পূজার ছুটিতে পাঠদান পর্ব শুরু হওয়ার পূর্বে অমর্ত্য সেন শান্তিনিকেতনে পৌঁছলেন, যা হয় আর কি, ঘুরেফিরে ক্যাম্পাসের চারপাশ দেখা বিশেষত খেলার মাঠ প্রদর্শন করে আপাতত সময় কাটানো। এক পর্যায়ে মামাতো ভাই বিরেনদা তাকে প্রশিক্ষণরত সমবয়সী শিশুদের ক্রিকেট দলের ক্যাপ্টেনের সাথে পরিচয় করালেন।
Advertisement
তাদের সাথে প্রথম খেলার প্রচেষ্টা বিপর্যয় ঘটালো। তার ব্যাটিং দক্ষতা পরখ করার জন্য ক্যাপ্টেন যখন তার দিকে বল ছুড়লেন, অমর্ত্য সেনের ব্যাট থেকে আসা উত্তর সরাসরি গিয়ে ক্যাপ্টেনের নাকে আঘাত করলে বেশ রক্তপাত হয়। বিরেনদা যখন তার সেবা করছিলেন, ক্যাপ্টেন তখন বলছেন , ‘তোমার ভাই অবশ্যই আমার টিমে যোগ দিতে পারে তবে তাকে বলো সে যেন বোলারের নাক নিশানা না করে বাউন্ডারি নিশানা করে।’ অমর্ত্য তেমনটি প্রতিজ্ঞা করে নতুন স্কুল জীবনে প্রবেশ উদ্যাপন করলেন।
অমর্ত্য সেন তার আত্মজীবনীতে শুধু সেসব বিষয়ে স্মৃতিচারণ করেননি যেসব যুক্তিসঙ্গতভাবে তিনি স্বস্তি বোধ করেন, অধিকন্তু যেসব ব্যাপারে তার কোনোরকম ‘দক্ষতা’ ছিল না তাও অকপটে স্বীকার করেন। তার স্বেচ্ছাপ্রণোদিত এই স্বীকৃতি আগাগোড়া রসিকতার চাদরে আবৃত। একটি হচ্ছে ছুতারগিরি– ইংরেজিতে যাকে বলে কারপেনট্রি। শান্তিনিকেতনে প্রায়োগিক শিক্ষার সূত্রে সহপাঠীরা যখন প্রয়োজন মতো কাঠ বাঁকিয়ে ছোট সুন্দর সুন্দর নৌকা বানাত তখন তিনি বড়জোর একটা পুরোনো দিনের সাবান-ধারক (soup-holder), তাও দেখতে তেমন সুন্দর নয়, বানানোর বেশি এগোতে পারতেন না।
আর একটা হচ্ছে শান্তিনিকেতনের পাঠ্যসূচিতে থাকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয় গান। তিনি গান শুনতে ভালোবাসতেন, এখনো ভালো গানের প্রতি প্রচণ্ড আকর্ষণ বোধ করেন এবং শোনেন কিন্তু নিজে একেবারেই গাইতে পারতেন না। তার গানের শিক্ষক মোহরদি মোটেও মানতে রাজি ছিলেন না যে তার কোনো ঘাটতি আছে এবং প্রথমদিকে ক্লাসে না আসার অজুহাত হিসেবে সেটা গ্রহণ করতে অনাগ্রহী ছিলেন। তিনি বলেন, ‘গানের জন্য প্রত্যেকের একটা প্রতিভা আছে, বিকশিত করার জন্য এটা শুধুই অনুশীলনের ব্যাপার।’
Advertisement
মোহরদির তত্ত্বে তেজীয়ান হয়ে অমর্ত্য সেন বেশ কিছু আন্তরিক অনুশীলন করলেন। তবে নিজের প্রচেষ্টার ব্যাপারে তিনি নিশ্চিন্ত থাকলেও এর ফলাফল নিয়ে খুবই ভাবিত ছিলেন। একমাস অনুশীলনের পর মোহরদি আর একবার তার কৃতিত্ব পরীক্ষা করলেন এবং তারপর মুখে পরাজয়ের গ্লানি প্রকাশিত করে অমর্ত্যকে বলেন , ‘তোমার আর গানের ক্লাসে আসার দরকার নেই অমর্ত্য।’ অগত্যা অমর্ত্যের নিজের কাছে বলা, ‘এই ভেবে অত্যন্ত আনন্দিত থাকলাম যে, নিজে না গেয়েও গান উপভোগ করা যায়।’
ক্রীড়া ক্ষেত্রে কৃতিত্ব কম করুণাদায়ক নয়। শান্তিনিকেতন খেলাধুলার জন্য প্রচুর সময় দেওয়ার ব্যাপারে খুব উদার। ছেলেদের প্রিয় খেলা ফুটবলে কোনো দক্ষতা ছিল না, হকিস্টিক নিয়ে নড়বার জাদুও জানা ছিল না। ব্যাডমিন্টনে দক্ষতা পাস গ্রেড তবে ক্রিকেটে রেকর্ড চলনসই- ব্যাটিংয়ে মোটামুটি কিন্তু বোলার নন, ফিল্ডিংয়ে জঘন্য ।
একবার ছালার দৌড়ে (Sack-race) চ্যাম্পিয়ন হয়েছিলেন তার উদ্ভাবনী ভাবনা দিয়ে । তার তত্ত্বটা এ রকম ছিল– লাফিয়ে লাফিয়ে সামনের দিকে যাওয়া নিরর্থক– পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা বেশি– তবে পদাঙ্গুলি ছালার দুই কোণায় রাখতে পারলে সুস্থিত অবস্থায় পা টেনে টেনে আগে বাড়া সম্ভব।’ যেহেতু ভারতের স্বাধীনতা দিবস, ১৫ আগস্ট ১৯৪৭, উদযাপনে একমাত্র খেলা ছিল ছালার দৌড়, সেই শুভদিনে ক্রীড়া চ্যাম্পিয়ন হওয়ার অসাধারণ অভিজ্ঞতা আমার হয়েছিল। ওই পুরস্কারটি ছিল আমার অ্যাথলেটিক গৌরবের শিখর।’
স্বাধীনতার পর অন্য একটা ‘অনুপযুক্ততা’ প্রকাশ করার সুযোগ এসেছিল নোবেলজয়ী অমর্ত্য সেনের। স্বেচ্ছায় সামরিক প্রশিক্ষণ নেবেন বলে ন্যাশনাল ক্যাডেট কর্পে (এনসিসি) যোগ দিলেন তার সামরিক জীবন ছিল, তার মতে, ভবিষ্যদ্বাণী করা দুঃখদায়ক ব্যর্থতা। এটা এ কারণে নয় যে তাকে যা করতে বলা হয়েছে- মোটেও কষ্টকর নয়, তা তিনি তা করতে অসমর্থ ছিলেন কিন্তু যেই অফিসার নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন তার কথা শোনাই কঠিন ছিল।
Advertisement
তাদের যোগদানের পরপরই সুবেদার মেজরের কাছ থেকে ‘বুলেট’ শিরোনামে একটা ভাষণ শুনতে হলো । তিনি বললেন, রাইফেল থেকে বেরোবার পর গুলি ত্বরান্বিত হয় এবং তারপর, কিছুদূর গিয়ে বুলেটটির গতি হ্রাস পায়। এক্ষেত্রে বিচক্ষণ হচ্ছে যখনই বুলেটটি সর্বোচ্চ গতিতে ভ্রমণ করছে ঠিক সেই মুহূর্তে লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানা। এক পর্যায়ে অমর্ত্য সেন হাত উঠিয়ে নিউটনীয় পদ্ধতি ব্যাখ্যা দেওয়ার প্রয়াস নিয়ে সুবেদার মেজরকে বললেন, বুলেট রাইফেল থেকে বেরোবার পর সম্ভবত গতি ত্বরান্বিত হবে না তার কারণ গতির হার অর্জনে সাহায্য করার জন্য নতুন কোনো শক্তি নেই।
সুবেদার তার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘তুমি কি বলতে চাও আমি ভুল’? অমর্ত্য হ্যাঁ বলতে গিয়েও যথাযথ হবে না বিধায় বিরত থাকলেন। ভাবলেন, অবশ্য স্বীকার করতেই হয় যে, বুলেটটি সম্ভবত ত্বরান্বিত হতে পারে যদি এর ঘূর্ণনশীল গতিময়তা কোনোভাবে সামনে বাড়ার রৈখিক গতিময়তায় রূপান্তরিত করা যায়। সমস্যা হলো, অমর্ত্য সেন জানতেন না সেটা ঘটবে কীভাবে।
রাগান্বিত সুবেদার অমর্ত্যকে এক পলক দেখে নিয়ে উত্তরে বললেন, ঘূর্ণায়মান গতিশীলতা? এটাই কি তুমি বোঝাতে চাইছ?’ তালগোল পাকানো অংশটা সমাধান করতে উদ্যত হবেন ঠিক সেই মুহূর্তে অমর্ত্যকে দুই হাতে ভারমুক্ত একটা রাইফেল মাথার ওপর উঠিয়ে পাঁচবার মাঠ প্রদক্ষিণের নির্দেশ দিলেন সুবেদার মেজর।
শুরুটা যদি অশুভ হয়, শেষটাও ভালো যায়নি। একই সুবেদারের কাছে ১৮ জন প্রশিক্ষণার্থী একটা প্রতিবাদী পত্র পাঠালেন এই অভিযোগ করে যে, প্রশিক্ষণে অনুশীলন খুব বেশি হচ্ছে, রাইফেলের প্রয়োগ খুব কম শেখানো হচ্ছে। সুবেদার মেজর সকলকে বাড়িতে ডেকে ব্যাখ্যা করে বললেন, মিলিটারিতে একাধিক ব্যক্তি কোনো চিঠিতে সই করলে বিদ্রোহ হিসাবে গণ্য করা হয়। ‘সুতরাং আমার হাতে দুটো উপায় আছে’ মেজর বললেন , ‘তোমরা চিঠি তুলে নিতে পার এবং আমি সেটা ছিঁড়ে ফেলবো অথবা তোমাদের জন্য আমাকে কোর্ট মার্শালের ব্যবস্থা করতে হবে।’
দলের ১৮ জনের মধ্যে ১৫ জন নাম তুলে নিল। একজন অবশ্য পরে অমর্ত্যকে বলেছিলেন যে, তাকে বলা হয়েছিল যে কোর্টমার্শাল মানে সংক্ষিপ্তভাবে বিচার এবং গুলিবর্ষণ। তিনজন সামান্য পরিমাণ নড়লেন না। সুবেদার মেজর এই তিনজনকে জানিয়ে দিলেন যে, তাদের বিষয় ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অবহিত করবেন, কিন্তু অতিসত্বর সম্মান ছাড়া এবং শাস্তি সংক্রান্ত অফিসিয়াল যোগাযোগের অপেক্ষা না করে তিনজনকে বিদায় করে দেবেন । অমর্ত্য সেন বলছেন ‘এখন পর্যন্ত ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে কিছু শুনিনি কিন্তু সেটাই ছিল আমার সামরিক জীবনের সমাপ্তি।’
(অমর্ত্য সেনের আত্মজীবনী ‘হোম ইন দ্য ওয়ার্ল্ড থেকে নেওয়া )।
লেখক : অর্থনীতিবিদ, কলামিস্ট, সাবেক উপাচার্য, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।
এইচআর/এমএফএ/এমএস