বিকেএসপির সাবেক শিক্ষার্থী আফঈদা খন্দকার প্রান্তিকে ভাগ্যবতী বলতেই হবে। নারী ফুটবলে বাংলাদেশ যে ইতিহাস তৈরি করেছে তার নেতৃত্বে সাতক্ষীরার এই যুবতি। বয়সভিত্তিক দলে অধিনায়কত্ব করা আফঈদা জাতীয় দলের দায়িত্ব পেয়েছেন সাবিনা খাতুনরা বাদ পড়ার পর। অধিনায়ক হিসেবে এ পর্যন্ত ৭ ম্যাচ খেলা হয়ে গেছে তার। এরই মধ্যে তার নেতৃত্বে বাংলাদেশ রেকর্ড করেছে এশিয়ান কাপে খেলার যোগ্যতা অর্জন করে।
Advertisement
কেমন ছিল মিয়ানমারে এশিয়ান কাপ বাছাইয়ের মিশন? এশিয়ার সবচেয়ে বড় মঞ্চে খেলা নিশ্চিতের পর এখন আফঈদাদের সামনে বিশ্বকাপ ও অলিম্পিকের হাতছানি। এশিয়ান কাপ বাছাই, অস্ট্রেলিয়া মিশন এবং দেশের নারী ফুটবল নিয়ে জাগো নিউজের বিশেষ সংবাদদাতা রফিকুল ইসলামকে একান্ত সাক্ষাৎকার দিয়েছেন অধিনায়ক আফঈদা।
জাগো নিউজ: বাংলাদেশকে প্রথমবারের মতো এএফসি এশিয়ান কাপে তুলে দেশে ফিরেছেন তিনদিন হলো। দেশে ফেরার পর এই কয়টা দিন কেমন কাটালেন?
আফঈদা খন্দকার: মিয়ানমার থেকে থাইল্যান্ড হয়ে ঢাকায় আসার পর গভীর রাতে হাতিরঝিলের অনুষ্ঠান শেষ করে বাফুফে ভবনে আসতে আসতে ভোর হয়ে যায়। বিশ্রাম কমই পেয়েছি। এসেই আবার আমাদের নেমে পড়তে হয়েছে সাফ অনূর্ধ্ব-২০ চ্যাম্পিয়নশিপের প্রস্তুতিতে।
Advertisement
জাগো নিউজ: মিয়ানমার সফরে থাকা জাতীয় দলের যারা অনূর্ধ্ব-২০ দলেও আছেন, তাদের কি কোনো বিশ্রাম দেওয়া হয়নি?
আফঈদা: মঙ্গলবার থেকে অনূর্ধ্ব-২০ দলের অনুশীলন শুরু হয়েছে। আমাকে প্রথম দিন বিশ্রাম দেওয়া হয়েছিল। কারণ, আমি টানা তিন ম্যাচে পুরো সময় খেলেছি।
জাগো নিউজ: মিয়ানমার যাওয়ার আগে জাগো নিউজকেই সাক্ষাৎকারে এশিয়ান কাপে কোয়ালিফাই প্রসঙ্গে বলেছিলেন, ‘মানুষ চাইলে অনেক কিছু পারে।’ এশিয়া কাপে কোয়ালিফাই করার পর এখন কি মনে হয় চাইলে বিশ্বকাপ পর্যন্ত যাওয়া সম্ভব?
আফঈদা: মিয়ানমার যাওয়ার আগে বলেছিলাম, ইন্দোনেশিয়া ও জর্ডানের বিপক্ষে ম্যাচ দুটি খেলার পর আমাদের আত্মবিশ্বাস বেড়েছিল। এখন মিয়ানমারে তিন ম্যাচ জিতে সেই আত্মবিশ্বাস আরো বেড়েছে। একটা সুযোগ যেহেতু আছে, বিশ্বকাপে খেলার জন্য আমরা সর্বোচ্চ দিয়ে চেষ্টা করবো। কথাটি আবারো বলবো, ‘মানুষ চাইলে অনেক কিছু পারে।’ জাগো নিউজ: কোন বিষয়টি মাথায় রেখে এশিয়ান কাপে কোয়ালিফাইয়ের কল্পনা করেছিলেন। যেখানে মিয়ানমার ও বাহরাইন বাংলাদেশের চেয়ে অনেক শক্তিশালী দল?
Advertisement
আফঈদা: আমাদের চিন্তা ছিল, যদি মিয়ানমারের সাথে ড্র করতে পারি তাহলে গোল ব্যবধানে একটা সুযোগ আসতে পারে। এ বিষয়টি মাথায় রেখেই আমরা কোয়ালিফাইয়ের লক্ষ্যের কথা বলেছিলাম। আর ওই যে জর্ডান ও ইন্দোনেশিয়ার বিপক্ষে ড্র করে আত্মবিশ্বাস বেড়েছিল। শক্তিতে এগিয়ে থাকা দলের সাথে যতো বেশি খেলবো তত আত্মবিশ্বাস বাড়বে।
জাগো নিউজ: মিয়ানমারের বিপক্ষে মাঠে নামার পর অধিনায়ক হিসেবে সতীর্থদের কি বলেছিলেন? নিজে কোনো চাপ অনুভব করেছিলেন?
আফঈদা: আসলে আমাদের সবার মধ্যে একটা জিদ ছিল যে কোয়ালিফাই করতেই হবে। আগে একবার মিয়ানমারে আমরা যেতে পারিনি অর্থের অভাবে। এবার সেই মিয়ানমারকে হারাতেই হবে- এমন জিদ ছিল সবার মধ্যে। আর অধিনায়ক হিসেবে আমি কোনো চাপ অনুভব করিনি। আমরা মাঠে একটি দল হিসেবেই খেলি। ২৩ জনের কষ্টের ফসল আজকের এই সফলতা।
জাগো নিউজ: বাহরাইনও তো অনেক শক্তিশালী দল। তো ৭ গোল দিলেন কিভাবে? কখনো ভেবেছিলেন এতগুলো গোল হবে?
আফঈদা: নামার আগে তো ভাবিনি। আমাদের লক্ষ্য ছিল জেতা। আসলে শুরুতেই যখন গোল পেয়ে যাই তখন সবাই মিলে কথা বলে বড় ব্যবধানে জয়ের লক্ষ্য নির্ধারণ করেছিলাম। কারণ, মিয়ানমারের সাথে ড্র হলে গোল একটা ফ্যাক্টর হতো।
জাগো নিউজ: তুর্কমেনিস্তানের বিপক্ষে প্রথমার্ধে ৭ গোল দিয়ে দ্বিতীয়ার্ধে আর ব্যবধান বাড়াতে পারলেন না। গোল আরো বাড়ানো গেলো না কেন?
আফঈদা: দ্বিতীয়ার্ধে তুর্কমেনিস্তান কিছু খেলোয়াড় পরিবর্তন করেছে এবং পরিকল্পনাও পরিবর্তন করেছিল। প্রথমার্ধে মাঝেমধ্যে তারা আক্রমণে ওঠার চেষ্টা করলেও দ্বিতীয়ার্ধে তা একদমই করেনি। লো ডিফেন্স করে তারা আর কোনো গোল না খাওয়ার কৌশলে খেলেছে। তাদের ১১ জনই নিজেদের সীমানায় খেলেছে। আমরা চেষ্টা করেছিলাম। তবে গোল আর হয়নি। জাগো নিউজ: আরেকটি বিষয়, মিয়ানমার এত শক্তিশালী দল হওয়ার পরও কোচ আপনাদের হাইলাইন ডিফেন্সে খেলিয়েছেন। তাতে কি একটু ঝুঁকি ছিল না?
আফঈদা: ঝুঁকি তো নিতেই হতো। ঝুঁকি না নিলে তো কিছু অর্জন করা যায় না।
জাগো নিউজ: ২-০ গোলে এগিয়ে যাওয়ার পরও মিয়ানমারের মতো দলের বিপক্ষে আপনারা হাই লাইন ডিফেন্স করে খেলেছেন। তখন আপনাদের আরেকটু রক্ষণে মনযোগী হওয়া দরকার ছিল না?
আফঈদা: আসলে আমরা যদি ডিফেন্স করতাম তাহলে প্রতিপক্ষ সুযোগ পেতো আমাদের সীমানায় আসার। আমরা সেটা দিতে চাইনি। তাই শুরু থেকে একই কৌশলে খেলে গেছি কোচের নির্দেশনা অনুযায়ী।
জাগো নিউজ: যখন মিয়ানমার ২-১ করে ফেললো তখন কি ভেবেছিলেন? ফুটবলে তো যে কোনো সময় যে কোনো কিছু হতে পারে। তার ওপর মিয়ানমার শক্তিশালী ও তাদের মাঠে খেলা। তখন কি ভয় লেগেছিলো?
আফঈদা: একটু তো ভয় লাগছিলই। ড্র হয়ে যায় কিনা, ম্যাচটা হাতছাড়া হয়ে যায় কিনা। তাই দাঁতে দাঁত চেপে খেলেছিলাম এবং আল্লাহকে ডেকেছিলাম।
জাগো নিউজ: ২-১ হওয়ার পর সতীর্থদের কি বলেছিলেন?
আফঈদা: মিয়ানমার গোল করার পর বেশি সময় খেলা ছিল না। ওই সময়টুকুতে যেন বল ওদের সীমনায় থাকে, আমাদের রক্ষণে না আসে সেভাবে সতর্ক থাকতে বলেছিলাম সবাইকে। প্লেয়ার টু প্লেয়ার মার্কিং করতে এবং ওরা যাতে খেলতে না পারে সে জন্য মাঠ ছোট করতে বলেছিলাম।
জাগো নিউজ: কখন কিভাবে জানতে পেরেছিলেন যে আপনারা এশিয়ান কাপে কোয়ালিফাই করেছেন?
আফঈদা: আসলে সমীকরণ আমরা জানতাম না। মিয়ানমারের বিপক্ষে ম্যাচ জিতে হোটেলে ফিরে ডিনার করে আমরা যে যার রুমে চলে যাই ঘুমানোর জন্য। তখনই ফেসবুকে একটা পোস্ট দেখলাম যে, আমরা কোয়ালিফাই করেছি বাহরাইন ও তুর্কমেনিস্তানের ম্যাচ ড্র হওয়ার কারণে। একটু পরই আমাদের যে হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে আছে সেখানে দেওয়া হলো কোয়ালিফাই করার খবর।
জাগো নিউজ: ঠিক তখন আমনারা কি করেছিলেন? সবাই কি রুম থেকে বের হয়ে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছিলেন?
আফঈদা: আসলে আমরা সবাই তো ক্লান্ত ছিলাম! যে রুমে যারা যারা ছিলেন তারা নিজেরা একটু আনন্দ করেছিলেন। পরের দিন সকালে রিকভারি সেশন ছিল। নাস্তার টেবিলে সবাই আমরা এ নিয়ে আলোচনা করি। তখন কিছু আনন্দ করেছি। আমাদের সিদ্ধান্ত ছিল শেষ ম্যাচ জিতে আনন্দ করার।
জাগো নিউজ: এখন তো আপনারা আরো বড় মঞ্চে খেলবেন। তো বাফুফের কাছে এশিয়ান কাপে খেলার আগে আপনাদের চাওয়া কি থাকবে?
আফঈদা: আমরা চাইবো যাতে এশিয়ান কাপের আগে শক্তিশালী দেশের সাথে ম্যাচ খেলতে পারি। সেই সাথে আমাদের যেন বিদেশে কন্ডিশনিং ক্যাম্প করার ব্যবস্থা করে। বেটার টিমের সাথে খেললে আমাদের অভিজ্ঞতা আরো বাড়বে।
জাগো নিউজ: সাফ জেতার পর আপনারা প্রধান উপদেষ্টার সাথে দেখা করে কিছু চেয়েছিলেন। কি চেয়েছিলেন?
আফঈদা: আমরা তাঁর কাছে প্লট বা ফ্ল্যাট চেয়েছিলাম। তিনি আমাদের চাহিদাগুলো লিখিতভাবে দিতে বলেছিলেন। আমরা বাফুফের মাধ্যমে জমা দিয়েছি। এর পর কি হয়েছে জানি না। জাগো নিউজ: সাফে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পর বাফুফে দেড় কোটি টাকা পুরস্কার দেবে বলে ঘোষণা দিয়েছিল। এখনো দেয়নি। এবার এই অর্জনের পর অবশ্য কোনো ঘোষণা আসেনি। আপনাদের কোনো দাবিদাওয়া আছে কিনা?
আফঈদা: আমরা মাঠে খেলেছি। দেশের জন্য সম্মান এনেছি। এখন খুশি হয়ে যা দেবে সেটা নিয়েই আমরা সন্তুষ্ট থাকবো।
জাগো নিউজ: ১৫ বছরেই নারী ফুটবল দলের এই সাফল্য আপনি কিভাবে মূল্যায়ন করবেন?
আফঈদা: আসলে যারা ২০০৯ সালে ফুটবল খেলা শুরু করেছিলেন তাদেরকে আমি অভিনন্দন জানাই। ওই সময় আমাদের অগ্রজরা খেলা শুরু না করলে এখানে পৌঁছাতে পারতাম না। আবার ২০১৬ সাল থেকে কিরণ (মাহফুজা আক্তার কিরণ) ম্যাডাম মেয়েদের নিয়ে কাজ করছেন। সাবেক সভাপতি সালাউদ্দিন স্যার ও কিরণ ম্যাডামের অবদান অনেক। বর্তমান সভাপতিও অনেক আন্তরিক। একটা দলতো একদিনেই তৈরি হয় না। দীর্ঘদিন ক্যাম্প করে জুনিয়র দলকে ট্রেনিং করানো হয়েছে। এখন সেই জুনিয়ররাই অভিজ্ঞ হয়েছে।
জাগো নিউজ: সাবিনাসহ সিনিয়র যে খেলোয়াড়রা এখন দলের বাইরে আছেন তাদের কেউ কি আপনাকে অভিনন্দন জানিয়েছেন?
আফঈদা: দেখেছি তারা ফেসবুকে আমাদের অভিনন্দন জানিয়েছেন। তবে ব্যক্তিগতভাবে আমার সাথে কারো কথা হয়নি।
জাগো নিউজ: হাতিরঝিলের সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে আপনার মা ও বড় বোন সাতক্ষীরা থেকে এসেছিলেন। দেখা কি হয়েছিল?
আফঈদা: এক ঝলকে দেখা হয়েছিল। বের হয়ে যাওয়ার সময় মায়ের সাথে দেখা। তিনি ফুল নিয়ে এসেছিলেন। তবে বোন একটু পেছনে ছিলেন। তার সাথে কথা বলতে পারিনি। পরে আমার খুব খারাপ লেগেছিল।
জাগো নিউজ: আপনারা এশিয়া কাপ খেলবেন অথচ আপনাদের ঘরোয়া লিগই ঠিকঠাকভাবে হয় না। এ নিয়ে কিছু বলবেন?
আফঈদা: আমাদের লিগ অনিয়মিত। আমরা আশা করবো লিগটা যেন নিয়মিত হয়।
জাগো নিউজ: এশিয়ান কাপ নিয়ে এখন থেকে কিছু ভাবছেন?
আফঈদা: না। কারণ, এখন আমার সব মনযোগ শুক্রবার থেকে শুরু হতে যাওয়া সাফ অনূর্ধ্ব-২০ চ্যাম্পিয়নশিপ। এই টুর্নামেন্টে আমরা চ্যামিস্পয়ন। আমাদের শিরোপা ধরে রাখতে হবে।
জাগো নিউজ: সময় দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ।আফঈদা: জাগো নিউজকেও ধন্যবাদ।
আরআই/আএইচএস