আন্তর্জাতিক

সভ্যতার ইতিহাস আর সৌন্দর্যে মোড়া বিশ্বের সেরা ৭ দুর্গ

সভ্যতার ইতিহাস আর সৌন্দর্যে মোড়া বিশ্বের সেরা ৭ দুর্গ

দুর্গের প্রতি মানুষের আকর্ষণ চিরন্তন। ইতিহাসজুড়ে এই স্থাপনাগুলো শুধু রাজাদের আবাস বা প্রতিরক্ষার কেন্দ্র হিসেবেই নয়, একেকটি সভ্যতার নিঃশব্দ প্রহরী হিসেবেও বিবেচিত। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা এই দুর্গগুলোর স্থাপত্যের শৈলী যেমন বৈচিত্র্যময়, তেমনি প্রতিটি দুর্গ বহন করে এক অনন্য ঐতিহাসিক বার্তা।

Advertisement

ইউনেস্কো ঘোষিত বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ হিসেবে তালিকাভুক্ত হওয়ায় এই দুর্গগুলোর গুরুত্ব আরও বেড়ে গেছে। নিচে তুলে ধরা হলো এমনই সাতটি ঐতিহাসিক দুর্গের সংক্ষিপ্ত বর্ণনা, যেগুলো বিশ্বজুড়ে পর্যটকদের মুগ্ধ করে চলেছে।

১. এডিনবরা ক্যাসেল, স্কটল্যান্ড

ছবি: এএফপি

Advertisement

এডিনবরা ক্যাসেল স্কটল্যান্ডের এডিনবরা শহরের একটি প্রাচীন আগ্নেয়গিরির চূড়ায় অবস্থিত একটি ঐতিহাসিক দুর্গ। এটি স্কটল্যান্ডের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও জনপ্রিয় স্থানগুলির মধ্যে একটি। ক্যাসেল রকের উপরে নির্মিত এই দুর্গটি একটি প্রাচীন আগ্নেয়গিরির চূড়ায় অবস্থিত, যা শহর এবং এর চারপাশের অঞ্চলের সুন্দর দৃশ্য তুলে ধরে।

এডিনবরা ক্যাসেলের ইতিহাস বেশ সমৃদ্ধ। এটি একসময় রাজকীয় বাসস্থান, সামরিক ঘাঁটি, কারাগার ও দুর্গ হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। এখানে স্কটল্যান্ডের রাজকীয় কোষাগার, মুকুট ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক নিদর্শন রয়েছে। ১৯৯৫ সালে ইউনেস্কো এটিকে বিশ্ব ঐতিহ্যের স্বীকৃতি দেয়।

বর্তমানে, এডিনবরা ক্যাসেল একটি জনপ্রিয় পর্যটন কেন্দ্র এবং এটি স্কটল্যান্ডের ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। প্রতি বছর লাখ লাখ মানুষ লোক দুর্গটি দেখতে আসেন।

২. হিমেজি ক্যাসেল, জাপান

Advertisement

ছবি: এএফপি

‘হোয়াইট হেরন’ নামে পরিচিত হিমেজি ক্যাসেল তার ঝকঝকে সাদা দেওয়াল ও সূক্ষ্ম ছাদসজ্জার জন্য বিখ্যাত। ১৪শ শতকে নির্মিত এ দুর্গ দেখতে যতটা সুন্দর, তার প্রতিরক্ষাগত দিকও ততটাই সুদৃঢ়। ভূমিকম্প, যুদ্ধ এমনকি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বোমাবর্ষণেও অক্ষত থাকা এই দুর্গটি ১৯৯৩ সালে ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্য তালিকায় যুক্ত হয়।

৩. শঁবোর্দ প্রাসাদ, ফ্রান্স

ছবি: এএফপি

শঁবোর্দ প্রাসাদ হলো ফ্রান্সের লয়ার ভ্যালিতে অবস্থিত একটি ঐতিহাসিক প্রাসাদ। এটি রেনেসাঁ স্থাপত্যের একটি বিখ্যাত নিদর্শন এবং ফ্রান্সের অন্যতম জনপ্রিয় পর্যটন কেন্দ্র। ১৫১৬ সালে চতুর্থ ফ্রাঁসোয়ার নির্দেশে এই প্রাসাদের নির্মাণ কাজ শুরু হয়েছিল। ১৫০০ সালের দিকে রাজা ফ্রঁসিস প্রথমের আদেশে নির্মিত এই বিশাল দুর্গ তার স্পষ্ট প্রতিসাম্য, জটিল চক্রাকার সিঁড়ি ও লিওনার্দো দা ভিঞ্চির প্রভাবে নির্মিত নকশার জন্য বিখ্যাত

শঁবোর্দ প্রাসাদের প্রধান আকর্ষণগুলির মধ্যে রয়েছে- দুর্গটির অসাধারণ স্থাপত্যশৈলী, যা রেনেসাঁ ও ফরাসি গথিক স্থাপত্যের মিশ্রণে গঠিত। এর বিখ্যাত ‘ডাবল হেলিক্স’ সিঁড়ি, যা একই সঙ্গে দুটি ভিন্ন পথ দিয়ে উপরে ওঠে কিন্তু কখনো মিলিত হয় না। আরও রয়েছে প্রাসাদের চারপাশের বিশাল বনভূমি এবং বাগান, প্রাচুর্যময় অলঙ্করণ ও কারুকার্য। প্রাসাদের ছাদের জটিল নকশা ও গঠনশৈলী।

৪. প্রাগ ক্যাসেল, চেক প্রজাতন্ত্র

ছবি: এএফপি

প্রাগ ক্যাসেল হল চেক প্রজাতন্ত্রের প্রাগ শহরে অবস্থিত একটি ঐতিহাসিক দুর্গ ও প্রাসাদ কমপ্লেক্স। এটি বিশ্বের বৃহত্তম দুর্গগুলির মধ্যে অন্যতম ও চেক ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতীক।

গিনেস বুক অফ রেকর্ডস অনুসারে, প্রাগ ক্যাসেল হল বিশ্বের বৃহত্তম প্রাচীন দুর্গ, যার আয়তন প্রায় ৭০,০০০ বর্গমিটার। ১১০ একর (৪৫ হেক্টর) জুড়ে বিস্তৃত এই দুর্গটি ৮ম শতাব্দীর শেষদিকে প্রিমিস্লিড রাজবংশের প্রিন্স বোরিভোজ দ্বারা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। এখানে সেন্ট ভিটাস ক্যাথেড্রাল, পুরাতন রাজার প্রাসাদ, সেন্ট জর্জ ব্যাসিলিকা এবং আরও অনেক ঐতিহাসিক ভবন রয়েছে।

এটি রোমানেস্ক, গথিক ও বারোক স্থাপত্যের সম্মিলনে তৈরি একটি বিশাল দুর্গ কমপ্লেক্স, যার মধ্যে রাজপ্রাসাদ, চার্চ, প্রতিরক্ষা কাঠামো ও বাগান রয়েছে। ইউনেস্কো ১৯৯২ সালে ‘প্রাগের ঐতিহাসিক কেন্দ্রের’ অংশ হিসেবে একে স্বীকৃতি দেয়।

৫. আলহামব্রা প্রাসাদ ও দুর্গ, স্পেন

ছবি: এএফপি

স্পেনের মুসলিম সভ্যতা ও স্থাপত্যের শীর্ষ আকর্ষণ হলো গ্রানাডার আলহামব্রা প্রাসাদ ও দুর্গ। নবম শতকে দক্ষিণ স্পেনের সাবিকা পাহাড়ের ওপর নির্মিত একটি দুর্গের ভিত্তির ওপর একাদশ শতাব্দীতে আলহামব্রা দুর্গ-প্রাসাদের পত্তন ঘটান স্পেনের শেষ মুসলিম শাসকগোষ্ঠী নাসরিদ বংশের মোহাম্মদ বিন আল আহমার ও এর পরিবর্তন-পরিবর্ধন চলে পরবর্তী দেড়শ বছর।

সমসাময়িক বাইজেন্টাইন ও আব্বাসীয় মুসলিম স্থাপত্যশিল্পের প্রভাব ছাড়াও আইবেরিয়ান পেনিনসুলায় সুদীর্ঘ ৮০০ বছরের মুসলিম স্থাপত্যের পরম্পরা এবং নিজস্ব শৈল্পিক উদ্ভাবনার মিশেল ঘটিয়ে তৈরি হয় স্থানীয়ভাবে প্রাপ্ত বিশেষ ধরণের লাল মাটিতে নির্মিত দুর্গ-প্রাসাদ এটি।

এর ঝরঝরে নকশা, আরবি শিলালিপি ও শান্ত বাগান আজও দর্শনার্থীদের বিমুগ্ধ করে। ১৯৮৪ সালে এটি ইউনেস্কো ঘোষিত বিশ্ব ঐতিহ্য হিসেবে তালিকাভুক্ত হয়।

৬. মঁ স্যাঁ মিশেল, ফ্রান্স

ছবি: এএফপি

ফ্রান্সের উত্তরাঞ্চলে অবস্থিত এই দুর্গটি একাধারে ধর্মীয় তীর্থস্থান ও প্রতিরক্ষা কাঠামো। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে এটি সামরিক ও ধর্মীয় ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। একক দ্বীপের মতো দেখতে এই দুর্গ ও তার ঘিরে থাকা উপসাগর ১৯৭৯ সালে ইউনেস্কোর তালিকায় যুক্ত হয়।

নরম্যান্ডির উপকূল থেকে আধা মাইলেরও কম দূরত্বের একটি পাথুরে দ্বীপের উপরে অবস্থিত, এই স্থানটি এখন ফ্রান্সের সবচেয়ে স্বীকৃত ল্যান্ডমার্কগুলোর মধ্যে একটি। হাজার বছর পুরানো এই দুর্গে, প্রতি বছর ৩০ লাখেরও বেশি পর্যটক ভ্রমণে আসে। মঁ স্যাঁ মিশেল ও এর উপসাগর উভয়ই ইউনেস্কোর ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইটের তালিকায় রয়েছে।

৭. পেনা প্রাসাদ, পর্তুগাল

ছবি: এএফপি

পর্তুগালের সিন্ট্রা শহরের সাও পেদ্রো ডি পেনাফেরিমে অবস্থিত রোমান্টিকস প্রাসাদটির নাম পেনা জাতীয় প্রাসাদ। এই স্থাপনায় অনুপ্রবেশ ঘটানো হয়েছে নব্য ইসলামী, নব্য গোথিক, নব্য ম্যানুলাইন এবং নব্য রেনেসাঁ কারুকাজের সমাবেশ। প্রায় পুরো প্রাসাদটি পাথরের ওপর অবস্থিত। গঠনগত দিক থেকে প্রাসাদটিতে চারটি অংশ রয়েছে। রৌদ্রোজ্জ্বল দিনে নয়নাভিরাম এ প্রাসাদটি রাজধানী লিসবন ও শহরের অন্যান্য স্থান থেকে সহজেই দেখা যায়। এটি একটি জাতীয় স্থাপনা এবং এর মাধ্যমে ১৯ শতকের রোমান্টিসিজমের বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে। ১৯৯৫ সালে ইউনেস্কো স্বীকৃতি পায়।

সংস্কৃতি, ইতিহাস আর স্থাপত্যের নিদর্শন খুঁজতে চাইলে এই দুর্গগুলো নিঃসন্দেহে সেরা গন্তব্য। ইউনেস্কোর স্বীকৃতি প্রাপ্ত এই ঐতিহাসিক কাঠামোগুলো বিশ্বসভ্যতার অবিচ্ছেদ্য অংশ, যা আজও অতীতের গল্প বয়ে চলেছে নিঃশব্দে।

সূত্র: জাগরণ জোশ

এসএএইচ