জাতীয়

দক্ষ তরুণেরা বিনিয়োগমুখী না হলে বয়স্কদের সামনে মহাবিপদ

দক্ষ তরুণেরা বিনিয়োগমুখী না হলে বয়স্কদের সামনে মহাবিপদ

দেশে বর্তমানে কর্মরত মোট জনসংখ্যার মধ্যে ৬০ দশমিক ৪২ শতাংশ বেতন মজুরির বিনিময়ে কাজ করে। এছাড়া ২১ দশমিক ৮৮ শতাংশ মুনাফার উদ্দেশ্যে কাজ করে এবং ৩ দশমিক ৭৫ শতাংশ কাজ করে শিক্ষানবিস হিসেবে। কিন্তু দক্ষ তরুণের সংখ্যা সেভাবে বাড়ছে না।

Advertisement

২০১২ সাল থেকে ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড শুরু হয়েছে এবং ২০৪০ সাল নাগাদ কর্মক্ষম জনসংখ্যা কমতে শুরু করবে, যার প্রভাব ২০৫০ সাল পর্যন্ত থাকতে পারে। যদি বাংলাদেশ তার তরুণ কর্মীবাহিনীকে যথাযথ শিক্ষা, প্রশিক্ষণ এবং কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করতে পারে, তবে এই ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড দেশের অর্থনীতিকে আরও শক্তিশালী করতে সহায়ক হতে পারে। আর তরুণেরা দক্ষ হয়ে আয় উপার্জন করে যদি তা বিনিয়োগ করে তবে দ্বিতীয় ধাপে অর্থাৎ ২০৪০ সাল থেকে সুফল ভোগ করবে বয়স্ক জনগোষ্ঠী।

তবে তরুদের যদি দক্ষ ও বিনিয়োগমুখী না করা যায়, তাহলে পরবর্তী ধাপে বয়স্ক জনগোষ্ঠী মহাবিপদে পড়তে যাচ্ছে বলে মত দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।

বর্তমানে বাংলাদেশ জনমিতিক সুবিধা ভোগ করছে। অর্থাৎ, দেশের কর্মক্ষম মানুষের সংখ্যা বেশি, নির্ভরশীল মানুষের সংখ্যা কম। জনমিতির এই সুবিধা কাজে লাগিয়ে সিঙ্গাপুর, হংকং, চীন, থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়াসহ বিশ্বের অনেক দেশ অর্থনৈতিক উন্নয়ন করেছে। কিন্তু বাংলাদেশ সেই সুবিধা কতটা কাজে লাগাতে পারছে, তা নিয়ে প্রশ্ন রয়ে গেছে। মোট জনসংখ্যার ৪ ভাগের ১ ভাগ এখন তরুণ, যাদের বয়স ১৫ থেকে ২৯ বছরের মধ্যে। সংখ্যায় ৪ কোটি ৭৪ লাখ।

Advertisement

সংশ্লিষ্টদের দাবি, দক্ষ তরুণদের মাধ্যমে জনমিতিক সুবিধা কাজে লাগাতে হবে। তাদের অর্জিন সম্পদ বিনিয়োগ করতে হবে। সেই বিনিয়োগ দিয়ে যেন পরবর্তী ধাপে বয়স্করা আরামদায়ক জীবনযাপন করতে পারেন। যেমন, সিঙ্গাপুরে তাদের তরুণদের অর্জিত সম্পত এখন বয়স্করা ভোগ করছেন।

এই প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পপুলেশন অ্যান্ড সায়েন্স বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক আবু হাসনাত মো. কিশোয়ার হোসেইন জাগো নিউজকে বলেন, প্রথম জনমিতিক সুবিধার লভ্যাংশটা যদি ঠিকমতো অর্জন করা যায়, তবে ২০৪০ সাল থেকে দ্বিতীয় ডেমোগ্রাফিক আয় সেভিংসের মাধমে পরবর্তীতে বয়স্করা সুবিধা ভোগ করতে পারবেন। সিঙ্গাপুর তাদের প্রথম ধাপের অর্জন দেশে-বিদেশে বিনেয়াগ করেছিল। তাদের এখন পেছনে ফিরে তাকাতে হচ্ছে না।

তিনি আরও বলেন, আমাদের প্রথমটার প্রপার আউটকাম করতে পারলে সেই সেভিংসে বয়স্করা বসে খাবে। দক্ষ তরুণদের সম্পদ সেভিংস করতে হবে। আপনার টাকা দেশে ঘুরপাক খাবে। জিডিপির মাধ্যমে এই অর্থ সবার ভোগ করতে হবে। তবে তার আগে দেশের জনগোষ্ঠীকে দক্ষ, শিক্ষিত করে গড়ে তুলতে হবে, বাস্তবমুখী কাজে প্রশিক্ষণ দিতে হবে। তবে সেভাবে দক্ষতা বাড়াতে পারি নাই। এখনও অনেক তরুণই বেকার। তারা কীভাবে সেভিংস করবে?

অধ্যাপক আবু হাসনাত বলেন, দেশে সাড়ে ৫ কোটি তরুণ। বেকারও কম নেই। ফলে আমরা জনমিতিক সুফল ভোগ করতে পারিনি। এখন হাতে সময় আছে, তরুণদের দক্ষ করে গড়ে তুলতে হবে। ৫ থেকে ১০ মাসের যে কোনো দক্ষ কাজের প্রশিক্ষণ দিয়ে দেশে-বিদেশে কাজের সুযোগ করে দিতে হবে।

Advertisement

বয়সভিত্তিক বিভাজন

তারুণ্যের বয়সভিত্তিক বিভাজন নিয়ে জনশুমারি ও গৃহগণনার প্রতিবেদনে দেখা যায়, দেশে ১৫ থেকে ১৯ বছর বয়সী মোট জনগোষ্ঠী এখন ১০ দশমিক ১০ শতাংশ। ২০ থেকে ২৪ বছর বয়সীর হার ৯ দশমিক ১৭ শতাংশ। আর ২৫ থেকে ২৯ বছর বয়সীর হার ৯ দশমিক ১৭ শতাংশ। দেশে ১৫ থেকে ২৯ বছর বয়সীদের তরুণ হিসেবে ধরা হয়। সে হিসেবে তারুণ্যের হার ২৭ দশমিক ৯৬ শতাংশ, সংখ্যায় যা পৌনে পাঁচ কোটি।

বিবিএস জানায়, ২০২৩ সালে দেশে ১৫ থেকে ৬৪ বছর বয়সী জনগোষ্ঠীর হার ছিল ৬৫ দশমিক শূন্য ৮ শতাংশ; ২০১৯ সালে যা ছিল ৬৬ দশমিক ১৯ শতাংশ। অর্থাৎ এই পাঁচ বছরে দেশে কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীর হার ১ দশমিক ১১ শতাংশ কমেছে। অন্যদিকে, ২০২৩ সালে দেশে ৬৫ বছরের বেশি বয়সের জনগোষ্ঠী ছিল মোট জনসংখ্যার ৬ দশমিক ১৪ শতাংশ; ২০১৯ সালে এ হার ছিল ৫ দশমিক ২৮ শতাংশ। সেই হিসেবে বয়স্ক মানুষের হার বেড়েছে প্রায় ১ শতাংশ। দেশের ৬৫ শতাংশের বেশি মানুষ এখনো কর্মক্ষম। ফলে জনমিতির সুবিধা কাজে লাগানোর ক্ষেত্রে অনুকূল সময় বিরাজ করছে।

তবে বিশ্লেষকেরা মনে করেন, জনসংখ্যার বেশির ভাগ মানুষ কর্মক্ষম হলেই যে একটি দেশ জনমিতির লভ্যাংশ নিতে পারবে, তা নয়। এ সুবিধা নিতে হলে কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীকে যথাযথভাবে কাজে লাগাতে হবে।

অর্থনীতিবিদদের দাবি, বয়স্ক জনগোষ্ঠী আগামীতে আরও বাড়বে। এখন যে তরুণ জনগোষ্ঠী আছে, তাদের কাজে লাগাতে মানসম্মত শিক্ষা, উন্নত প্রযুক্তি ও প্রশিক্ষণ নিশ্চিত করতে হবে। বাংলাদেশ এলডিসি উত্তরণ ঘটাতে যাচ্ছে; এরপর আমরা বাজার সুবিধা হারাব এবং প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হব। সেই পরিস্থিতি মাথায় রেখে আমাদের তরুণ জনগোষ্ঠীর দক্ষতা বৃদ্ধির বিকল্প নেই।

এই প্রসঙ্গে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) সাবেক মহাপরিচালক ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ মুস্তফা কে মুজেরি জাগো নিউজকে বলেন, বাংলাদেশ বর্তমানে ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ডের সুবিধা ভোগ করছে, কারণ এখানে কর্মক্ষম মানুষের সংখ্যা নির্ভরশীল মানুষের সংখ্যার চেয়ে বেশি। এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হতে হলে, যথাযথ পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করা জরুরি।

তিনি বলেন, এখন সংখ্যায় আয়-রোজগার করা মানুষ বেশি, নির্ভরশীল কম। নির্ভরশীল মূলত শিশু ও বয়স্করা। ২০৫০ সালে শিশুরা সংখ্যার অনুপাত আরও কমতে থাকবে। শিশুর জনসংখ্যা অনুপাত কমছে, কিন্তু বয়স্কদের অনুপাত বাড়ছে। গড় আয়ু বাড়ছে। যত দিন যাবে, মেডিকেল উন্নত হচ্ছে, চিকিৎসার উন্নয়ন হচ্ছে। ফলে বয়স্ক মানুষ বাড়ছে। এখন কর্মক্ষম বেশি অবস্থায় আছি আমরা। এই সুযোগ নিতে হবে। যাতে অর্থনীতি দ্রুতগতিতে এগিয়ে যেতে পারে। তাহলে বৃদ্ধ মানুষদের সামাজিক নিরাপত্তা বাড়ানো যায়, সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত হয়।

জনসংখ্যার সুফল ভোগ করার কৌশল উল্লেখ করে এই অর্থনীতিবিদ বলেন, তরুণদের শিক্ষা মানসম্মত হতে হবে। দেশে-বিদেশে চাহিদা আছে এমন শিক্ষায় তরুণদের শিক্ষিত করতে হবে। তাদের দক্ষ জনশক্তিতে রুপান্তর করলে এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করা যাবে। তরুণদের কর্মক্ষমতা ও চাহিদাভিত্তিক দক্ষতা দিয়ে কর্মের বাজারে ছেড়ে দিতে হবে। তাদের আয় রোজগার হবে, প্রবৃদ্ধি বাড়বে, দেশের উন্নয়ন হবে। ভবিষ্যত চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে। মানস্মত শিক্ষা, উন্নত স্বাস্থ্য ব্যবস্থা, সামাজিক নিরাপত্তা বাড়বে। জনমিতিক ডিভিডেন্ডের সুফল অর্জন করতে না পারলে সবকিছু বিফলে যাবে।

এমওএস/এএমএ/এএসএম