কৃষি ও প্রকৃতি

পেঁয়াজে স্বয়ংসম্পূর্ণতা কতদূর?

পেঁয়াজে স্বয়ংসম্পূর্ণতা কতদূর?

মনিরুল ইসলাম মিন্টু

Advertisement

পেঁয়াজ উৎপাদনে বাংলাদেশ বিশ্বে রয়েছে তৃতীয় স্থানে। কিন্তু অবাক করা বিষয় হলো—আমদানিতেও আমরা রয়েছি তালিকার ওপরে! কারণ দেশের মোট চাহিদার পুরোটা এখনো পূরণ হয় না স্থানীয় উৎপাদন দিয়ে। বছর বছর তাই আলোচনার কেন্দ্রে এসেছে এর ঝাঁজ। কখনো চাহিদা বেড়ে গেছে, আবার কখনো দাম ছুঁয়েছে নাগালের বাইরে। ভারত নির্ভরতায় ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছিল দেশের পেঁয়াজ বাজার।

দেশের বার্ষিক পেঁয়াজ চাহিদা এখন প্রায় ৩৬ লাখ মেট্রিক টন। সেই হিসেবে উৎপাদন চাহিদার চেয়েও বেশি। তবুও প্রতি বছর আমদানি হচ্ছে গড়ে ৭ থেকে ১০ লাখ মেট্রিক টন পেঁয়াজ! এর কারণ ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ পেঁয়াজ নষ্ট হয়ে যায় সঠিক সংরক্ষণের অভাবে। এটাই তৈরি করে কৃত্রিম ঘাটতি।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের গত ১০ বছরে পেঁয়াজ চাষ ও উৎপাদনের চিত্র বিশ্লেষণে দেখা যায়, আবাদ বেড়েছে প্রায় দেড় গুণ, উৎপাদন বেড়েছে দ্বিগুণের বেশি। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ২ লাখ ১৬ হাজার হেক্টর জমিতে উৎপাদন ছিল ২১ লাখ ৩০ হাজার মেট্রিক টন পেঁয়াজ। ২০১৯-২০ অর্থবছরে এসে ২ লাখ ৩৭ হাজার জমিতে ফলন হয় ২৫ লাখ ৬০ হাজার মেট্রিক টন। সময় বদলেছে। বাংলাদেশ এখন শুধু ভারতের দিকেই তাকিয়ে নেই। মূল লক্ষ্য—পেঁয়াজে স্বয়ংসম্পূর্ণতা। এ ক্ষেত্রে ২০২৪-২৫ সালে উৎপাদন দাঁড়ায় রেকর্ড ৪৪ লাখ ৪৮ হাজার ৭০০ মেট্রিক টনে।

Advertisement

দেশে মূলত দুই ধাপে পেঁয়াজ চাষ হয়—একটি মুড়িকাটা, আরেকটি হালি বা বীজ পেঁয়াজ। উৎপাদনের শীর্ষে রয়েছে পাবনা, ফরিদপুর, রাজবাড়ী ও রাজশাহী। গত অর্থবছরে শুধু পাবনাতেই চাষ হয়েছে ৫২ হাজার হেক্টর জমিতে। এরপর ফরিদপুর ৪৩ হাজার এবং রাজবাড়ীতে ৩৬ হাজার হেক্টরেরও বেশি জমিতে।

মৌসুমের শুরুতে পেঁয়াজের দাম কম থাকলেও বর্ষা শেষে দেশে দেখা দেয় পেঁয়াজের সংকট। সেই শূন্যতা পূরণে আশার আলো দেখাচ্ছে গ্রীষ্মকালীন বারি পেঁয়াজ-৫। বগুড়ার মসলা গবেষণা কেন্দ্র উদ্ভাবিত বারি পেঁয়াজ-৫ জাতটি বছরে তিনবার চাষযোগ্য। এতে কম খরচে, কম সময়ে মিলছে বেশি উৎপাদন। পাবনার ঈশ্বরদীর কৃষক শাজাহান আলী বাদশা গত বছর এ জাত আবাদ করে বিঘায় উৎপাদন করেছেন প্রায় ২০০ মণ পেঁয়াজ! চাঞ্চল্য ছড়িয়েছে স্থানীয় কৃষকদের মাঝে। এ পেঁয়াজ চাষে সময় কম লাগে, খরচও কম। ফলন বেশি হচ্ছে।

বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের ভারপ্রাপ্ত মহাপরিচালক মো. আবুল কালাম আজাদ বলেন, ‘গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলোর সমন্বিত উদ্যোগে আগামী দুই থেকে তিন বছরের মধ্যে পেঁয়াজ আমদানি পুরোপুরি বন্ধের লক্ষ্য নিয়েছে বাংলাদেশ। এজন্য জলবায়ু সহিষ্ণু ও অধিক ফলনশীল জাত উদ্ভাবনে আমরা কাজ করছি, যা স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনে সহায়ক হবে।’

আরও পড়ুন ঝিনাইদহে বিদেশি ফল চাষে সম্ভাবনা, আগ্রহী কৃষকেরা  ভোলায় বর্ষাকালে তরমুজ চাষে লাভের স্বপ্ন 

গাইবান্ধার বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের সরেজমিন ও গবেষণা বিভাগের আঞ্চলিক প্রধান ড. আবদুল্লাহ আল মাহমুদ জানান, দেশের উত্তারঞ্চলের যমুনা, ব্রহ্মপুত্র ও তিস্তায় জেগে ওঠা বিস্তৃত চরেও ছড়িয়ে পড়েছে পেঁয়াজের চাষ। স্যান্ডবার ক্রপিংয়ের মাধ্যমে পেঁয়াজ চাষে এখানে লেগেছে এক নতুন উদ্দীপনা। বারি উদ্ভাবিত নানা জাতই বেশি চাষ হচ্ছে চরে।

Advertisement

সংশ্লিষ্টরা জানান, এ পেয়াজ উৎপাদন সবটাই উদ্বৃত্ত। কারণ চরের জমি মূল চাষযোগ্য জমির মধ্যে ধরাই হয় না। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের সরেজমিন শাখার অতিরিক্ত পরিচালক ড. মো. জামাল উদ্দীন বলেন, ‘এই ঘাটতি পুষিয়ে নিতে সরকার নিয়েছে নানা উদ্যোগ। দেশজুড়ে স্থাপন করা হচ্ছে এয়ার-ফ্লো সংরক্ষণাগার—যার মাধ্যমে কম খরচে সংরক্ষণ করা সম্ভব হচ্ছে হাজার হাজার টন পেঁয়াজ। প্রথম ধাপে পেঁয়াজ অধ্যুষিত এলাকায় ৪ হাজার এয়ার-ফ্লো মেশিন বসানো হয়েছে।

এ পদ্ধতিতে একটি সেমিপাকা ঘরের মেঝেতে মাত্র ১০ ফুট দৈর্ঘ এবং ১০ ফুট প্রস্থের একটি বাঁশের মাচা ও ইটের দেওয়াল তৈরি করে তার মাঝে ২০-২২ হাজার টাকা মূল্যের একটি এয়ার-ফ্লো মেশিন বসিয়ে প্রায় ৩০০ মণ পেঁয়াজ সংরক্ষণ করা যায়। এ পদ্ধতিতে পেঁয়াজ সংরক্ষণ করলে পচন ধরবে না। এ ছাড়া পেঁয়াজের ওজন ১০ থেকে ১২ শতাংশের বেশি কমবে না।

তিনি আরও জানান, প্রতি বছর পেঁয়াজের বীজের আমদানি করতে হয়। কৃষককে ৩ থেকে সাড়ে তিন হাজার টাকা পর্যন্ত কিনতে হয়েছে। তাই খরচ কমাতে এখন কৃষক পর্যায়েও বীজ উৎপাদন এবং সংরক্ষণেরও উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর জানায়, কৃষকেরা যাতে উৎপাদন ব্যয় তুলে কিছুটা লাভ করতে পারেন। এজন্য সরকারিভাবেই আমদানিকে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে। ফলে এখন পর্যন্ত এ বছর মাত্র ৩ লাখ মেট্রিক টন পেঁয়াজ আমদানি হয়েছে ভারত থেকে। এর প্রভাব পড়েছে বাজারেও। রাজধানীর পাইকারি বাজার শ্যামবাজারে ঘুরে দেখা যায়, সব আড়তেই দেশে উৎপাদিত পেঁয়াজ। ব্যবসায়ীরা জানান, এবার ফলন ভালো হওয়ায় দেশের পেঁয়াজেই প্রয়োজন মিটবে এমনটি আশা করা হচ্ছে। দেশি পেঁয়াজ মানে অনেক ভালো হওয়ায় চাহিদা সব সময় বেশি থাকে।

একসময় যে পেঁয়াজ বাজার নিয়ন্ত্রণ করতো বাইরের সিদ্ধান্তে—আজ তার নিয়ন্ত্রণের ভার ফিরছে কৃষকের হাতে। তবে এবার পেঁয়াজ উৎপাদন পর্যায়েই খরচ হয়েছে ৪০ থেকে ৪২ টাকা কেজি। কিন্তু মৌসুমের তিন মাস পার হলেও কৃষককে তা পাইকারি বিক্রি করতে হচ্ছে প্রায় ৪০ থেকে ৪৫ টাকার মধ্যে। এটি ৬০ টাকা বিক্রি করতে পারলে কৃষক ভালো লাভ করতে পারতেন। বাস্তবতা হলো কৃষক যদি ভালো দাম না পান, আগামীতে পেঁয়াজের চাষ আবার কমে যাবে। তখন আবার প্রতিবেশী দেশের ওপর নির্ভরশীলতা বাড়বে। ফলে পেঁয়াজে স্বয়ংসম্পূর্ণতা আবার আরও দীর্ঘায়িত হতে পারে।

এসইউ/জিকেএস