বাংলা সাহিত্যের বিশেষ জায়গাজুড়ে আছে বৃষ্টি। সাহিত্যিকেরা বৃষ্টিকে আখ্যায়িত করেছেন লেখার অনুপ্রেরণা হিসেবে। যুগে যুগে বৃষ্টির হাত ধরে এসেছে কালজয়ী সব উপন্যাস। বৃষ্টির পটভূমিতে রচিত এসব উপন্যাসে মানুষের মনের সঙ্গে নিবিড় যোগসূত্র আছে।
Advertisement
প্রথমেই স্মরণ করতে হয় ঝড়েশ্বর চট্টোপাধ্যায়ের ‘চরপূর্ণিমা’ উপন্যাসটির কথা। এখানে বৃষ্টির সুন্দর চিত্র ফুটে উঠেছে। এতে লেখা হয়েছে, ‘হঠাৎ ভয়ঙ্কর চিক্কির মেরে মস্ত আঁকাবাঁকা জ্বলন্ত তরোয়াল আকাশ ফালাফালা করে বনবিহারীর খেড়ো আবাস ডিঙিয়ে পুকুর পাড়ের আমগাছটা চমকিয়ে দেয়। সবুজ পাতায় পাতায় বৃষ্টি... বৃষ্টিতে সে আগুন ঝলসে যায়।’ অন্যত্র বলা হয়েছে, ‘কদিনের বর্ষায় ডালে ডালে কচি পাতা, কচি ডগে ক্ষণিকে হাজার ফুলঝুরির চমক।’ (চরপূর্ণিমা)।
মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর ‘পদ্মা নদীর মাঝি’ উপন্যাসে বৃষ্টির বর্ণনা দিয়েছেন এভাবে, ‘আকাশ নিবিড় মেঘে ঢাকিয়া গিয়াছে। দুর্ভেদ্য অন্ধকারে জেলেপাড়ার পথ পায়ের তলেও হইয়া আছে অদৃশ্য। অত্যন্ত সন্তর্পণে পা ফেলিয়া আগাইতে হয়।’ এ উপন্যাসে লেখক গরিব কুবেরের কুটিরের বর্ণনা দিয়েছেন এভাবে, ‘রাত্রি বাড়তে থাকে, বৃষ্টি ধরিবার কোনো লক্ষণ দেখা যায় না, পিসী ঢেঁকি ঘরে গিয়া বাঁক বন্ধ করিয়া শুইয়া পড়ে। ...বাহিরে চলতে থাকে অবিরাম বর্ষণ। কিছুক্ষণ বৃষ্টি হইবার পর ঘরের ফুটা কোন দিয়া ভিতরে জল পড়িতে আরম্ভ করিয়াছিল।’
সমরেশ বসুর উপন্যাস ‘গঙ্গা’য় মেঘ-বৃষ্টির সুন্দর বর্ণনা আছে একাধিকবার। সেখানে বলা হয়েছে, ‘দুদিন ধরে মহিষকালো আকাশে কেবল বিদ্যুতের ঘটা গেল। বৃষ্টি হল ফিসফিস করে। তারপর মহিষগুলো দাপাদাপি করল। বৃষ্টি এল মুষলধারে। মেঘ নামল গড়িয়ে গড়িয়ে, জড়িয়ে ধরতে আসছে যেন গোটা গঙ্গার বুকখানি। বাজ পড়ল হুঙ্কার দিয়ে। পূবসাগরে রুদ্র ঝড় শুরু হল হঠাৎ।’
Advertisement
আমাদের নদীমাতৃক দেশের একটি বৃহৎ জনগোষ্ঠী মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করেন। বর্ষায় উত্তাল নদী-সমুদ্রের বুকে জীবন বাজি রেখে তারা পাড়ি জমান। পদে পদে মৃত্যুর ভয় থাকে। তবুও বর্ষা তাদের কাছে আশীর্বাদ। জল-জাল নিয়ে যাদের জীবন সেই ধীবর সম্প্রদায়ের বর্ষাজীবনের ছবি উঠে এসেছে অসংখ্য উপন্যাসে।
আরও পড়ুন
পর্বত অভিযান নিয়ে শাকিলের যত বই যে পাঁচটি বই একবার হলেও পড়া উচিতঅদ্বৈত মল্লবর্মণের উপন্যাস ‘তিতাস একটি নদীর নাম’র এক জায়গায় আমরা দেখতে পাই, তিতাসের বুকে চর বেড়ে গিয়ে নদী হয়ে গেছে ক্ষীণকায়। অসহায় মালোরা আকুল হয়ে অপেক্ষা করছে কখন বর্ষা নামবে। নদী আবার ফুলে ফেঁপে উঠবে। তাতে আসবে মাছ। যে মাছ তাদের জীবনে বাঁচার রসদ জোগাবে। জেলেদের সেই কঠোর জীবনসংগ্রামের ছবি সুন্দরভাবে ফুটে উঠেছে সমরেশ বসুর উপন্যাস ‘গঙ্গা’তেও।
বৃষ্টি নিম্নবিত্তদের জীবনে ভয়ানক কষ্টও ডেকে আনে। একসময় গ্রামের বাড়িগুলো ছিল খড়ে ছাওয়া, মাটির। বর্ষায় চাল ফুটো হয়ে ঘরে জল পড়তো। বৃষ্টি ভেজা হয়ে দিন কাটাতে বাধ্য হতো মানুষ। সেরকম ছবি দেখতে পাই বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘পথের পাঁচালী’ উপন্যাসে। এক বৃষ্টিমুখর রাতে সর্বজায়া দুর্গাকে বলছে, ‘পাশ ফিরে শো তো দূর্গা। বড্ড জল পড়ছে। একটু সরে পাশ ফির দিকি।’
Advertisement
ফলে মনে হয়, বর্ষার গায়ে ছুঁয়ে থাকে বিদায়ের সুর। পরিচিত কেউ মারা গেলে তাঁর পরিজনের চোখেও বৃষ্টি নামে। তাই তো বৃষ্টি আর বিদায়ের হৃদয়বিদারক দৃশ্য দেখা যায় ‘পথের পাঁচালী’তে। আশ্বিনের অকাল বৃষ্টিতে ভিজে ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হয় দুর্গা। তারপর এক ঝড়-বৃষ্টির রাতে পৃথিবীর মায়া ছাড়িয়ে দুর্গা পাড়ি জমায় কোনো এক অজানা লোকে। মনে হয়, প্রকৃতিও যেন ছোট্ট মেয়েটির অকাল বিদায়ে চোখের জল ধরে রাখতে পারেনি।
নন্দিত কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের ‘বৃষ্টি বিলাস’, ‘শ্রাবণ মেঘের দিন’সহ অসংখ্য উপন্যাসে বৃষ্টি তার স্বরূপে আবির্ভূত হয়েছে। ‘বৃষ্টি বিলাস’ তাঁর জনপ্রিয় উপন্যাস, যা বৃষ্টি নিয়ে লেখা। এটি মূলত বৃষ্টিভীতি নিয়ে লেখা। ‘বাদল দিনের দ্বিতীয় কদম ফুল’ আরেকটি বিখ্যাত উপন্যাস, যা বৃষ্টির দিনের প্রেক্ষাপটে লেখা। ‘বৃষ্টি ও বসন্তবিলাস’ও তাঁর উপন্যাস, যেখানে বৃষ্টি ও বসন্তের প্রেক্ষাপট এসেছে। এ ছাড়া ‘মেঘ বলেছে যাব যাব’, ‘শঙ্খনীল কারাগার’সহ আরও উপন্যাসে বৃষ্টির প্রসঙ্গ এসেছে।
এর বাইরে ‘মেঘ বৃষ্টি আলো’ সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের উপন্যাস, যেখানে মেঘ, বৃষ্টি এবং আলোকের মাধ্যমে জীবনের বিভিন্ন দিক ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। এ ছাড়া জহির রায়হানের ‘হাজার বছর ধরে’ উপন্যাসেও বৃষ্টি এসেছে প্রাসঙ্গিক কারণেই। গ্রামীণ জীবনমুখী উপন্যাস মানেই তাতে বৃষ্টি উপস্থিত। কেননা সময়কে ধরতে গেলে বৃষ্টিকে উপেক্ষা করার উপায় থাকে না।
মূলত জীবন ও সাহিত্যের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িয়ে আছে বৃষ্টি। বৃষ্টি ছাড়া যেমন জীবন সম্ভব নয়; তেমনই বৃষ্টি ছাড়া বাংলা উপন্যাসও অনেকটা ফিকে।
এসইউ/এমএস