প্রেম তো হওয়ার কথা ছিল একটুকু আশ্রয়, একফালি মুক্তির আলো। কিন্তু যদি সেই প্রেমই একসময় নিঃশ্বাস আটকে দেয়? যেখানে ভালোবাসার নামে আপনি হারিয়ে ফেলেন নিজের ইচ্ছা, স্বাধীনতা, এমনকি আত্মপরিচয়ও। এটা তখন আর প্রেম থাকে না, রূপ নেয় এক মানসিক দখলদারত্বে।
Advertisement
আনন্দের মোড়কে শুরু হলেও সেই সম্পর্কের ভেতর ঢুকে দেখা যায়, আপনি কেবলই ‘তার মতো’ হতে শিখছেন। তার মতো পোশাক, তার মতো চিন্তা, এমনকি তার অনুমতি ছাড়া ভাবনারও কোনো স্বাধীনতা নেই। তখন সেটাকে আর প্রেম বলা চলে না। এটা হয়ে ওঠে এক ধরনের মানসিক শাসন; নরম অথচ শক্তিশালী, যেন মিষ্টি বুলিতে মোড়ানো শিকল। এই শিকলের নাম লাভ বোম্বিং।
লাভ বোম্বিংয়ের সবচেয়ে নিঃশব্দ অথচ ভয়ংকর দিক, যেখানে ভালোবাসার ছায়ায় আপনি নিজেই হারিয়ে যান। এই গল্প শুধু একজনের নয়, আমাদের আশপাশেই এমন অসংখ্য মুখ; যারা হাসছে ঠিকই, কিন্তু ভেতরে ভেতরে চুপচাপ নিজের অস্তিত্ব খুঁজছে। এই লেখায় থাকছে তেমনই এক সম্পর্কের অদৃশ্য দুঃখ, যা বুঝতে না পারলে আমরা বারবার হারাবো নিজের কাছেই।
আপনিও কি বুঝতে পারছেন, আপনার ভালোবাসা আপনাকে গড়ে তুলছে? নাকি ধীরে ধীরে গিলে নিচ্ছে আপনার স্বাধীনতা?
Advertisement
‘লাভ’ শব্দটা শুনলেই চোখে-মুখে যে কোমলতা ফুটে ওঠে, লাভ বোম্বিং তার সম্পূর্ণ বিপরীত। এটা প্রেমের ছদ্মবেশে ঘটে যাওয়া এক ধরনের মানসিক হস্তক্ষেপ। এটি এমন এক কৌশল, যেখানে প্রথমে কাউকে অতিরিক্ত ভালোবাসা, প্রশংসা, উপহার আর মনোযোগ দিয়ে বিমোহিত করা হয়-ঠিক যেন কোনো মধুর ফাঁদ। কিন্তু সেই মধুরতার আড়ালে লুকিয়ে থাকে নিয়ন্ত্রণ, চেপে ধরা, আর ধীরে ধীরে মানসিকভাবে দুর্বল করে ফেলার পরিকল্পনা।
আরও পড়ুন প্রেম ও চকলেট, যুগ যুগ ধরে চলা এক অবিচ্ছেদ্য বন্ধন বন্ধু যদি নেশায় জড়ায় স্মার্টফোন না থাকলেই দমবন্ধ লাগে? জেনে নিন ভয়টির নাম ও প্রতিকারজুলি এল. হল তার ‘দ্য নার্সিসিস্ট ইন ইয়োর লাইফ’ বইয়ে লাভ বোম্বিংকে ‘একটি নিখুঁত প্রেমিকের মুখোশ পরে শিকারে ঝাঁপিয়ে পড়া’ বলে উল্লেখ করেছেন।
জ্যাকসন ম্যাকেঞ্জি তার ‘সাইকোপ্যাথ ফ্রি’ বইয়ে দেখিয়েছেন কিভাবে আত্মপ্রেমী বা সাইকোপ্যাথ ব্যক্তিরা শুরুতে অতিরিক্ত ভালোবাসা দেখিয়ে একটি মিথ্যা ‘পারফেক্ট’ সম্পর্কের ছাপ তৈরি করে। একই সঙ্গে তিনি তার ‘হোলে অ্যাগেইন’ বইয়ে ভুক্তভোগীদের পুনরুদ্ধারের কথা বলেন। লাভ বোম্বিংয়ের পর মানসিক ট্রমা, আত্মবিশ্বাসের অভাব ও সন্দেহ কিভাবে তৈরি হয়, তাও বিশ্লেষণ করেছেন।
শুরুটা যেন রূপকথাএকজন মানুষ হঠাৎ করে আপনাকে জানিয়ে দিলেন ‘তুমি ছাড়া আমি অসম্পূর্ণ!’ রোজ সকালে শুভেচ্ছাবার্তা, কাজের মাঝে উদ্বিগ্ন খোঁজ, হুটহাট দামি উপহার, কিংবা অঝোর প্রশংসার বন্যা; সব মিলিয়ে মনে হতে পারে ‘এটাই তো সত্যিকারের ভালোবাসা!’
Advertisement
তিনদিনেই ভালোবাসার প্রস্তাব, একসপ্তাহেই ভবিষ্যতের পরিকল্পনা-এত দ্রুত কীভাবে? এটাই লাভ বোম্বিংয়ের প্রথম ধাপ, যেখানে একধরণের আকস্মিক আবেগ দিয়ে আপনাকে ঘিরে ফেলা হয়, যেন আপনি না চাইতেও সেই জালে জড়িয়ে যান।
সম্পর্ক যখন পাল্টে যায় অচেনা এক খেলায় প্রথম দিকের সেই উষ্ণতা হঠাৎ ঠান্ডা হয়ে আসে। যিনি একসময় আপনাকে চোখের মণির মতো আগলে রাখতেন, তিনিই আজ আপনাকে এড়িয়ে যান। মেসেজের জবাব আসে না, কথায় বিরক্তির সুর, আচরণে উদাসীনতা। আর তখনই শুরু হয় নিজের উপর সন্দেহ ‘আমি কি কোনো ভুল করেছি?’
আপনার আত্মবিশ্বাস ভেঙে পড়ে। আপনি ভাবেন, তার মন জেতার জন্য আরও কী করতে পারেন। এভাবেই লাভ বোম্বার ধীরে ধীরে আপনাকে এমন জায়গায় নিয়ে যায়, যেখানে আপনি নিজের চেয়েও তার চাহিদাকে প্রাধান্য দেন।
এটি প্রেম নয়, এক ধরনের মানসিক দখললাভ বোম্বিং আসলে একপ্রকার মানসিক নির্যাতন। এটি একধরনের ‘গ্যাসলাইটিং’ যেখানে ধোঁয়াশা তৈরি করে আপনাকে দুর্বল করা হয়। লাভ বোম্বারদের উদ্দেশ্য খুব স্পষ্ট তারা চায় আপনি শুধু তাদের নিয়েই ভাবুন, নিজেকে ভুলে যান, নিজের সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলুন।
নিজেকে চিনুন, সীমানা টানুনআজকের যুগে, বিশেষ করে সামাজিক মাধ্যমে, লাভ বোম্বিং আরও বেশি মারাত্মক। কেউ একজন মাত্র কয়েকদিনের পরিচয়ে আপনাকে জীবনসঙ্গী হিসেবে ভাবতে শুরু করল, বা ইনবক্সে একের পর এক আদরের শব্দ ছুড়ে দিল-এই সবই হতে পারে একটি ছদ্ম ভালোবাসার সূচনা।
আপনি কি এই ফাঁদে আটকে পড়েছেন?কিছু লক্ষণ জেনে নিন, যা বুঝিয়ে দিতে পারে আপনি লাভ বোম্বিংয়ের শিকার কিনা>> সম্পর্ক খুব দ্রুত গাঢ় হয়ে গেছে>> প্রতিটি মুহূর্তে আপনাকে ভালোবাসা দেখানো হলেও, আপনার স্বাধীনতা সীমিত হয়ে পড়েছে>> সে আপনাকে অন্যদের থেকে আলাদা করে ফেলছে>> আপনি দিন দিন নিজের পছন্দ-স্বভাব হারিয়ে ফেলছেন>> আপনি প্রায়ই নিজের ভুল খুঁজে বেড়াচ্ছেন, অথচ সমস্যাটা হয়তো ওর মধ্যেই ছিল
কী করবেন এই সম্পর্ক থেকে বেরিয়ে আসতে?>> নিজের অনুভূতিকে গুরুত্ব দিন: আপনি অস্বস্তি বোধ করছেন? তাহলে সেটাই যথেষ্ট।>> নির্ভরযোগ্য কারও সঙ্গে শেয়ার করুন: বন্ধু, পরিবার কিংবা কাউন্সেলর যে আপনাকে বুঝবে।>> নিজের সীমানা নির্ধারণ করুন: ‘না’ বলতে শিখুন, নিজেকে প্রাধান্য দিন।>> নিজের আত্মপরিচয় ফিরিয়ে আনুন: যে জিনিসগুলো আপনাকে ‘আপনি’ করে তোলে সেগুলোর সঙ্গে আবার যুক্ত হোন।>> প্রয়োজন হলে থেরাপিস্ট বা কাউন্সেলরের সাহায্য নিন
ভালোবাসা মানে কখনোই আত্মত্যাগ নয়ভালোবাসা কখনোই এমন কিছু নয় যা আপনাকে কাঁদায়, দমিয়ে রাখে, কিংবা নিঃশেষ করে দেয়। যে সম্পর্ক আপনাকে নিজের কাছেই অপরিচিত করে তোলে, সেটা প্রেম নয়; সেটা এক ধরণের মানসিক ফাঁদ। প্রেম তখনই সুন্দর যখন সেটা নিরাপত্তা, সম্মান আর পারস্পরিক সহমর্মিতার ওপর দাঁড়িয়ে থাকে। ভালোবাসা যেন হয় মুক্তির পথ, কোনো জাল নয়। নিজেকে ভালবাসুন, নিজের সীমারেখাকে সম্মান করুন। সত্যিকারের ভালোবাসা কখনও আপনাকে দুর্বল করে না, বরং আপনাকে আরও শক্ত করে তোলে।
তথ্যসূত্র: হেলথ লাইন ও সাইকোলজি টুডে
জেএস/জিকেএস