দেশজুড়ে

দুই দশকে প্রাণহীন খিরু

দুই দশকে প্রাণহীন খিরু

দখল-দূষণে উত্তাল খিরু নদী এখন মরা খালে পরিণত হয়েছে। একসময় এ নদীকে ঘিরে বহু মানুষের জীবন-জীবিকার চাকা ঘুরতো। নদীতে নানা প্রজাতির মাছের অভয়ারণ্য ছিল। খিরুর পলি মাটিতে নানা ধরনের কৃষিপণ্য আবাদ হতো। দুই দশক ধরে দখল-দূষণে মৃতপ্রায় নদীটি। একই অবস্থা উপজেলার খাল-বিলের।

Advertisement

এ নদীকে কেন্দ্রে করে জেলার ভালুকা উপজেলায় এক এক করে গড়ে উঠেছে চার শতাধিক শিল্প-কারখানা। জমি কেনার সময় মালিকরা টার্গেট করে নদী-খাল। ধীরে ধীরে বিভিন্ন অংশ দখল করে। অনেক সময় প্রশাসনের অভিযানে দখলমুক্তও করা হয়। কিন্তু আবারও দখল হয় ধীরে ধীরে। নদীসহ খাল বিলগুলোও দখল দূষণে অস্তিত্ব সংকটে ভুগছে।

‘শিল্প-কারখানার দূষিত বর্জ্য পানিতে ফেলার কারণে নদীর পানি চরম দূষিত হয়েছে। এছাড়া অনেক অংশ দখলও হয়েছে। আমরা খিরু নদীর খননকাজ অর্ধেক শেষ করার পরও খননের তেমন সুফল পাওয়া যাচ্ছিল। ফলে ঠিকাদারকে খনন অনুযায়ী প্রাপ্ত টাকা বুঝিয়ে দিয়ে কাজ বন্ধ করে দিয়েছি। বর্তমানে খননকাজ পুরপুরি বন্ধ রয়েছে। খননের মাধ্যমে সরকারি টাকা নয়ছয় করা হয়নি।’

প্রভাবশালী ব্যক্তিদের অনেকে নদীসহ খাল-বিলের জমি দখলে নিয়েছে। এরমধ্যে বেশিরভাগ শিল্প কারখানায় বর্জ্য শোধনাগার নেই। যেগুলোতে আছে- সেগুলোও ঠিকমতো ব্যবহার হয় না। দূষিত বর্জ্য ও রাসায়নিক মিশ্রিত পানি বড় বড় ড্রেনের মাধ্যমে নদী-খাল-বিলে ফেলা হয়। শিল্প কারখানার বিষাক্ত বর্জ্য সাদা পানিকে করেছে গিজগিজে কালো। ফসলি জমিতে আর ব্যবহার হয় না এ পানি। গবাদিপশুকেও গোসল করানো হয় না।

Advertisement

এসবের মধ্যে ২০২৩ সালের জানুয়ারিতে শুরু হয় ১৫ কোটি ৫ লাখ টাকা ব্যয়ে ২৪ কিলোমিটার খিরু নদী খনন কাজ। পাঁচ কোটি ৯ লাখ টাকা ব্যয়ে ১৪ কিলোমিটার লাউতি খাল এবং ৮৩ লাখ টাকা ব্যয়ে প্রায় ৫ কিলোমিটার বিলাইজুরি খাল খনন কাজ। গত বছরের জানুয়ারিতে খনন কাজ শেষ করার কথা থাকলেও গত বছরের জুলাই পর্যন্ত ৫০ ভাগ কাজও শেষ করা যায়নি। এরপর কাজ বন্ধ করে দেয় পানি উন্নয়ন বোর্ড। খননের মাটি ফেলা হয়েছিল নদী-খালের পাড়সহ কৃষকদের জমিতে। এসব মাটি নদীতে পড়ে ভরাট হতে থাকে। ফলে খনন কোনো কাজেই আসেনি।

‘এ নদীকে কেন্দ্রে করে জেলার ভালুকা উপজেলায় এক এক করে গড়ে উঠেছে চার শতাধিক শিল্প-কারখানা। জমি কেনার সময় মালিকরা টার্গেট করে নদী-খাল। ধীরে ধীরে বিভিন্ন অংশ দখল করে। অনেক সময় প্রশাসনের অভিযানে দখলমুক্তও করা হয়। কিন্তু আবারও দখল হয় ধীরে ধীরে। নদীসহ খাল বিলগুলোও দখল দূষণে অস্তিত্ব সংকটে ভুগছে।’

স্থানীয় সূত্র জানায়, ধোপাজান খাল বিরুনিয়া ইউনিয়ন দিয়ে খিরু নদীতে মিশেছে। এছাড়া লাউতি খাল হবিরবাড়ি ইউনিয়ন দিয়ে, গজারিয়া খাল ভালুকা ইউনিয়ন দিয়ে, আডাইয়ের খাল হবিরবাড়ি ইউনিয়ন দিয়ে ও বিলাইঝুড়ি খাল হবিরবাড়ি ইউনিয়ন দিয়ে খিরু নদীতে মিশেছে। নদী, খাল-বিল কিছুই রক্ষা পাচ্ছে না। যে যেভাবে পারছে দখল করছে। ধোপাজান খালের বিভিন্ন অংশ প্রভাবশালীরা মাটি ভরাট করে সীমানা প্রাচীর দিয়ে দখল করেছেন। একই অবস্থা বেইত্যাগুনি খালের। লাউতি খালের পাশাপাশি গজারিয়া খালের অনেক অংশ দখল হয়ে গেছে। এগুলো ছাড়াও আডাইয়ের খাল, বিলাইঝুড়ি খালের অনেক অংশ দখলের পাশাপাশি দূষণে পানি বিষাক্ত হয়ে গেছে। এতে মারাত্মক প্রভাব পড়েছে কৃষি ও জীববৈচিত্র্যে।

এরমধ্যে পানি উন্নয়ন বোর্ড খননকাজ শুরু করে আশার আলো দেখায়। কিন্তু খনন কাজ শেষ না করেই খনন বন্ধ করে দেওয়া হয়। যতটুকু খনন হয়েছে, এর ফলে কেউ সুফল না পেলেও লাভবান হয়েছে শিল্প কারখানার মালিকরা। খননের আগে কারখানার বর্জ্য নদী, খালের বিভিন্ন অংশে আটকে থাকলেও এখন পানির সঙ্গে দূরে চলে যাচ্ছে। খননের পরও পানি কুচকুচে কালো হওয়ায় কৃষকরা ফসলি জমিতে এই পানি ব্যবহার করতে পারছে না। নদীর পাড়ে রাখা মাটি ধীরে ধীরে নদীতেই পড়তে থাকায় নদীটি আগের অবস্থায় ফিরে আসছে। এতে খরচ হওয়া সরকারের বিপুল অঙ্কের টাকা কোনো কাজে আসেনি।

Advertisement

‘দূষণের পাশাপাশি নদী-খাল-বিলের বিভিন্ন অংশ দখল করা হয়েছে। এতে প্রভাবশালীরা জড়িত থাকায় উদ্ধার করা হচ্ছে না। স্থানীয়রা কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি। খননের নামে সরকারি টাকা হরিলুট করা হয়েছে।’

পৌর এলাকার বাসিন্দা মাসুদুর রহমান নামের একজন জাগো নিউজকে বলেন, ‘এক সময় খিরু নদীতে মানুষ গোসল করতেন, গৃহিণীরা গৃহস্থালির কাজে এ পানি ব্যবহার করতেন। এখন এ পানি স্পর্শ করলেই মানুষ চর্মরোগে আক্রান্ত হচ্ছেন।’

হবিরবাড়ি ইউনিয়নের বাসিন্দা কৃষক আব্দুল জলিল বলেন, ‘খিরু নদীর পাশে আমার ধানের জমি রয়েছে। একাধিকবার খরচ বাচাতে নদীর পানি ফসলি জমিতে ব্যবহার করে ফলন কম হয়েছে। তাই এখন নদীর পানি ব্যবহার করি না। সম্প্রতি খেতে কাজ শেষে অনিচ্ছা থাকা সত্ত্বেও নদীর কিনারায় পানিতে হাত ধুয়েছিলাম। কিছুদিন পরই হাতের ওপরের অংশে ঘা হওয়া শুরু করে। পরে ওষুধ খেয়ে সুস্থ হয়েছি।’

আরও পড়ুনপ্রাণ ফিরেছে মরা খালে পোনা নদী এখন মরা খাল উত্তাল পদ্মা এখন মরা খাল

ক্ষোভ প্রকাশ করে মধ্যবয়সী ফজলুল হক নামের আরেকজন কৃষক বলেন, ‘নদীর পাশে আমার ধানক্ষেত আছে। একসময় নিয়মিত এ পানি খেতে ব্যবহার করা হতো। বর্তমানে এ পানি ব্যবহার করলে ফলন অর্ধেক কমে যায়। কখনো কখনো গাছ মরে যায়। এজন্য আমার মতো কোনো কৃষক ফসলি জমিতে এ পানি ব্যবহার করে না।’

‘খননের পরও পানি কুচকুচে কালো হওয়ায় কৃষকরা ফসলি জমিতে এই পানি ব্যবহার করতে পারছে না। নদীর পাড়ে রাখা মাটি ধীরে ধীরে নদীতেই পড়তে থাকায় নদীটি আগের অবস্থায় ফিরে আসছে। এতে খরচ হওয়া সরকারের বিপুল অঙ্কের টাকা কোনো কাজে আসেনি।’

স্থানীয় লাউতির খালের পাশে টাইলস ও সিরামিক উৎপাদন করছে এক্সিলেন্স ইন্ডাস্ট্রিজ নামে একটি শিল্প-কারখানা। ওই কারখানার তরল বর্জ্য বেশ কয়েকটি ড্রেনের মাধ্যমে খালে ফেলা হচ্ছে। অল্প সময়ের মধ্যে এসব বর্জ্য খিরু নদীতে পড়ে। কারখানাটির মানবসম্পদ বিভাগের ব্যবস্থাপক হাসিবুল ইসলাম বলেন, ‘আমাদের ইফ্লুয়েন্ট ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্টের (ইটিপি) শিগগিরই চালু করা হবে। আনুষঙ্গিক সব কাজ শেষ করা হয়েছে।’

একই খালের পাশে গড়ে ওঠা আর্টি কম্পোজিট ডায়িং লিমিটেডের মানবসম্পদ বিভাগের ব্যবস্থাপক আল আমীন বলেন, ‘খালের নিচে কালভার্ট বানিয়ে মাটি দিয়ে ভরাট করা হয়েছে। এ জায়গা দিয়ে বর্জ্য পানিতে যাচ্ছে।’

বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) ভালুকা উপজেলার আহ্বায়ক শাহ মোহাম্মদ আশরাফুল হক জর্জ বলেন, ‘একসময় খিরু নদীর পানি ফসলের খেতে ব্যবহার করা হতো। গৃহিণীরা রান্নার কাজেও নদীর পানি ব্যবহার করতেন। ধীরে ধীরে শিল্প কারখানার বিষাক্ত বর্জ্যে পানির রং হয়েছে গিজগিজে কালো, সঙ্গে ব্যাপক দুর্গন্ধে নদীর পাশ দিয়ে চলাচল করা কঠিন হয়ে পড়েছে।’

তিনি বলেন, ‘দূষণের পাশাপাশি নদী-খাল-বিলের বিভিন্ন অংশ দখল করা হয়েছে। এতে প্রভাবশালীরা জড়িত থাকায় উদ্ধার করা হচ্ছে না। স্থানীয়রা কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি। খননের নামে সরকারি টাকা হরিলুট করা হয়েছে।’

পরিবেশ রক্ষা ও উন্নয়ন আন্দোলন ময়মনসিংহের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট শিব্বির আহমেদ লিটন বলেন, ‘দীর্ঘ বছর ধরে প্রশাসনের নাকের ডগায় নদী, খাল-বিল দখল দূষণ করা হচ্ছে। অথচ জোরালো কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করা হচ্ছে না। দখল দূষণ থেকে নদী, খালবিল রক্ষা করতে লাগাতার জোরালো আন্দোলনের ডাক দেওয়া হবে।’

এ বিষয়ে উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) মো. ইকবাল হোসাইন জাগো নিউজকে বলেন, ‘নদী ও খাল-বিলের অনেক জায়গা দখল হয়েছে। বিষয়টি আমি ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নজরে আনব। এরপর অনুমতি মিললে অভিযান চালানো হবে। কারণ আমরাও চাই, দখল-দূষণ থেকে রক্ষা পাক নদীসহ খাল-বিলগুলো।’

পানি উন্নয়ন বোর্ড ময়মনসিংহের নির্বাহী প্রকৌশলী মোহাম্মদ আখলাক উল জামিল বলেন, ‘শিল্প-কারখানার দূষিত বর্জ্য পানিতে ফেলার কারণে নদীর পানি চরম দূষিত হয়েছে। এছাড়া অনেক অংশ দখলও হয়েছে। আমরা খিরু নদীর খননকাজ অর্ধেক শেষ করার পরও খননের তেমন সুফল পাওয়া যাচ্ছিল। ফলে ঠিকাদারকে খনন অনুযায়ী প্রাপ্ত টাকা বুঝিয়ে দিয়ে কাজ বন্ধ করে দিয়েছি। বর্তমানে খননকাজ পুরপুরি বন্ধ রয়েছে। খননের মাধ্যমে সরকারি টাকা নয়ছয় করা হয়নি।’

এ বিষয়ে পরিবেশ অধিদপ্তর ময়মনসিংহের পরিচালক শেখ মো. নাজমুল হুদা বলেন, ‘অনেক শিল্প কারখানা তাদের খরচ কমানোর জন্য ইটিপি বন্ধ রাখে। যদি ইটিপি চালু থাকত তাহলে পানির রং এতটা কালো হতো না। এমন দুর্গন্ধও থাকত না। সব কারখানায় ইটিপি চালু রাখা নিশ্চিত করতে অভিযান চালানো হবে। যেসব কারখানায় ইটিপি থাকলেও ব্যবহার হচ্ছে না, কিংবা ইটিপি নেই, সেগুলোর বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

এমডিকেএম/আরএইচ/জিকেএস