কোনো হরর সিনেমা নয়, দেশটাও আইয়ামে জাহলিয়াত যুগের আরব নয়, জায়গাটা বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার পুরোনো এলাকা। সেই এলাকার নৃশংসতার একটি চিত্র সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লো।
Advertisement
একজন মানুষ রাস্তায় পড়ে আছে, রাস্তা ফাঁকা, গাড়ি-ঘোড়া নেই, তবে ঘটনাস্থলে গোল হয়ে থাকা মানুষের উপস্থিতি আছে। মব সন্ত্রাসে মত্ত কিছু লোক। মারছে মানুষটিকে। ঠিক আরবের লোকেরা যেমন পাথর ছুড়ে মারতো মানুষকে, তেমনি। রাস্তায় পড়ে থাকা কংক্রিটের তৈরি ব্লক ছুড়ে মারা হয় পড়ে থাকা মানুষটির মাথায়, পাঁজর বরাবর। থেঁতলে দেওয়া হয় মাথা।মব-এ মত্ত লোকগুলোর পায়ে লুটিয়ে পড়ছে ভুক্তভোগী লাল চাঁদ সোহাগের দোকানের কর্মচারীরা। লাথি দিয়ে ওদের সরিয়ে হামলা করে আবার লাল চাঁদের ওপর। লাল চাঁদের নড়াচড়ার ক্ষমতা শেষ হয়ে যায়। শেষ হয় না প্রতিপক্ষের আঘাত। আঘাতে আঘাতে তার মৃত্যু নিশ্চিত করে খুনিরা। নিথর দেহ পড়ে থাকে লাল চাঁদের।
বিজয়ীর বেশে রণক্ষেত্র ত্যাগ করে তারই একসময়ের সতীর্থ, নিজ দলীয় নেতাকর্মীরা। সংবাদে তাদের নাম এসেছে রিয়াদ, সজীব, নান্নু, লম্বা মনির ও ছোট মনিরের। সবারই দলীয় পরিচয়-তারা বিএনপির অঙ্গসংগঠন যুবদলের স্থানীয় নেতাকর্মী। শুক্রবার রাতেই প্রতিবাদে ফুঁসে ওঠে পুরো দেশ। ক্ষুব্ধ মানুষের জিজ্ঞাসা-কী হচ্ছে এসব? এত নৃশংসতা, এত নৈরাজ্য, খুন, চাঁদাবাজি, সন্ত্রাসের রাজত্ব! কেউ কি নেই দেশে?কাকে অভিযুক্ত করা হবে এসবের জন্য?সময় টেলিভিশনে টকশোতে সাংবাদিক মাসুদ কামাল বলেন- মারা গেছে বিএনপির লোক, মেরেছে বিএনপির লোক। কিন্তু সরকার এর দায় এড়াতে পারবে না।
একই টকশোতে যুক্তরাজ্য বিএনপি নেতা পারভেজ মল্লিক উল্লেখ করেন- এসবের পেছনে বিরাজনীতিকরণের লক্ষণ স্পষ্ট। প্রথম আলোচনা হতে পারে এই নৃশংসতার দায় নিয়ে। ঘটনা ঘটিয়েছে যুবদলের নেতাকর্মীরা, দায় সরকারের ওপর কেন? সহজ কথা-নাগরিকের নিরাপত্তার দায়িত্ব সরকারের, তাই এই নৃশংসতার মাধ্যমে নিহত নাগরিককে রক্ষা করতে না পারার দায় থেকে সরকার মুক্ত থাকতে পারে না। যারা বলবেন, স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন এ ঘটনায়, উপদেষ্টারা বিভিন্ন সময়ই বলেছেন, মব চলতে দেওয়া হবে না-সহ্য করা হবে না। তাদের কাছে প্রশ্ন থাকতে পারে-উদ্বেগ প্রকাশ করলে কি সোহাগ ফিরে আসবে? বলবেন, যে যায় সে ফিরে আসে না। বিষয়টা মৃতের ফিরে আসা না আসা নয়, নিশ্চয়তা দিতে হবে- জীবিত কারও যেন মাথা থেঁতলে না যায়, রগ কাটা না যায়, কিংবা চাঁদপুরে যেভাবে ইমামকে মসজিদের ভেতরে রেখে রক্তাক্ত করা হয়েছে তেমনটা যেন না হয়। সেই চেষ্টা কি সরকার করছে? স্পষ্ট উদাহরণ-প্রায় পৌনে দুইশ বিএনপি নেতাকর্মী দলীয় কোন্দলের শিকার হয়ে প্রাণ হারিয়েছে ১০মাসে। দলীয় কোন্দল ছাড়াও মব সন্ত্রাসে পড়ে নিহতের সংখ্যা কয়েকশ। একটি খুনের মামলারও কি বিচার হয়েছে প্রায় এক বছর সময়ের মধ্যে? চাঞ্চল্যকর হত্যা মামলাগুলোর দ্রুত বিচারের সুযোগ আছে প্রচলিত আইনে, মিটফোর্ডের ঘটনা দ্রুত বিচারের আশ্বাস দিয়েছেন আইন উপদেষ্টা। কিন্তু সাম্প্রতিক খতিয়ানে একমাত্র আছিয়া ধর্ষণ ও হত্যা মামলা ছাড়া আর কোনো বিচারের কথা জানা যায় না।
Advertisement
অন্যদিকে সরকারের রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিও আলোচনা হচ্ছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সমালোচনা হচ্ছে, সরকার সমর্থক দল কিংবা সরকার চাইছে ধরনের অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরি হোক। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এমন সমালোচকদের ব্যাখ্যা হচ্ছে-সরকার আসলে চায় না, কাছাকাছি সময় ক্ষমতা ছাড়তে। যে কারণে সরকার ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন অনুষ্ঠানের কথা বললেও ‘যদি’ ‘কিন্তু’ দিয়ে মলাটবদ্ধ করে দিয়েছে নির্বাচন অনুষ্ঠানকে। আর এই হচ্ছে ‘যদি’ ‘কিন্তু’গুলো।
এবার আসা যাক বিরাজনীতিকরণের কারণে এসব ঘটছে কি না সেই বিশ্লেষণে। শুরুতেই একজন বিএনপি নেতার বক্তব্য উল্লেখ করেছিলাম। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেই প্রকাশ হচ্ছে-ওয়ান/ইলেভেনের সময় যেভাবে মাইনাস টু ফর্মুলা দেওয়া হয়েছিল, সেই ফর্মুলা নিয়েই দেশ এগিয়ে যাচ্ছে। এর মধ্যে শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর আওয়ামী লীগের দলীয় কার্যক্রম নিষিদ্ধ হয়েছে। বাস্তবে আওয়ামী লীগই নিষিদ্ধ এখন। আর বাকি আছে বিএনপি। কিন্তু বিএনপিকে নিষিদ্ধ করা কিংবা দলীয় কার্যক্রম বন্ধ করার মতো ঝুঁকি সরকার নেবে না। তাই এই মুহূর্তে অস্থিতিশীলতা তৈরি মাধ্যমে বিএনপির জনপ্রিয়তাকে শূন্যতে নামিয়ে আনার ব্যবস্থা করা। এমন আলোচনাও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ঘুরপাক খাচ্ছে।
এমন পরিস্থিতিতে কিছুটা হোঁচট খাওয়া স্বাভাবিক। কারণ প্রায় পৌনে দুইশ মানুষ খুন হয়েছে বিএনপির অন্তর্কোন্দলের কারণে। সেখানে সরকারের ভূমিকা কী? কথাটা পুরোপুরি অগ্রাহ্য এমন বলা সম্ভব নয়। কিন্তু ছাত্রলীগের হেলমেট বাহিনী আর বর্তমান শিবির ও এনসিপি নেতাদের কর্মকাণ্ড বিশ্লেষণ করলে মনে হতেই পারে বিএনপি-ছাত্রদলের ছায়াতলে অশুভশক্তি লালিত হচ্ছে কি না। যেমনি ছাত্রলীগের ছায়াতলে লালিত হচ্ছিল হেলমেট বাহিনী, যাদের এখন ছাত্র শিবির ওএনসিপি পরিচয়ে দেখা যাচ্ছে। প্রতিপক্ষ যে কারণে টিপ্পনী কাটে-ছাত্রলীগের লুঙ্গির নিচে শিবিরের জন্ম। প্রশ্ন হচ্ছে-এখনো কি ছাত্রদল-যুবদলের লুঙ্গির নিচে এমন কারও জন্ম হচ্ছে?
জননিরাপত্তা বিধান সরকারের দায়িত্ব, সত্যকথা। অন্যরা কি দায়মুক্ত? চাঁদাবাজি, খুন, সন্ত্রাসে বিএনপি জামায়াত-শিবিরের নাম আসছে। এই নৃশংসতায় তাদের কি কোনে দায় নেই? বিএনপি বলবে-তারা কয়েক হাজার নেতাকর্মীকে বহিষ্কার ও কারণ দর্শানোর নোটিশ দিয়েছে। দলীয় শাস্তি প্রদান করেছে। সুতরাং এসব ঘটনার দায় এককভাবে বিএনপির ওপর চাপানোটা অন্যায্য। তারা অবশ্যই দলীয় আইন অনুযায়ী সর্বোচ্চ ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। কিন্তু তাদেরও আত্মরক্ষার ব্যবস্থার দায় আছে। এই মুহূর্তে সরকার গঠনের মতো অবস্থানে যে দলটি, সেই দলটির ক্ষতি সাধন করছে যারা, তাদের শুধু দল থেকে বহিষ্কার করার মধ্যেই কি তারা দায়মুক্ত হতে পারে?
Advertisement
আত্মরক্ষা শব্দটিতেই জোর দিতে চাই। তাদের দলের মারাত্মক ক্ষতি যে বা যারা করছে তাদের বিরুদ্ধে মামলা করার কথা আমরা কমই জেনেছি। মৃত ব্যক্তির স্বজনরা মামলা করে উপযুক্ত বিচারের আশায়। মনের ক্ষতিপূরণের আশায়। বিএনপি তাদের দলের অপূরণীয় ক্ষতি সাধনের অভিযোগে অন্তত অপরাধীদের বিরুদ্ধে মামলা করতে পারতো। কিন্তু করেনি। আজ যদি বিএনপি দুষ্টু এসব নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে মামলা করতো, তাহলে দলের ভেতর লুকিয়ে থাকা অশুভ হাতগুলো কিছুটা হলেও নিবৃত হতো। সুতরাং দল হিসেবে বিএনপি শতভাগ দায়মুক্ত এটা বলার সুযোগ কম।
বিএনপিদলীয় আইনের পাশাপাশি রাষ্ট্রীয় আইনের ব্যবস্থা নিচ্ছে না এটা যেমন অপরাধীদের ইন্ধন জোগানোর মতো কাজ করছে, আবার অপরাধীদের অপরাধ ঢাকার জন্য কিছু রাজনৈতিক বক্তব্যও তাদের দায়ভারকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে। তারা দল থেকে বহিষ্কার করে দায়মুক্ত হওয়ার চেষ্টা করছে, কিন্তু এটা মানুষ জানে, তাদের এই বহিষ্কার প্রক্রিয়াটি আসলে শাস্তিমূলক নয়। কারণ তারা আজ উত্তপ্ত পরিবেশ ঠান্ডা করার জন্য বহিষ্কার করছে, কদিন বাদে তাদেরই আবার দলে ঠাঁই দেওয়া হবে। বরণ করা হবে ফুলের মালা দিয়ে।
শুধু কি তাই, বিএনপি নেতাদের কোনো কোনো বক্তব্য এসব মব কালচারের পক্ষে বলে মনে করার যথেষ্ট কারণ আছে। পুরান ঢাকায় বর্বরোচিত হত্যাকাণ্ডের ঘটনার পর বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, ‘মিটফোর্ডের ঘটনায় সিরিয়াস ব্যবস্থা গ্রহণের পরও বিচ্ছিন্ন ঘটনার দায় বিএনপির ওপর চাপানো-অপরাজনীতি, এটা নোংরা রাজনীতি’। (জাগো নিউজ ১১ জুলাই ২০২৫)
একজন অভিজ্ঞ ও সিনিয়র নেতা যখন নৃশংস ঘটনার প্রতিবাদ করাকে নোংরা রাজনীতি বলে আখ্যায়িত করেন, তখন সঙ্গত কারণেই প্রশ্ন জাগে, আসলেই রাজনীতি এখন নোংরাই হয়ে গেছে। এবার আসা যাক এই মব সন্ত্রাসে লাভ হচ্ছে কার? বিএনপি বিরোধী হিসেবে পরিচিত এনসিপি ও জামায়াতে ইসলামী হয়তো খুশি হতে পারে, বিএনপির জনপ্রিয়তা হ্রাসের কারণে। পুরান ঢাকা ও খুলনায় বিএনপি সমর্থক দুজনের মৃত্যুর প্রতিবাদে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যে বিক্ষোভ মিছিল হয়েছে, তাদের মুখগুলোর দিকে তাকালে বোঝা যায়, এ বিক্ষোভের পেছনে রাজনৈতিক কৌশলও জড়িয়ে আছে। সেখানে অধিকাংশই এই দুই দল অর্থাৎ জামায়াত ও এনসিপির অনুসারী। বিএনপির অপকর্মে কারা বিজয়ের হাসি হাসে প্রতিবাদ দেখে তা অনুমান করা যায়।
বিএনপি নেতা জয়নুল আবদীন ফারুক মন্তব্য করেন ,যে মুহূর্তে ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন চাওয়া হয়েছে, তখন থেকেই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়ে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরি করা হচ্ছে। বিএনপি নেতা রুহুল কবির রিজভীও বলেন বিএনপির বিরুদ্ধে দোষারোপ করতেই এসব ঘটানো হচ্ছে। বক্তব্যগুলোতে নতুনত্ব কিছু নেই। যেমনি নেই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বক্তব্যেও। তারাও বলছে দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করা হচ্ছে। স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টাও আগেকার সব স্বরাষ্ট্র মন্ত্রীদের মতো বলছেন, কঠোর হস্তে দমন করা হবে, মব সন্ত্রাস সহ্য করা হবে না। এ যেন ভাঙা রেকর্ড। বেজেই চলেছে।
আরেকটা বিষয় অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক মনে হয়েছে, ভিডিও দেখে। যদিও স্নায়ুবিক কারণে পুরো ভিডিও দেখা সম্ভব হয়নি আমার, কিন্তু কিছু অংশ দেখাকালেই চোখে পড়েছে, খুনিরা যখন সোহাগের দেহে কংক্রিটের ব্লক ছুড়ে মারছে, তখন অসংখ্য মানুষ লাইন ধরে দাঁড়িয়ে থেকে তা উপভোগ করছে। কী নির্মম অবস্থায় আমাদের সমাজ পৌঁছে গেছে ভাবতে অবাক লাগে। চোখের সামনে একটি মানুষকে পাষণ্ডরা পাথর ছুড়ে পিটিয়ে খুন করছে, বিনা বাধায়, বিনা প্রতিরোধে।একটা মানুষও এগিয়ে আসেনি মানুষটাকে রক্ষা করতে। সমাজটাও কি তাহলে পচে গেছে? মানবতা কি শুধুই কল্পনার জগতের বিষয়?একে অন্যের ওপর দায় চাপানোর মধ্য দিয়ে এই দুষ্ট ক্ষত সেরে যাবে?
প্রতিটি পক্ষ নিজের দায়িত্ব পালনের প্রমাণ দিতে পারলেই শুধু এর দায় থেকে মুক্তি লাভ সম্ভব হবে। না হলে কেউ এই নৃশংসতার দায় থেকে মুক্তি পেতে পারে না। রাজনৈতিক দল, সরকার তথা আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এমনকি নীরব দর্শকের ভূমিকা পালনকারী জনগণও দায়মুক্ত হতে পারে না। দায় কাঁধে থাকা মানুষগুলো যতক্ষণ না দায়িত্ব পালনে আন্তরিক হবে ততক্ষণ সোহাগের পরিণতি নিজেকে ভোগ করার আশঙ্কা থেকেই যাবে।
লেখক : সাংবাদিক,শিশুসাহিত্যিক ও মুক্তিযুদ্ধ গবেষক।
এইচআর/এমএফএ/এমএস