গত ১০ জুলাই ২০২৫ তারিখে প্রকাশিত এসএসসি ও সমমান পরীক্ষা ২০২৫ এর ফলাফলে দেখা যায়, ১১ শিক্ষা বোর্ড থেকে মোট ১৯ লাখ ২৮ হাজার ৯৭০ জন অংশগ্রহণ করে মোট পাস করেছেন ১৩ লাখ ৩ হাজার ৪২৬ শিক্ষার্থী। গড় পাসের হার ৬৮ দশমিক ৪৫ শতাংশ। জিপিএ-৫ পেয়েছেন ১ লাখ ৩৯ হাজার ৩২ জন। গত বছর পাসের হার ছিল ৮৩ দশমিক শূন্য ৩ শতাংশ। আর জিপিএ-৫ পেয়েছিল ১ লাখ ৮২ হাজার ১২৯ জন। অর্থাৎ গত বছরের তুলনায় এ বছর পাসের হার কমেছে ১৪.৯৫ শতাংশ জিপিএ-৫ কমেছে ৪৩ হাজার ৯৭ জন। গত ১৫ বছরে এইবারই পাশের হার সর্বনিম্ন এবং জিপিএ-৫ পাওয়া শিক্ষার্থীর সংখ্যাও সর্বনিম্ন।
Advertisement
টানা প্রায় ১৫ বছর ক্ষমতায় থাকাকালে পরীক্ষার ফলাফল ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে প্রকাশের অভিযোগ ছিল আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার সেই পথে হাঁটেনি বলে মনে করছেন শিক্ষা সংশ্লিষ্টরা। শিক্ষা উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. সিআর আবরার পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশের আগেই বলেছিলেন, এবারের এসএসসি পরীক্ষার রেজাল্টে শিক্ষার্থীদের মেধার প্রকৃত মূল্যায়ন করা হচ্ছে। অর্থাৎ তারা যেভাবে পরীক্ষা দিয়েছে, প্রকৃত মূল্যায়নে সেই ফলাফল তাদের হাতে পৌঁছানো হবে। ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে অতীতের মতো রেজাল্ট আর দেওয়া হবে না।
এমন একটি পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য শিক্ষা উপদেষ্টাকে ধন্যবাদ। শিক্ষার্থীদের শিক্ষামূল্যায়ন শতভাগ শততা, স্বচ্ছতা, নিরপেক্ষতা বজায় রাখা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এর মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের মধ্যে শিক্ষার আগ্রহ বৃদ্ধি পায়। সততা, স্বচ্ছতা ও নিরপেক্ষতা অর্জিত হয়। আত্মবিশ্বাসী হয়ে নিজের যোগ্যতায় এগিয়ে যেতে শিখে। যোগ্যাধিকারে বিশ্বাসী হয়। বিপরীত ক্রমে শিক্ষার্থীদের পরীক্ষায় বা মূল্যায়নে শিথিলতা প্রদর্শন করলে, গ্রেস নম্বর প্রদান করলে, অটো প্রমোশন দেওয়া হলে তারা লেখাপড়ায় গুরুত্ব কমিয়ে দেয়। অন্যের দয়ার উপর নির্ভরশীল হয়। নৈতিকতা বিবর্জিত হয়। অসদুপায় অবলম্বনে মরিয়া হয়। অযোগ্যতা দিয়ে পরীক্ষায় পাস করা, চাকরিতে প্রবেশ করা, বাড়তি সুবিধা ভোগ করা ইত্যাদিকে অধিকার মনে করে অন্যের উপর চড়াও হয়। তাই শিক্ষার্থীদের পরীক্ষায় বা মূল্যায়নে কোনো রূপ শিথিলতা প্রদর্শনের সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসা অত্যন্ত জরুরি।
বর্তমান শিক্ষা প্রশাসন এই জরুরি পদক্ষেপ নেওয়ার কারণে অর্থাৎ খাতা মূল্যায়নে সহানুভূতি দেখিয়ে অতিরিক্ত নম্বর প্রদান না করা ও অপ্রাসঙ্গিক উত্তরে নম্বর প্রদান না করার কারণেই ২০২৫ সালের এসএসসি পরীক্ষায় ফলাফল বিপর্যয় হয়েছে বলে ব্যাপক আলোচনা হচ্ছে। বিগত বছরের তুলনায় ফলাফল খারাপ হবার অবশ্যই এটি একটি যৌক্তিক কারণ। তবে এটি একমাত্র বা সবচেয়ে বড় কারণ নয়।
Advertisement
লক্ষণীয় যে, বিদেশে অবস্থিত শিক্ষার্থীদের ফলাফল দেশে অবস্থিত শিক্ষার্থীদের তুলনায় ভালো হয়েছে। বিভিন্ন দেশে অবস্থিত এসএসসি পরীক্ষার ৮টি কেন্দ্র থেকে ৪২৭ জন পরীক্ষার্থী অংশ নিয়ে ৩৭৩ জন উত্তীর্ণ হয়েছে। সেগুলোতে পাশের শতকরা হার ৮৭.৩৫ জন। তাদের উত্তরপত্র মূল্যায়ন করার ক্ষেত্রেও কিন্তু সহানুভূতি নম্বর প্রদান করা হয়নি, অপ্রাসঙ্গিক উত্তরে নম্বর প্রদান করা হয়নি। সুতরাং ফলাফল বিপর্যয়ের এ দুটি কারণের সাথে আরও যে সকল কারণ বিবেচনায় আনা প্রয়োজন সেগুলো হচ্ছে, করোনা কালে শিক্ষার্থীরা লেখাপড়া থেকে দূরে সরে যাওয়া, শিখন ঘাটতি নিয়ে বারবার উপরের ক্লাসে উঠে যাওয়া, ইংরেজি ও গণিত বিষয়ে সর্বাধিক পিছিয়ে পড়া, ক্লাসে উপস্থিতি কমে যাওয়া, ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক দুর্বল হওয়া, অনেক শিক্ষার্থী অবাধ্য হওয়া, শিখন ঘাটতি পূরণে শিক্ষকগণ ব্যর্থ হওয়া, নির্বাচনী পরীক্ষায় শিথিলতা দেখিয়ে প্রায় সবাইকেই এসএসসি পরীক্ষায় অংশ গ্রহণের সুযোগ দেওয়া ইত্যাদি। এ সকল কারণ খতিয়ে দেখে পর্যালোচনা করে পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়া আবশ্যক।
আরেকটি বিষয় লক্ষণীয় যে, এবার মোট ১৯ লাখ ২৮ হাজার ৯৭০ জন পরীক্ষার্থীর মধ্যে মোট ৯ লাখ ৬৭ হাজার ৭৩৯ জন মেয়ে এবং ৯ লাখ ৬১ হাজার ২৩১ জন ছেলে। মেয়েদের পাশের হার ৭১.০৩ শতাংশ এবং ছেলেদের পাশের হার ৬৫.৮৮ শতাংশ। ছেলেদের চেয়ে ৮ হাজার ২০০ জন বেশি মেয়ে জিপিএ-৫ পেয়েছে। বিগত বৎসরগুলোতেও পরীক্ষায় অংশগ্রহণ, পাশের হার, জিপিএ-৫ ইত্যাদি ক্ষেত্রে মেয়েদের তুলনায় ছেলেরা অনেক পিছিয়ে। মেয়েদের এগিয়ে আসা অবশ্যই সুসংবাদ। এ জন্য আমরা দীর্ঘদিন ধরেই চেষ্টা করে আসছি। উৎসাহ উদ্দীপনা দেয়া, উপবৃত্তি দেয়া, অভিভাবকদের সচেতন করা, বাল্যবিয়ে প্রতিরোধ করা, শিশুশ্রম রোধ করা ইত্যাদি কার্যক্রম চলমান রেখেছি।
আমাদের কন্যা শিশুরা এই কার্যক্রম গুলোর অধিক সুফল অর্জন করেছে তাই তাদেরকে ধন্যবাদ। অবশ্যই অব্যাহত রাখতে হবে মেয়েদের এই অগ্রযাত্রা। সেইসাথে বৃদ্ধি করতে হবে ছেলেদের সঠিক পথে এগিয়ে চলার গতি। মেয়েদের তুলনায় ছেলেরা অধিক হারে শিশুশ্রমে জড়াতে বাধ্য হওয়া এবং শিক্ষক ও অভিভাবকদের অবাধ্য হওয়াসহ আরো অনেক কারণ বিদ্যমান পিছিয়ে পড়ার পিছনে। মেয়েরা যখন লেখাপড়া করে, ছেলেরা তখন বাইরে আড্ডা মারে। মেয়েরা যখন স্কুলে ও কোচিংয়ে যায়, ছেলেরা তখন বিকট শব্দে মোটরসাইকেল চালায়। মেয়েরা যখন ঘুম যায়, ছেলেরা তখন নেশা খায়। সব ছেলেরা এসব করে না। যারা এসব করে তারা বেশিরভাগই ড্রপ আউট হয়, পরীক্ষায় ফেল করে। বাস্তব অবস্থা পর্যালোচনা করে চিন্তিত করতে হবে সবরকম সমস্যা। এখনই নিতে হবে সমাধানের কার্যকর পদক্ষেপ। তা না হলে কিছুকাল পরেই উল্টোভাবে ভারসাম্যহীন হয়ে পড়বে আমাদের সমাজ। তৈরি হবে আরো অনেক রকম ভয়াবহ সমস্যা!
গতবারে তুলনায় এবার এসএসসি ও সমমান পরীক্ষায় অংশগ্রহণকারীর সংখ্যা প্রায় ১ লাখ কম। শুধু তাই নয়, গত পাঁচ বৎসরে সবচেয়ে কম পরীক্ষার্থী ছিল এবার। ২০২৪ সালে ছিল ২০ লাখ ২৪ হাজার ১৯২ জন। ২০২৩ সালে ছিল ২০ লাখ ৭২ হাজার ১৬৩ জন, ২০২২ সালে ছিল ১৯ লাখ ৯৪ হাজার ১৩৭ জন এবং ২০২১ সালে ছিল ২২ লাখ ৪০ হাজার ৩৯৫ জন। যে সকল সমস্যার কারণে প্রায় এক লাখ শিক্ষার্থী এবার ড্রপ আউট হয়েছে অর্থাৎ পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেনি সে সকল সমস্যার প্রভাব যে অংশগ্রহণকারীদের উপর কম/বেশি ছিল না তা কিন্তু নয়! এখানেও বিদ্যমান অনেক শিক্ষার্থীর ফলাফল বিপর্যয়ের কারণ। এমন আরো অনেক কারণ চিহ্নিত করতে হবে আমাদের। আমরা যদি ফলাফল বিপর্যয়ের দু’একটি কারণ ভেবে বসে থাকি, অন্যান্য কারণ চিহ্নিত না করি, সকল সমস্যার সমাধান না করি তাহলে কিন্তু ভেস্তে যাবে সকল আলোচনা, সমালোচনা।
Advertisement
মোটকথা সুবিধাবঞ্চিত ও পাঠবিমুখ শিক্ষার্থীদের শিক্ষায় ফিরিয়ে আনা এবং শিক্ষকদের শিক্ষাদানে নিবেদিত করা ব্যতীত শিক্ষাক্ষেত্রে প্রকৃত সফলতা অর্জন অসম্ভব। শিক্ষায় সফলতা ব্যতীত দেশ ও জাতির টেকসই অগ্রগতি অন্য কোনোভাবেই সম্ভব নয়। শিক্ষাক্ষেত্রে প্রকৃত সফলতা অর্জনের জন্য শিক্ষার সার্বিক পরিবেশ উন্নত করা এবং শিক্ষকদের সচ্ছলতা বৃদ্ধি করে অধিক যোগ্য শিক্ষক নিয়োগ করা জরুরি। এসব কিছুর জন্যই প্রয়োজন সম্মিলিত প্রচেষ্টা। অভিভাবক, শিক্ষক, প্রশাসক ও গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ মিলে প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করতে হবে কার্যকর পরিকল্পনা।
লেখক: অধ্যক্ষ, সাহিত্যিক ও কলামিস্ট।rahamot21@gmail.com
এইচআর/এমএস