জাতীয়

দুই মামলার অভিযোগপত্রে বাঁশখালীর ‘ড্রোন নির্মাতা’ আশিরের নাম

দুই মামলার অভিযোগপত্রে বাঁশখালীর ‘ড্রোন নির্মাতা’ আশিরের নাম

চট্টগ্রামের বাঁশখালী উপজেলার পুঁইছড়ির বাসিন্দা আশির উদ্দিন। ড্রোন ও বিমানের মডেল তৈরি করে তাক লাগিয়ে দিয়েছেন তিনি। স্থানীয়দের কাছে ‘ক্ষুদে বিজ্ঞানী’ নামে পরিচিত আশিরের সম্প্রতি নাম-ডাক হয়েছে সর্বত্র। তবে এই আশির হত্যাচেষ্টাসহ দুই মামলার অভিযোগপত্রভুক্ত আসামি।

Advertisement

এক বছর আগে আশিরের গুলিতে পেটের নাড়ি ছিঁড়ে যায় প্রতিবেশী আবু হানিফের। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও আন্দরকিল্লা জেনারেল হাসপাতালে দুই দফা অস্ত্রোপচারে জীবন ফিরে পান হানিফ। তবে অস্ত্রোপচারের ধকল পোহাতে হচ্ছে এখনও। বর্তমানে চট্টগ্রাম নগরীর একটি পোশাক কারখানায় অপারেটরের চাকরি করে জীবন অতিবাহিত করছেন আবু হানিফ।

ভুক্তভোগী, পুলিশ, আইনজীবী ও আসামি পক্ষের লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ভুক্তভোগী আবু হানিফের পরিবারের সঙ্গে আশিরের পরিবারের জায়গা-জমি নিয়ে পুরোনো বিরোধ রয়েছে। ২০২২ সালের ৩১ আগস্ট আশির, তার ভাই মোবাশ্বির ও বাবা সাহাব উদ্দিন মিলে আবু হানিফের চাচাতো ভাই আবুল কালামকে দা ও লাঠিসোঁটা দিয়ে মারধর করেন। ওই ঘটনায় আবু হানিফের চাচা আবু ছৈয়দ বাদী হয়ে ১ সেপ্টেম্বর বাঁশখালী থানায় মামলা করেন। ওই মামলায় পুলিশ আদালতে অভিযোগপত্র দেয়। সাহাব উদ্দিন, আশির ও মোবাশ্বির ওই মামলার অভিযোগপত্রভুক্ত আসামি। মামলাটি এখনো আদালতে বিচারাধীন।

ওই মামলার পর থেকে দুই পরিবারের মধ্যে সাপে-নেউলে সম্পর্ক তৈরি হয়। ২০২৪ সালের ২৫ জুলাই আবু হানিফের ছোট আসমা বেগমের বিয়ে ঠিক হয়।

Advertisement

সম্প্রতি নগরীর কালুরঘাট শিল্প এলাকায় ভুক্তভোগী আবু হানিফের সঙ্গে কথা বলে জাগো নিউজ। তিনি বলেন, ‘ছোটবোনের বিয়ে উপলক্ষে কয়েকজন নিকটাত্মীয়ও বাড়িতে এসেছিলেন। ওই সময় আশির আমার ছোট বোনকে উত্ত্যক্ত ও গালাগাল করেন। আমি প্রতিবাদ করায় আশির, তার বাবা, ভাইসহ কয়েকজন মিলে আমাদের এলোপাতাড়ি গুলি করেন। আমার তলপেটে গুলি লেগে জ্ঞান হারিয়ে ফেলি। আমাকে মুমূর্ষু অবস্থায় উদ্ধার করে হাসপাতালে নেওয়া হয়। নাড়ি ছিদ্র হওয়ায় দ্বিতীয় দফা অপারেশন করাতে হয় আমার। ছয় মাস শয্যাশায়ী ছিলাম। তাদের গুলিতে আমার খালু, চাচা, ভাইও গুলিবিদ্ধ হয়। আমার খালুর চোখে ও পিঠে এখনও গুলি রয়ে গেছে। সেগুলো অপারেশন করে বের করা সম্ভব হয়নি।’

‘ঘটনার দিন সন্ধ্যায় পুলিশ আশিরের বাবা সাহাব উদ্দিনকে একটি এক নলা বন্দুকসহ গ্রেফতার করে। আশিরের অস্ত্রটি উদ্ধার করেনি পুলিশ। এখন আমরা ন্যায়বিচার নিয়ে সন্দিহান। শরীরে অপারেশনের কারণে কারখানায় কাজ করতেও কষ্ট হচ্ছে। নানান ধরনের জটিলতায় ভুগছি।’ 

 

আবু হানিফ বলেন, ‘এখন শুনেছি মামলায় অভিযোগপত্র দেওয়া হয়েছে। অথচ আমাদের কাছ থেকে কোনো সাক্ষ্য নেওয়া হয়নি।’

এদিকে, ওই ঘটনার দিন রাতেই আশিরের বাবা সাহাব উদ্দিনের বিরুদ্ধে অস্ত্র আইনে মামলা করেন বাঁশখালী থানার উপপরিদর্শক (এসআই) পেয়ার আহমদ। পরদিন ২৭ জুলাই আবু হানিফের বাবা আবু তৈয়ব বাদী হয়ে আশির, তার বাবা, ভাই, চাচা মিলে ১০ জনের বিরুদ্ধে গুলি করে হত্যাচেষ্টার অভিযোগ এনে বাঁশখালী থানায় আরেকটি মামলা করেন।

Advertisement

অস্ত্র মামলার তদন্ত করেন বাঁশখালী থানার এসআই নজরুল ইসলাম। ওই মামলায় সাহাব উদ্দিনকে আসামি করে ৩১ আগস্ট আদালতে অভিযোগপত্র দেন তিনি। অন্যদিকে, ভুক্তভোগী পরিবারের করা হত্যাচেষ্টা মামলাটি তদন্ত করেন বাঁশখালী থানার পরিদর্শক (তদন্ত) সুধাংশু শেখর হালদার। এ বছরের ২৬ ফেব্রুয়ারি ওই মামলায় তিনি আদালতে অভিযোগপত্র জমা দেন। অভিযোগপত্রে আশির, আশিরের বাবা সাহাব উদ্দিন, ভাই মোবাশ্বিরসহ সাতজনকে আসামি করা হয়। তবে বাদ দেওয়া হয়েছে তিনজনের নাম।

ভুক্তভোগী পরিবারের অভিযোগ, পুলিশ আসামিদের পক্ষ নিয়ে অভিযোগপত্র দিয়েছেন। পরে ওই অভিযোগপত্রের বিরুদ্ধে আদালতে নারাজি আবেদন দেন বাদী আবু তৈয়ব।

পাশাপাশি মামলার এফআইআরে (প্রাথমিক তথ্য বিবরণী) অসঙ্গতি ছিল বলে জানা যায়। ভুক্তভোগী পরিবারের আবু তৈয়ব বাঁশখালী থানায় যে এজাহার দেন, তাতে তার কোনো মোবাইল নম্বর ছিল না। মামলার বিষয়টি পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, থানায় রেকর্ডকৃত এফআইআরে বাদী আবু তৈয়বের নামের সঙ্গে একটি মুঠোফোন নম্বর সংযুক্ত করে দেওয়া হয়। জাগো নিউজের পক্ষ থেকে ওই মুঠোফোন নম্বরে ফোন করা হলে অপরপ্রান্তের ব্যক্তি বলেন, তার নাম বাচ্চু মিয়া। তার অবস্থান চাঁদপুর জেলায়। তিনি এ মামলা সম্পর্কে কিছুই জানেন না।

হত্যাচেষ্টা মামলার বাদী আবু তৈয়ব জাগো নিউজকে বলেন, ‘বাবা-ছেলে মিলে গুলি করেছে। আশির নিজে আমার ছেলেকে (আবু হানিফ) গুলি করেছে। আশির নিজেও অস্ত্র বানায়। পুলিশ টাকা খেয়ে তাদের (আসামি) পক্ষে রিপোর্ট (অভিযোগপত্র) দিয়েছে। অথচ আইও (তদন্ত কর্মকর্তা) আমাদের কারও কাছ থেকে কোনো সাক্ষ্য নেননি। একদিন গিয়ে কয়েকটি সাদা কাগজে সাইন নিয়েছিলেন, আর যাননি। অথচ আইও নিজে মনগড়া সাক্ষ্য লিখে অভিযোগপত্র দিয়েছেন।’

আবু তৈয়ব বলেন, ‘আমি গরিব মানুষ। আমি ন্যায়বিচার চাই। সাহাব উদ্দিনকে অস্ত্রসহ গ্রেফতার করলেও আশিরকে গ্রেফতার করেনি পুলিশ। ঘটনায় ব্যবহৃত তার (আশিরের) অস্ত্রও উদ্ধার করা হয়নি। আমি পুলিশের অভিযোগপত্রের বিরুদ্ধে আদালতে নারাজি দিয়েছি।’

বাদীপক্ষের আইনজীবী অ্যাডভোকেট আবসার উদ্দিন জাগো নিউজকে বলেন, ‘আবু তৈয়বের দায়ের করা মামলায় পুলিশ ঘটনায় জড়িত তিনজনকে বাদ দিয়েছে। তাছাড়া অভিযোগপত্রে পুরো ঘটনাটি উঠে আসেনি। তাই আমরা আদালতে নারাজি পিটিশন দিয়েছি।’

এ বিষয়ে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা বাঁশখালী থানার পরিদর্শক (তদন্ত) সুধাংশ শেখর হালদার জাগো নিউজকে বলেন, ‘যারা ঘটনায় জড়িত ছিলেন তাদের নামে আদালতে অভিযোগপত্র দিয়েছি। কিন্তু যাদের ঘটনাস্থলে থাকার প্রমাণ পাওয়া যায়নি, সেরকম তিনজনকে অব্যাহতির আবেদন করেছি। তাছাড়া আমি তদন্তে যা পেয়েছি, অভিযোগপত্রে তাই উল্লেখ করেছি।’ 

 গত জুনে বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবীর রিজভীসহ দলের নেতারা বাঁশখালীর আশিরের বাড়িতে যান, ছবি: জাগো নিউজ

অভিযোগ অস্বীকার আশিরের

হানিফ ও তার পরিবারের অভিযোগের ব্যাপারে আশির উদ্দিন জাগো নিউজকে বলেন, ‘আবু তৈয়বের পরিবার আমার মা-বাবাকেও মারধর করেছে। তাদের কারণে আমার পড়ালেখা হয়নি। আমার বাবার (সাহাব উদ্দিন) সঙ্গে বিরোধের কারণে শত্রুতা হয়েছে। ড্রোন বানানোর পর যখন সারাদেশে আমার সুনাম ছড়িয়ে পড়ে তখন প্রতিহিংসার কারণে তারা আমার নামে মামলা দিয়েছে।’

আবু হানিফকে গুলি করার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘এতোগুলো অস্ত্র থাকলে তো সবাইকে মেরে ফেলা যাবে। এগুলো সাজানো। আমি ঘটনাস্থলেও ছিলাম না। মূলত আবু হানিফকে আমরা দেখেছি, বড় করেছি। আমার সঙ্গে তার ফেসবুকে অনেক ছবিও আছে। কিন্তু সেই আমার বাবাকে মেরেছে।’

ঘটনার পর তার বাবাকে অস্ত্রসহ গ্রেফতারের বিষয়ে আশির বলেন, ‘হানিফই আমার আব্বুকে (সাহাব উদ্দিন) মারধর করেছে, মাথা ফাটায় দিছে। এগুলোর ভিডিও আছে। আমার আব্বার কাছ থেকে কোনো অস্ত্র পায়নি। একটি ভাঙা অস্ত্র দিয়ে আমার বাবাকে পুলিশ গ্রেফতার করেছিল। ওরা একই ঘটনা নিয়ে দুটো মামলা করেছে।’

এমডিআইএইচ/এসএনআর/এমএমএআর/জিকেএস