটবেলা থেকেই বড়দের প্রতি সম্মান শ্রদ্ধাবোধ শেখাতে হবে। বাবা-মাকে বোঝা নয়, আশীর্বাদ হিসেবে গ্রহণ করতে হবে। সন্তানদের উচিত, বছরে একদিন নয় অন্তত প্রতিদিন একটু বাবা-মাকে সময় দেওয়া। মা-বাবা অসুস্থ হলে হাসপাতালে নেওয়ার আগেই পাশে বসে মাথায় হাত রাখা জরুরি। সরকার ও সমাজকে প্রবীণদের জন্য সহমর্মিতার জায়গা তৈরি করতে হবে।

Advertisement

একজন মা-বাবার চাওয়া খুব বড় কিছু নয়। তারা শুধু চান, ছেলেটা এসে একটু পাশে বসুক। মেয়েটা মাথায় তেল দিয়ে বলুক, ‘তুমি কেমন আছো মা?’ নাতি পাশে বসে হেসে বলুক, ‘তোমার গল্প শোনাও দাদু।’ এটুকু ভালোবাসাই তো আশ্রয়, এটুকু যত্নই তো আশ্রম। এগুলো না থাকলে সমাজ যতই আধুনিক হোক আমরা থেকে যাবো ভেতর থেকে দরিদ্র। তাই বলবো, বৃদ্ধাশ্রম নয়, ঘরের প্রতিটি কোণ হয়ে উঠুক ভালোবাসার ঠিকানা। যেখানে বার্ধক্য আসে গর্ব হয়ে, বাবা-মা থাকেন আশীর্বাদ হয়ে।

লেখক: সংবাদকর্মী, গীতিকার ও কথাশিল্পী।

এসইউ/জিকেএস