আইন-আদালত

রাজসাক্ষী হওয়ার প্রক্রিয়া কী, কারা হন, আইন কী বলে?

রাজসাক্ষী হওয়ার প্রক্রিয়া কী, কারা হন, আইন কী বলে?

ইংরেজি অ্যাপ্রুভার শব্দটির বাংলা অর্থ অনুমোদনকারী। আর আইনি পরিভাষায় এর অর্থ হলো রাজসাক্ষী। তবে, অ্যাপ্রুভার বা রাজসাক্ষীর সংজ্ঞা দেওয়া হয়নি দেশের প্রচলিত কোনো আইনে। এমনকি রাজসাক্ষী বা অ্যাপ্রুভার শব্দটিও ব্যবহার করা হয়নি কোথাও। ক্ষমা করে দেওয়া হবে এমন প্রস্তাবে কোনো অপরাধে জড়িত একজন কর্তৃক তার অন্য সহযোগীদের বিরুদ্ধে আদালতে সাক্ষ্য প্রদানকারীকে প্রচলিত সংজ্ঞায় বলা হয় অ্যাপ্রুভার বা রাজসাক্ষী।

Advertisement

এখানে প্রশ্ন হচ্ছে, রাজসাক্ষীর বিধানটি কেন প্রবর্তন করা হলো? যদি একাধিক ব্যাক্তি কোনো গুরুতর অপরাধ করে থাকে, সেই অপরাধ প্রমাণে আদালতের হাতে তেমন কোনো নির্ভরযোগ্য সাক্ষ্য-প্রমাণ না থাকে। তখন অপরাধীদের দোষী সাব্যস্ত করে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করাই হয়ে দাঁড়ায় একমাত্র উদ্দেশ্য। কেবল সাক্ষ্য-প্রমাণের অভাবে কোনো অপরাধী যেন পার পেয়ে না যায় সেটাই থাকে লক্ষ্য।

অপরাধ দমনের দায়িত্ব রাষ্ট্রের। তাই অধিকাংশ অপরাধ সংঘটনের মামলার বাদী হয়ে থাকে রাষ্ট্র। আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করে জনগণের নিরাপত্তা বিধানের দায়িত্বও রাষ্ট্রের। কোনো একটি অপরাধ সংঘটনে যেসব ব্যক্তি জড়িত থাকেন তাদের প্রত্যেককে অপরাধের সহযোগী বলা চলে। ব্রিটিশ শাসনামলে বাদী হতেন রাজা। তাই গুরুতর অপরাধ সংঘটনকারী ব্যক্তি যারা সাক্ষী হয়ে রাজার পক্ষে সাক্ষ্য দিতেন তারাই ‘রাজসাক্ষী’ হিসেবে গণ্য হতেন।

অপরাধে সহযোগীরা সাধারণত সরকার থেকে ক্ষমার প্রতিশ্রুতি লাভ করে রাজসাক্ষীতে হন এবং সে কারণে সরকারের পক্ষাশ্রিত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। সাক্ষ্যের অভাবে কোনো অপরাধী যাতে শাস্তি থেকে অব্যাহতি না পায় সে কারণে ফৌজদারি কাযির্বধির ৩৩৭ ও ৩৩৮ ধারায় কতিপয় শর্তসাপেক্ষে আসামিকে সাক্ষী হিসেবে ব্যবহার করার বিধান রয়েছে। গুরুতর অপরাধ সংঘটনকারীর কোনো সহচর যদি অপরাধের ঘটনা সম্পূণর্ভাবে প্রকাশ করেন এবং নিজেকে জড়িয়ে সহচরদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেন তাহলে তাকে ‘রাজসাক্ষী’ বলা হয়।

Advertisement

রাজসাক্ষীর বিবৃতিতে এই দুটি উপাদান থাকতে হয়- সে অপরাধে অংশ নিয়েছিল এবং তাকে অন্য আসামিদের অপরাধের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা এবং তাদের ভূমিকা সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য সরবরাহ করতে হবে। রাজসাক্ষী যদি আগে থেকে জামিনে না থাকেন তাহলে তাকে বিচার শেষ না হওয়া পযর্ন্ত কারাগারে আটক রাখতে হবে। কারণ জামিনে থাকা রাজসাক্ষীর সাক্ষ্যের প্রকৃতি অনেকটা দুবর্ল হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। সহ-অপরাধী বা রাজসাক্ষীর বক্তব্যের ওপর নিভর্র করে সাজাদানের ক্ষেত্রে আদালত সবোর্চ্চ সতকর্তা অবলম্বন করে এবং সাবির্কভাবে ন্যায়বিচারের ক্ষেত্রে আদালত বিচক্ষণতার সঙ্গে কাজ করে থাকে।

ভারত ও বাংলাদেশে রাজসাক্ষীর নজির

১৯৪৮ সালের ৩০ জানুয়ারি মাহাত্মা গান্ধীকে একাই গুলি করে হত্যা করেছিলেন হিন্দু জাতীয়তাবাদী আইনজীবী নাথুরাম বিনায়ক গডসে। তবে ওই ষড়যন্ত্র ও পরিকল্পনায় যুক্ত ছিলেন আরও কয়েকজন। যাদের একজন ছিলেন হিন্দু মহাসভার সদস্য দিগম্বর রাম চন্দ্র বিচ। পরবর্তীতে তিনিই হয়েছিলেন মামলার রাজসাক্ষী।

আর একটি ঐতিহাসিক মামলা হলো শেখ মুজিবুর রহমানসহ ৩৫ জনের বিরুদ্ধে আগড়তলা ষড়যন্ত্র মামলা। যে মামলায় রাজসাক্ষী করা হয়েছিল ১১ জনকে। যদিও আন্দোলনের কারণে পরবর্তীতে ঐতিহাসিক এই মামলাটি প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়েছিল।

এ প্রসঙ্গে সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী মো. আহসানুল করিম জাগো নিউজকে জানান, বাংলাদেশে অসংখ্যা মামলায় রাজসাক্ষীর নাজির রয়েছে। এর মধ্যে একটি মামলা হচ্ছে খুলানার কুখ্যাত খুনি এরশাদ শিকদারের বিরুদ্ধে আকিমুল ইসলামের হত্যা মামলাটি। এই মামলায় এরশাদ শিকদারের বিরুদ্ধে রাজসাক্ষী হয়েছিলেন তারই দেহরক্ষী নুর আলম। হাইকোর্ট বিভাগ নুর আলমকে রাজসাক্ষী হিসেবে গণ্য করেন, কেননা নুর আলম এরশাদ শিকদারের অপরাধের সাক্ষী হলেও তিনি অপরাধের সহযোগী ছিলেন না। যদিও অন্য মামলায় পরে এরশাদ শিকদারের ফাঁসির দণ্ড হয়।

Advertisement

রাজ সাক্ষী নিয়ে আইনে কি আছে বিশ্লেষকের মতামত :

সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র ও প্রখ্যাত ফৌজদারি আইনজীবী এস এম শাহজাহান জাগো নিউজকে বলেন, ট্রাইব্যুনালের আইনের ১৫ ধারা এবং ফৌজদারি কার্যবিধির ৩৩৭ ধারায় ‘অ্যাপ্রুভার’ বা রাজসাক্ষীর বিষয়টি উল্লেখ আছে। কোনো আসামি অপরাধের সঙ্গে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জড়িত বলে নিজের অপরাধ স্বীকার করে নিলে এবং নিজেকে দোষী সাব্যস্ত ঘোষণা করলে, অপরাধের সংঘটনের সঠিক তথ্য দিয়ে সহায়তা করা এবং সত্য সাক্ষী দেওয়ার কারণে আদালত আসামির সাজা মওকুফ করে দিয়ে তাকে খালাস দিতে পারেন। এ কারণেই আসামিরা অনেক সময় অপরাধ বা দোষ স্বীকার করে নিয়ে রাজসাক্ষী হতে রাজি হয়ে থাকেন।

রাজসাক্ষী হওয়ার বিষয়টি ফৌজদারি কার্যবিধির ৩৩৭, ৩৩৮ ধারা এবং সাক্ষ্য আইনের ১৩৩ ধারায় রয়েছে। সাক্ষ্য আইন প্রণয়নের সময় যেহেতু রাজার শাসন ছিল, তাই এই ধরনের সাক্ষীকে রাজসাক্ষী বলা হয় এখনও। আবার রাজসাক্ষীকে রাষ্ট্রের সাক্ষী বলে অভিহিত করেন কেউ কেউ। আসামি হলেও আদালতকে সহায়তা করায় রাজসাক্ষীর শাস্তি কম পাওয়া কিংবা ক্ষমা পাওয়ার সুযোগ থাকে।

আরও পড়ুন শেখ হাসিনার মামলায় রাজসাক্ষী হলেন সাবেক আইজিপি রাজসাক্ষী সাবেক আইজিপি মামুনের নিরাপত্তা চেয়ে আবেদন

এ বিষয়ে প্রসিকিউটর গাজী এম এইচ তামিম জাগো নিউজকে বলেন, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আাইন ১৯৭৩ এর ১৫ ধারায় এই সাক্ষ্যের কথা বলা আছে। যদি কোনো আসামি বিচারের একটা পযার্য়ে মনে করেন যে তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগের ব্যাপারে তাকে আংশিক তথ্য বললে হবে না, তিনি যে ঘটনা জানেন, যেসব ঘটনা ঘটেছে তার সম্পূর্ন তুলে ধরবেন- তখন তিনি নিজেই বা তার আইনজীবীর মাধ্যমে আদালতের কাছে অ্যাপ্রুভার রাজসাক্ষী হওয়ার প্রার্থনা জানাতে পারেন। বৃহস্পতিবার (১০ জুলাই) মামলায় ট্রায়াল শুরু হয়েছে, সেদিনই তিনি (সাবেক আইজিপি) এটা বলেছেন। ফলে ওনার আইনজীবী ট্রাইব্যুনালের কাছে লিখিত আবেদনের মাধ্যমে জানিয়েছেন। উনি যেহেতু তৎকালীন সময়ে দেশের পুলিশের প্রধান ছিলেন, তখন পুলিশ বাহিনী কীভাবে কাজ করেছে সেটা তিনি জানেন। উনি সেটি ট্রাইব্যুনালকে বিস্তারিত জানাতে চান। তখন ট্রাইব্যুনাল তাকে অ্যাপ্রুভার বা রাজসাক্ষী হিসেবে গ্রহণ করেছেন।

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইন-১৯৭৩-এর ১৫(১) ধারায় বলা হয়েছে, বিচারের যে কোনো পর্যায়ে ট্রাইব্যুনাল ঘটনার সঙ্গে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জড়িত বা ধারা-৩ এ উল্লিখিত অপরাধের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির সাক্ষ্য গ্রহণের উদ্দেশে এরূপ ব্যক্তিকে এই শর্তে ক্ষমা করতে পারেন যে, সে ঘটনার মূল হোতা বা সহায়তাকারী হিসেবে সে যা জানে তার পূর্ণ ও সত্য ঘটনার বিস্তারিত প্রকাশ করবে। (২) বিচারে এরূপ প্রস্তাব গ্রহণকারী ব্যক্তিকে সাক্ষী হিসেবে পরীক্ষা করা হবে। (৩) বিচার শেষ না হওয়া পর্যন্ত এরূপ ব্যক্তিকে কারাগারে আটক রাখতে হবে।

রাজসাক্ষী হওয়ার স্টেজ

প্রসিকিউটর গাজী এম এইচ তামিম জানান, অ্যাপ্রুভার বা রাজসাক্ষীর বিষয়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইনের তিনটি স্টেজ আছে। প্রথমটি হলো এটি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের কাছে আবেদন করতে হবে। দ্বিতীয়- আবেদন করার পর যদি আদালত মঞ্জুর করেন তাখন ওনাকে অ্যাপ্রুভার বা রাজসাক্ষী হিসেবে ঘোষণা করতে হবে। তৃতীয়- আনটিল কনকোলেশন অব দ্যা ট্রায়াল ওনাকে কারাগারে থাকতে হবে। কারণ উনি যদি এখন স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে যান তা হলে এই মামলায় বিচার ও তার জীবনের জন্যে ঝুঁকি হয়ে যাবে।

তিনি কখন আসামি ও কখন সাক্ষী

রাজসাক্ষী ক্ষমা পাওয়ার শর্তেই নিজের অপরাধ এবং অন্য অপরাধীদের অপরাধের বিবরণ দেবেন। ফৌজদারি আইনজীবীদের সঙ্গে এ বিষয়ে কথা বলে জানা গেছে, ফৌজদারি কার্যবিধি অনুযায়ী, কোনো রাজসাক্ষী যদি নিজের অপরাধ ও অন্য অপরাধীদের ব্যাপারে সত্য গোপন করেন কিংবা মিথ্যা সাক্ষ্য দেন, তখন তিনি রাজসাক্ষী থেকে আবার আসামি হয়ে যান।

প্রসিকিউটর গাজী এম এইচ তামিম বলেন, জেলখানায় থেকে তিনি সাক্ষ্য দেবেন। অন্যান্য সাক্ষীর যে স্ট্যাটাস তারও সেই স্ট্যাটাস। তিনি পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক বা আইজিপি হলেও এখন তিনি একজন অ্যাপ্রুভার, মানে রাজসাক্ষী। কিন্ত উনি জেলখানাতেই থাকবেন। তিনি তো এই মামলায় অন্যদের মতো আসামি। তাহলে তার আদালতে আসা-যাওয়ার কী হবে? জেলখানায় তিনি আাসামি হিসেবে থাকেবন। আসামি হিসেবে তিনি আদালতে আসবেন, আসামি হিসেবে কাঠগড়ায় বসবেন। আর যখন ট্রাইব্যুনাল ওনাকে ডাকবেন তখন সাক্ষীর কাঠগড়ায় গিয়ে সাক্ষ্য দেবেন। সাক্ষী দেওয়ার পর আসামীপক্ষের আইনজীবী তাকে জেরা করবেন। মামলার শেষে গিয়ে আদালত যদি অ্যালাও করেন তাবে তাকে খালাস দিয়ে দেবেন।

শুধু রাজসাক্ষী নয়, অন্য সাক্ষীও থাকতে হবে

রাজসাক্ষী নিয়ে আইনজীবী সৈয়দ মামুন মাহাবুব জাগো নিউজকে বলেন, রাজসাক্ষী মানে অন্য গিল্টিদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেওয়া। খারাপ অর্থে রাজার সাক্ষী। তবে রাজ সাক্ষীকে নিয়ে কোনো বিতর্ক রাখা যাবে না। যাকে রাজসাক্ষী করা হবে শুধু তিনি সাক্ষ্য দিলেই হবে না। তার কথার ওপর বেস করে হবে না। আদারস মেটিরিয়াল থাকতে হবে এবং করপোরেট থাকতে হবে এবং বেস্ট হবে যদি আরও আলাদা কোনো ডকুমেন্ট, তথ্য বা সাক্ষী থাকে। রাজসাক্ষী নিজে বাঁচার জন্যে বলতেই পারে। আমার বক্তব্য হচ্ছে রাজসাক্ষী পেয়েই সব ঠান্ডা তা না। প্রসিকিউশনকে ইন্ডিপেন্ডেন্ট সাক্ষী আনতে হবে এসব ঘটনায়।

তিনি আরও জানান, কথা হলো আমরা কেউই চাইব না যে, জনগণের ট্যাক্সের টাকা খরচ করে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল করে। সেখানে বিচারক, প্রসিকিউটর ও আইওদের বেতন ভাতা দিয়ে এমন একটা বিচার না হোক যেটা রেজিম চেঞ্জের সঙ্গে আসামিও বিচারে খালাস পেয়ে যান। সুতরাং ন্যায্যভাবে বিচারটা যেন হয়। আবেগ দিয়ে বিচার করলে হবে না।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আইন সমিতির আহ্বায়ক ও সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী মো. মনিরুজ্জামান জাগো নিউজকে বলেছেন, শর্ত মোতাবেক রাজসাক্ষী যদি সাক্ষ্য দেন, তাহলে ট্রাইব্যুনাল যে কোনো শাস্তি দিয়ে আবার ক্ষমা করে দিতে পারেন।

প্রসিকিউটর বি এম সুলতান মাহমুদ বলেন, আইন অনুযায়ী কোনো রাজসাক্ষী যদি সব শর্ত পূরণ করেন, তাহলে তাকে ক্ষমা করে দিতে পারেন ট্রাইব্যুনাল। এই ক্ষমতা ট্রাইব্যুনালের রয়েছে। এটা সম্পূর্ণ আদালতের এখতিয়ার।

এফএইচ/এএমএ/এএসএম