মতামত

সঞ্চয়পত্রে সুদের হার কমলো মধ্যবিত্তের কী হবে?

সঞ্চয়পত্রে সুদের হার কমলো মধ্যবিত্তের কী হবে?

নতুন অর্থবছরের সূচনালগ্নেই দেশের বৃহৎ একটি জনগোষ্ঠীর জন্য এলো একটি আর্থিক ধাক্কা—সঞ্চয়পত্রে সুদের হার কমানোর ঘোষণা। ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেট ঘোষণার পরপরই সরকার জাতীয় সঞ্চয়পত্রের সুদের হার হ্রাস করে একটি নতুন নির্দেশনা জারি করে, যা ১ জুলাই ২০২৫ থেকে কার্যকর হয়েছে। অনেকের জন্য এটি একটি নীরব বিপর্যয়, বিশেষ করে তাদের জন্য যারা মাসিক খরচ চালানোর একমাত্র নির্ভরযোগ্য উৎস হিসেবে সঞ্চয়পত্রের মুনাফার ওপর নির্ভর করেন।

Advertisement

এর আগে বিভিন্ন স্কিমে যেখানে সুদের হার ১২.৫৫ শতাংশ পর্যন্ত ছিল, সেখানে নতুন নির্দেশনায় সর্বোচ্চ হার কমে দাঁড়িয়েছে ১১.৯৮ শতাংশে। গড়ে প্রায় ০.৫৭% থেকে ০.৭৫% পর্যন্ত কমানো হয়েছে প্রায় সব ধরনের সঞ্চয়পত্রে। সংখ্যাগুলোর পার্থক্য খুব বড় না মনে হলেও এর বাস্তবিক প্রভাব অনেক গভীর। বিশেষ করে মধ্যবিত্ত, অবসরপ্রাপ্ত নাগরিক, গৃহিণী, শিক্ষার্থী ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের জীবনে এই পরিবর্তনের সরাসরি প্রভাব পড়বে।

অনেকেই এই পরিবর্তনকে একটি অবাঞ্ছিত আর্থিক সংকোচন হিসেবে দেখছেন। যারা সঞ্চয়পত্রকে একটি নিরাপদ ও নির্বিচারে আয়ের উৎস হিসেবে ভাবতেন, তাদের কাছে এই সিদ্ধান্ত এসেছে এক ধরনের হতাশা নিয়ে। বহু অবসরপ্রাপ্ত ব্যক্তি, যাদের মাসিক চিকিৎসা ব্যয় ও দৈনন্দিন খরচ চলে সঞ্চয়পত্রের মুনাফা থেকে, তারা এখন এই আয় থেকে মাসে গড়ে ৪০০ থেকে ৬০০ টাকা পর্যন্ত কম পাচ্ছেন। শহরের ব্যয়বহুল জীবনে এই অঙ্ক হয়তো ছোট মনে হতে পারে, কিন্তু পেনশনপ্রাপ্ত বা স্থির আয়ের ব্যক্তিদের জন্য এটি অর্থনৈতিক ভারসাম্যে বড় ধাক্কা।

সঞ্চয়পত্রে সুদের হার কমানোর সিদ্ধান্ত হয়তো সরকারের অর্থনৈতিক পরিকল্পনার অংশ, কিন্তু এর সামাজিক ও মানবিক দিক বিবেচনায় না আনলে সেটি একপেশে নীতিতে পরিণত হতে পারে। আমাদের দেশের মতো অর্থনৈতিক নিরাপত্তার অভাবে ভোগা জনগোষ্ঠীর জন্য এটি কেবল আর্থিক নয়, মানসিক চাপও সৃষ্টি করে।

Advertisement

মধ্যবিত্ত পরিবারগুলোর অবস্থাও খুব আলাদা নয়। একজন ব্যক্তি যদি ১০ লাখ টাকা পরিবার সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ করেন, আগে তিনি বছরে প্রায় ১ লাখ ২৫ হাজার টাকা মুনাফা পেতেন। নতুন হারে সেই আয় কমে দাঁড়াবে ১ লাখ ১৯ হাজার টাকার কিছু বেশি। অর্থাৎ বছরে প্রায় ৫,৭০০ টাকা কম, যা মাসে গড়ে প্রায় ৪৭৫ টাকা। এই টাকায় শহরের একটি পরিবারের মাসিক বাজার খরচের একটি অংশ মেটানো সম্ভব, বিশেষ করে নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারে যেখানে প্রতিটি টাকার হিসাব করেই খরচ চালাতে হয়।

শুধু অবসরপ্রাপ্ত নয়, গৃহিণী, শিক্ষার্থী বা ছোট ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত যারা ভবিষ্যতের নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে অল্প অল্প করে সঞ্চয় করছিলেন, তারাও এখন নতুন হার দেখে দ্বিধায় পড়েছেন। বহু মানুষ দীর্ঘ সময় ধরে ছোট অঙ্ক জমিয়ে একটি নির্ভরযোগ্য আয় প্রত্যাশা করতেন সঞ্চয়পত্রের মাধ্যমে। সেই প্রত্যাশায় এখন কাটা পড়েছে। অনেকে বলছেন, এই সিদ্ধান্ত হয়তো সরাসরি ক্ষতির অঙ্কে বড় নয়, কিন্তু মানসিকভাবে এটি এক ধরনের অনিশ্চয়তা তৈরি করেছে।

অবশ্য অর্থ মন্ত্রণালয় ও সংশ্লিষ্ট অর্থনীতিবিদদের ব্যাখ্যা ভিন্ন। তারা বলছেন, সরকার এখন চায় জনগণের বিনিয়োগ আরও বহুমাত্রিক হোক। অর্থাৎ শুধু সঞ্চয়পত্র বা গ্যারান্টিকৃত মুনাফার দিকে না ঝুঁকে, মানুষ যেন ব্যাংক, শেয়ার বাজার, উৎপাদন খাত ও উদ্যোক্তামূলক কাজে বিনিয়োগে আগ্রহী হয়। এছাড়াও সরকারের অভ্যন্তরীণ ঋণের বোঝা হ্রাস এবং বাজেট ঘাটতি সামলানোর জন্য সঞ্চয়পত্রে অতিরিক্ত সুদের চাপ কিছুটা কমানো প্রয়োজন ছিল।

তবে বাস্তবতা হলো, বাংলাদেশের মতো দেশে যেখানে আর্থিক শিক্ষা ও বিনিয়োগ সম্পর্কে সচেতনতা এখনো খুব সীমিত, সেখানে হঠাৎ করে মানুষকে ঝুঁকিপূর্ণ বা অচেনা খাতে বিনিয়োগের উৎসাহ দেওয়া হয়তো বাস্তবসম্মত নয়। ব্যাংকিং সিস্টেমে বহু মানুষের আস্থা নেই, শেয়ার বাজার নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে নানা অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে, এবং উৎপাদন খাতে বিনিয়োগের জন্য প্রয়োজন স্থায়ী পুঁজি ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা—যা সবার পক্ষে সম্ভব নয়।তাই যখন সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয় “বিকল্প খাত” বা “ব্যাংকিং চ্যানেলে বিনিয়োগের আহ্বান,” তখন সাধারণ মানুষের মধ্যে বিভ্রান্তি সৃষ্টি হয়। তারা বুঝে উঠতে পারেন না—তাদের সঞ্চয় এখন কোথায় নিরাপদ, কোথায় লাভজনক, এবং কোথায় স্থিতিশীল। অনেকেই হয়তো এখন বাধ্য হবেন স্বল্প মুনাফার মধ্যেই টিকে থাকতে, কিংবা ঝুঁকি নিতে—যা আবার নতুন সংকটের সৃষ্টি করতে পারে।

Advertisement

একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো—এই পরিবর্তনের সঙ্গে দেশের মূল্যস্ফীতির বাস্তবতা। গত কয়েক বছর ধরেই পণ্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি নিয়ন্ত্রণে নেই যদিও সাম্প্রতিক সময়ে কিছুটা কমেছে বলে বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে। চাল, ডাল, তেল, ভাড়া—সবকিছু বেড়েছে, কিন্তু মধ্যবিত্তের আয় বা করমুক্ত সীমা বাড়েনি। তার ওপর যদি নির্ভরযোগ্য মুনাফার উৎস থেকেও আয় কমে যায়, তাহলে তাদের জীবনযাত্রার মান কীভাবে বজায় থাকবে? এটি একটি মৌলিক প্রশ্ন, যার উত্তর খোঁজা জরুরি।

তবে হতাশার মধ্যেও কিছু আশা জাগে। অর্থ মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, তারা ৬ মাস পর আবার এই সুদের হার রিভিউ করবে। অর্থাৎ এটি স্থায়ী নয়, পরিস্থিতি অনুযায়ী পরিবর্তিত হতে পারে। পাশাপাশি, পুরোনো সঞ্চয়পত্র যাদের রয়েছে, তাদের ক্ষেত্রে পুরোনো হারে মুনাফা বহাল থাকবে। তাই কেউ যদি আগে ১২.৫% হারে একটি স্কিমে বিনিয়োগ করে থাকেন, তা হলে সেটি মেয়াদপূর্তি পর্যন্ত আগের হারে মুনাফা দেবে।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে—এই পরিস্থিতিতে কী করা উচিত? প্রথমত, হুট করে কেউ যেন তার চলমান সঞ্চয়পত্র ভেঙে না ফেলেন। দ্বিতীয়ত, সময় এসেছে বিকল্প আয়ের উৎস সম্পর্কে জানার ও শেখার। ব্যাংকের নির্দিষ্ট আমানতে কিছু অফার পাওয়া যাচ্ছে, স্টক মার্কেট ও মিউচুয়াল ফান্ডে বিনিয়োগ সম্পর্কে সচেতনতা বাড়ানো জরুরি, রিয়েল এস্টেটে বিনিয়োগের পাশাপাশি এখন ডিজিটাল আয় বা মাইক্রো বিজনেসের ক্ষেত্রেও সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে।সবচেয়ে জরুরি হলো—ব্যক্তি পর্যায়ে আর্থিক সচেতনতা গড়ে তোলা। সঞ্চয়, খরচ নিয়ন্ত্রণ এবং বিনিয়োগ—এই তিনটি স্তম্ভে যদি একজন ব্যক্তি নিজের অর্থ ব্যবস্থাপনাকে পরিচালনা করেন, তাহলে সুদের হার কমলেও তার প্রভাব কিছুটা হ্রাস পাবে। বর্তমান আর্থিক বাস্তবতায় প্রতিটি পরিবারকে নিজেদের পরিকল্পনা নতুন করে সাজাতে হবে, নিজেদের প্রয়োজন ও সক্ষমতার ভিত্তিতে বিকল্প চিন্তা করতে হবে।

সঞ্চয়পত্রে সুদের হার কমানোর সিদ্ধান্ত হয়তো সরকারের অর্থনৈতিক পরিকল্পনার অংশ, কিন্তু এর সামাজিক ও মানবিক দিক বিবেচনায় না আনলে সেটি একপেশে নীতিতে পরিণত হতে পারে। আমাদের দেশের মতো অর্থনৈতিক নিরাপত্তার অভাবে ভোগা জনগোষ্ঠীর জন্য এটি কেবল আর্থিক নয়, মানসিক চাপও সৃষ্টি করে।

সর্বোপরি, এটি সময়ের দাবি যে—সবার মাঝে অর্থনৈতিক শিক্ষা ও সচেতনতা ছড়িয়ে দিতে হবে। যে যেভাবেই আয় করুক না কেন, তাকে বুঝতে হবে কীভাবে সঞ্চয়, বিনিয়োগ ও ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা করে টেকসইভাবে এগিয়ে যাওয়া যায়। এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় ব্যক্তিগত উদ্যোগ, রাষ্ট্রীয় দৃষ্টিভঙ্গি ও গণসচেতনতা—সবকিছুই প্রয়োজন। শুধু সুদের হার কমানোই নয়, বরং এর সঙ্গে সঙ্গে আমাদের ভবিষ্যৎ অর্থনীতিকে টেকসই ও মানবিক করে গড়ে তোলার প্রচেষ্টাও জোরদার করতে হবে।

লেখক : দি আর্ট অব পার্সোনাল ফাইনান্স ম্যানেজমেন্ট বইয়ের লেখক, কলামিস্ট, ইউটিউবার এবং ফাইনান্স ও বিজনেস স্ট্র্যাটেজিস্ট।

এইচআর/এএসএম