নীলফামারীর সৈয়দপুর উপজেলার খাতামধুপুর ইউনিয়নের ডাঙ্গাপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। প্রতিষ্ঠানটিতে প্রধান শিক্ষক নেই প্রায় ১০ বছর ধরে। আটজন সহকারী শিক্ষকের জায়গায় আছেন ছয়জন। দীর্ঘদিন প্রধান শিক্ষকের পদ শূন্য। সহকারী শিক্ষক সংকটের কারণে বিদ্যালয়ের প্রশাসনিক কাজ ও শিক্ষার্থীদের পাঠদান ব্যাহত হচ্ছে।
Advertisement
শুধু ডাঙ্গাপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় নয়, জেলার দুই শতাধিক বিদ্যালয়ে একই চিত্র দেখা গেছে। বদলির নতুন পদ্ধতিতেও থামেনি নৈরাজ্য ও ভোগান্তি বলে জানিয়েছেন ভুক্তভোগী শিক্ষকরা। তারা বলছেন, পৌর এলাকা কিংবা যাতায়াতের সুবিধা আছে—এমন বিদ্যালয়গুলোতে প্রধান শিক্ষক ও সহকারী শিক্ষকের কোনো সংকট নেই। আর ইউনিয়ন পর্যায়ে যেসব প্রতিষ্ঠানে যাতায়াতে অসুবিধা আছে—এমন বিদ্যালয়গুলোতে প্রয়োজনের তুলনায় খুবই কম শিক্ষক কর্মরত আছেন। এসব পদলির বেশিরভাগ নিয়ন্ত্রণ করছেন স্থানীয় রাজনৈতিক ব্যক্তি ও শিক্ষক নেতারা। বদলির জন্য ঘুস দিতে হয় ১-৩ লাখ টাকা পর্যন্ত। অথচ মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তর থেকে বলা হয়েছে, শিক্ষকদের সুবিধামতো বদলি করতে হবে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, বিদ্যমান বদলি পদ্ধতিতে শিক্ষকদের একটি সফটওয়্যারের মাধ্যমে নির্ধারিত আইডি ব্যবহার করে আবেদন করতে হয়। এর মাধ্যমে স্বয়ংক্রিয়ভাবেই ওই শিক্ষক বদলির যোগ্য কি-না বা কোন বিদ্যালয়ে বদলি হবেন, তা নির্ধারিত হবে। বদলিপ্রত্যাশী শিক্ষক অনলাইনে আবেদনটি করার পর সেটি প্রাথমিকভাবে যাচাই করেন সংশ্লিষ্ট বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক। তিনিও ওই সফটওয়্যার ব্যবহারের মাধ্যমে যাচাই করে দেবেন উপজেলা সহকারী প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তার কাছে। তিনি সেটি যাচাই করে পাঠাবেন উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তার কাছে। তিনি পাঠিয়ে দেবেন জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তার (ডিপিইও) কাছে। ডিপিইও সেটি চুড়ান্ত যাচাই করে পাঠিয়ে দেবেন অধিদপ্তরে। অধিদপ্তর সেটি মঞ্জুর করে পাঠিয়ে দেবে জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তার কাছে। তিনি তখন বদলির বিষয়ে আদেশ জারি করবেন এবং শিক্ষক সেটি অনলাইনেই জেনে যাবেন।
আরও পড়ুন: প্রাথমিক শিক্ষকদের ফেসবুক ব্যবহারে অধিদপ্তরের কঠোর নজরদারিপ্রাথমিক শিক্ষায় বরাদ্দ কমলো প্রায় সাড়ে ৩ হাজার কোটিপ্রাথমিকে শিক্ষকদের শূন্যপদের তথ্য চেয়েছে অধিদপ্তরতবে খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, ডিজিটাল এ নতুন নিয়মেও এসব বদলির ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত হচ্ছে না। ফলে এখনো প্রতিটি ধাপে শিক্ষকরা যেমন ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন, তেমনি আবেদনকারীদের কাছ থেকে অবৈধ আর্থিক সুবিধা নিচ্ছেন অসাধুরা ব্যক্তিরা।
Advertisement
‘পৌর এলাকা কিংবা যাতায়াতের সুবিধা আছে—এমন বিদ্যালয়গুলোতে প্রধান শিক্ষক ও সহকারী শিক্ষকের কোনো সংকট নেই। আর ইউনিয়ন পর্যায়ে যেসব প্রতিষ্ঠানে যাতায়াতে অসুবিধা আছে—এমন বিদ্যালয়গুলোতে প্রয়োজনের তুলনায় খুবই কম শিক্ষক কর্মরত আছেন। এসব পদলির বেশিরভাগ নিয়ন্ত্রণ করছেন স্থানীয় রাজনৈতিক ব্যক্তি ও শিক্ষক নেতারা। বদলির জন্য ঘুস দিতে হয় ১-৩ লাখ টাকা পর্যন্ত।’
জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্র জানায়, নীলফামারীতে ছয়টি উপজেলায় এক হাজার ৮৪টি প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে। এগুলোর মধ্যে ২২৪টিতে রয়েছেন ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক। সহকারী শিক্ষকের পদ শূন্য ৫৪৯টি। সবচেয়ে বেশি শিক্ষক সংকট ডিমলা উপজেলায়। এখানে ২১৭টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মধ্যে ২০১ জন সহকারী শিক্ষক ও ৪৭টি প্রধান শিক্ষকের পদ শূন্য রয়েছে। জলঢাকা উপজেলায় ২৪৯টি বিদ্যালয়ের মধ্যে ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক রয়েছেন ৫৩ জন, সহকারী শিক্ষক সংকট ১১৯ জন। কিশোরগঞ্জ উপজেলায় ১৭৫টি বিদ্যালয়ের মধ্যে ৪০টিতে প্রধান শিক্ষকের পদ শূন্য। সহকারী শিক্ষক নেই ১১৪ জন। নীলফামারী সদর উপজেলায় ২০৭টি বিদ্যালয়ের মধ্যে ৪৪টিতে প্রধান শিক্ষক ও সহকারীর শিক্ষকের ১৫টি পদ শূন্য।
ডোমার উপজেলায় ১৫৮টি বিদ্যালয়ের মধ্যে প্রধান শিক্ষক নেই ২৭টিতে। ৭৮ জনের সহকারী শিক্ষকের পদ খালি রয়েছে। সৈয়দপুর উপজেলায় রয়েছে ৭৮টি বিদ্যালয়। এখানে ১৩টিতে প্রধান শিক্ষক ও সহকারী শিক্ষকের পদ শূন্য ২২ জনের।
এছাড়া ১৩০টি বিদ্যালয়ে নেই কোনো খেলার মাঠ। খেলার মাঠ না থাকায় শ্রেণিকক্ষে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটাতে হয় শিক্ষার্থীদের। মাঠের অভাবে প্রতিষ্ঠানগুলোতে বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান করা সম্ভব হচ্ছে না।
Advertisement
আমিনুল হক সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থী রুমি আক্তার, ফিরোজা খাতুন ও ইমরান আহমেদ আক্ষেপ করে জাগো নিউজকে বলে, ‘আমাদের বিদ্যালয়ে খেলার মাঠ না থাকায় আমরা খেলাধুলা করতে পারি না। বিদ্যালয়ে আসার পর থেকে সারাক্ষণ শুধু ক্লাসে বসে সময় পার করতে হচ্ছে। ফলে সময় কাটতে চায় না।’
ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষকের দায়িত্বে থাকা ডাঙ্গাপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সুলতান-ই শামসুদ্দিন জাগো নিউজকে বলেন, ‘শিক্ষক সংকটের কারণে প্রতিদিন পাঁচটি ক্লাস নিতে হয়। আবার প্রশাসনিক কাজও করতে হয়। এতে ব্যাহত হচ্ছে পাঠদান। খারাপ যোগাযোগব্যবস্থার কারণে কেউ এখানে আসতে চাচ্ছেন না। এখানে আরও দুজন শিক্ষক পেলে খুব ভালো হতো।’
কয়েকজন শিক্ষক নেতা জানান, যেসব বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষক নেই, সেসব বিদ্যালয়ে প্রশাসনিক ও মনিটরিং ব্যবস্থা ঠিক থাকে না। কারণ ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক দাপ্তরিক ও সরকারের বিভিন্ন কর্মসূচি বাস্তবায়নে ব্যস্ত থাকেন। ফলে সহকারী শিক্ষকরা শিক্ষার্থীদের পাঠদান কার্যক্রম সঠিকভাবে পালন করেন না। তাই প্রধান শিক্ষকসহ সহকারী শিক্ষকের শূন্যপদ পূরণের জন্য সরকারের দ্রুত উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন।
এ বিষয়ে জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা কুমারেশ চন্দ্র গাছি জাগো নিউজকে বলেন, একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্রধান শিক্ষকের শূন্যপদ থাকায় স্বাভাবিক পাঠদান ব্যাহত হচ্ছে। কিন্তু আমাদের পক্ষে করার কিছুই নেই। প্রধান শিক্ষক নিয়োগের ব্যাপারটি এখন সম্পূর্ণ দপ্তর থেকেই নিয়ন্ত্রণ করা হয়। এসব পদ পূরণে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরে চিঠি দেওয়া হয়েছে বলে জানান তিনি।
এসআর/জেআইএম