জাতীয়

পরিবেশ রক্ষার দায়িত্ব নাগরিকদেরও, এটা অনুধাবন জরুরি

পরিবেশ রক্ষার দায়িত্ব নাগরিকদেরও, এটা অনুধাবন জরুরি

পরিবেশ পদক-২০২৪ পেয়েছে ‘ওয়ার্ক ফর এ বেটার বাংলাদেশ (ডব্লিউবিবি) ট্রাস্ট’। পরিবেশবিষয়ক শিক্ষা ও সচেতনতা ছড়িয়ে দিতে প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে অনন্য অবদান রাখার স্বীকৃতি এটি। সংস্থাটির পরিচালক হিসেবে পরিবেশ পদক গ্রহণ করেন গাউস পিয়ারী।

Advertisement

পরিবেশবিষয়ক শিক্ষার প্রচার, তামাক নিয়ন্ত্রণ, শব্দ ও প্লাস্টিক দূষণ, নিরাপদ খাদ্যসহ নানান বিষয়ে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছে সংস্থাটি। পাশাপাশি শিশু-কিশোরদের সচেতন করছে। সংগঠনের কার্যক্রম, ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা প্রভৃতি নিয়ে জাগো নিউজের সঙ্গে কথা বলেন গাউস পিয়ারী। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন নিজস্ব প্রতিবেদক রায়হান আহমেদ।

জাগো নিউজ: ওয়ার্ক ফর এ বেটার বাংলাদেশের পরিবেশ নিয়ে কাজের শুরুটা কীভাবে হলো?

গাউস পিয়ারী: ১৯৯৮ সালে আমাদের যাত্রা শুরু। ‘ওয়ার্ক ফর এ বেটার বাংলাদেশ’ তখন কেবল একটি স্লোগান ছিল। পরে সেই স্লোগান দিয়েই সংগঠনের জন্ম হয়। মাথায় ছিল—বাংলাদেশটা আমাদের সবার। মানুষের মানোন্নয়নে কাজ করাই ছিল লক্ষ্য। প্রথম দিকে আমরা তামাক নিয়ে কাজ শুরু করি, কারণ তামাকজনিত রোগের ভয়াবহতা ছিল তখনও অবহেলিত। কর বৃদ্ধি, জনসম্মুখে তামাক ব্যবহার বন্ধে সচেতনতা—এসব নিয়ে কাজ করি। এরপর নিরাপদ খাদ্য, প্লাস্টিক দূষণ, শব্দদূষণের বিরুদ্ধেও কাজ শুরু করি। পাশাপাশি সাইক্লিং সংস্কৃতি গড়তে কাজ করছি।

Advertisement

জাগো নিউজ: পরিবেশবিষয়ক শিক্ষা ও প্রচারে ডাব্লিউবিবি কীভাবে কাজ করে?

গাউস পিয়ারী: আমরা মূলত স্কুলভিত্তিক ও কমিউনিটি বেজড কাজ করি। ২০১৩ সাল থেকে রায়েরবাগ এলাকায় ১০টি স্কুলের সঙ্গে কাজ করছি। শিক্ষার্থীদের পরিবেশ সচেতন করতে নানান কর্মসূচি পরিচালনা করি। যেমন—বায়ু, শব্দ ও প্লাস্টিক দূষণ, স্বাস্থ্যবিষয়ক সচেতনতা। আমাদের লক্ষ্য, শিশুরা ছোট থেকেই সচেতন হোক এবং ভবিষ্যতে বাস্তব জীবনে পরিবেশবান্ধব সিদ্ধান্ত নিতে পারুক।

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো থেকে আমরা ভালো সাপোর্ট পাই, তবে চ্যালেঞ্জ হলো কমিউনিটিকে যুক্ত করা। পরিবেশ রক্ষা ও সংরক্ষণ নিয়ে বিভিন্ন কমিউনিটিকে আমরা ফিল করাতে পারছি না, তাদের সচেতন করাতে পারছি না। পরিবেশের গুরুত্ব তাদের ফিল করানোটা চ্যালেঞ্জ

শুধু স্কুল নয়, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদেরও যুক্ত করি। যেমন—কোমলপানীয়ের স্বাস্থ্যঝুঁকি ও সেই বোতলের প্লাস্টিক দূষণ—এই দুদিক একসঙ্গে বোঝানোর চেষ্টা করি। এছাড়া, মানসিক স্বাস্থ্য, ছাদবাগান, নিরাপদ খাদ্য নিয়েও কাজ করি। মোটা দাগে পরিবেশ, স্বাস্থ্য, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব- সব নিয়েই আমাদের কাজ।

Advertisement

জাগো নিউজ: পরিবেশ শিক্ষা ছড়িয়ে দিতে গিয়ে কী ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হন?

গাউস পিয়ারী: শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো থেকে আমরা ভালো সাপোর্ট পাই, তবে চ্যালেঞ্জ হলো কমিউনিটিকে যুক্ত করা। পরিবেশ রক্ষা ও সংরক্ষণ নিয়ে বিভিন্ন কমিউনিটিকে আমরা ফিল করাতে পারছি না, তাদের সচেতন করাতে পারছি না। পরিবেশের গুরুত্ব তাদের ফিল করানোটা চ্যালেঞ্জ।

আরও পড়ুন

জাতীয় পরিবেশ পদকসহ বিভিন্ন পদক পেলেন যারা পরিবেশ দূষণে বাংলাদেশে বছরে ২ লাখ ৭২ হাজার মানুষের অকালমৃত্যু বাড়ছে পরিবেশ দূষণ কমছে সচেতনতা এভাবে পরিবেশ দূষণ হলে আমরা কেউ বাঁচবো না

মানুষ অনেক সময় ভাবে, পরিবেশ রক্ষা সরকারের একার কাজ। নাগরিক দায়িত্বটা তাদের বোঝানো কঠিন। যেমন—আমার সন্তান যাতে দূষণমুক্ত পরিবেশে স্কুলে যেতে পারে, সেটা তো আমাদের সবার দায়িত্ব। এছাড়া সরকারি পর্যায়ে আমরা অনেক কর্মকর্তার সঙ্গে কাজ করি। কিন্তু তারা বদলি হয়ে গেলে নতুনদের আবার সব কিছু বোঝাতে হয়, এতে আমাদের কার্যক্রম ধীরগতিতে এগোয়।

জাগো নিউজ: পরিবেশ পদক পেয়েছে আপনাদের প্রতিষ্ঠান। কেমন অনুভব করছেন? প্রাপ্তি কতটুকু?

গাউস পিয়ারী: এটা আসলে বলে বোঝানো যাবে না। এবার আমরা পরিবেশ পদক পেয়েছি—এটি গর্বের, তবে দায়িত্বও অনেক বেড়ে গেছে। আমাদের ওপর প্রত্যাশাও বেড়ে গেছে। পুরস্কার গ্রহণের দিন বলেছিলাম, পুরস্কার গ্রহণ মানে দায়িত্ব আরও বাড়লো। এখন সমাজ, রাষ্ট্র ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের স্বার্থে আরও গভীরভাবে কাজ করতে হবে। বিশেষ করে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব নিয়ন্ত্রণ নিয়ে কাজ করবো। আর এ কাজে তরুণদের সম্পৃক্ত করবো।

ছোট ছোট অভ্যাসই ভবিষ্যতের বড় পরিবর্তন এনে দিতে পারে। শিক্ষার্থী যখন বুঝবে একটি প্লাস্টিক বোতল তার শরীরের জন্য যেমন ক্ষতিকর, তেমনি পরিবেশের জন্যও হুমকি—তখন তারা সচেতন হবে

এই স্বীকৃতি নতুন উদ্যোগে গতি আনবে এবং নীতিনির্ধারক ও বিভিন্ন মহলের সঙ্গে সহযোগিতায় নতুন দরজা খুলবে বলেও তিনি আশা করেন।

জাগো নিউজ: যেহেতু পরিবেশগত শিক্ষা প্রচারের অবদানে পদক পেয়েছেন, পরিবেশবিষয়ক সচেতনতা গড়ে তুলতে শিক্ষাব্যবস্থায় কী কী পরিবর্তন দরকার বলে মনে করেন?

গাউস পিয়ারী: পরিবেশগত সচেতনতা গড়ে তুলতে শিক্ষাব্যবস্থায় কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন আনা দরকার। পাঠ্যবইয়ে বাস্তবমুখী পরিবেশ শিক্ষার উপাদান থাকতে হবে, যা শুধু তথ্য নয় বরং অভিজ্ঞতা ও চর্চাভিত্তিক হবে। স্কুলের বাইরে হাতে-কলমে শেখার সুযোগ—যেমন বাগান করা, পুনর্ব্যবহারযোগ্য উপকরণ ব্যবহার, বর্জ্য ব্যবস্থাপনার সঙ্গে শিক্ষার্থীদের সম্পৃক্ত করতে হবে। এছাড়া শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পরিবেশবান্ধব আচরণ যেমন প্লাস্টিক বর্জন, শব্দদূষণবিরোধী কার্যক্রম চালু রাখা দরকার। শিক্ষার্থীদের যেন ছোটবেলা থেকেই পরিবেশ নিয়ে সচেতন করে তোলা যায়, এ লক্ষ্যেই শিক্ষাব্যবস্থা সাজানো জরুরি।

জাগো নিউজ: নতুন প্রজন্মকে পরিবেশ রক্ষায় যুক্ত করতে আপনি কী পরামর্শ দেবেন?

গাউস পিয়ারী: নতুন প্রজন্মকে যুক্ত করতে হলে তাদের ছোটবেলা থেকেই পরিবেশবান্ধব অভ্যাসে উৎসাহিত করতে হবে। যেমন—বিষমুক্ত খাবার খাওয়া, কোমলপানীয় থেকে দূরে থাকা, প্লাস্টিকের ব্যবহার কমানো, ছাদে বা বাসায় বাগান করা ইত্যাদি। তাদের বোঝাতে হবে, এই ছোট ছোট অভ্যাসই ভবিষ্যতের বড় পরিবর্তন এনে দিতে পারে। শিক্ষার্থী যখন বুঝবে একটি প্লাস্টিক বোতল তার শরীরের জন্য যেমন ক্ষতিকর, তেমনি পরিবেশের জন্যও হুমকি—তখন তারা সচেতন হবে।

জাগো নিউজ: ভবিষ্যতে আপনাদের পরিবেশ সংরক্ষণ বা শিক্ষাবিষয়ক নতুন কোনো প্রকল্প আছে কি?

গাউস পিয়ারী: পরিবেশের সমস্যা একদিনের নয়। ১০ বছর আগে যে সমস্যা ছিল, এখনো তা আছে—বরং বেড়েছে। শব্দদূষণ, বায়ুদূষণ, প্লাস্টিক, স্বাস্থ্য ও খাদ্যনিরাপত্তা—এসব নিয়েই আমরা কাজ করে যাচ্ছি। তবে এখন জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে অনেক বিষয় আরও মারাত্মক হয়ে উঠছে। সেই ঝুঁকি মোকাবিলায় কাজ জোরদার করবো।

অনেকে ব্যক্তিগত গাড়ির পেছনের সিটে বসে থাকেন অথচ চালক অযথা হর্ন বাজাচ্ছেন—তারা কিছু বলেন না। মানুষ চাইলে নিজে থেকেই হর্ন বাজানো থেকে বিরত থাকতে পারে। বিআরটিএ যেন চালকদের লাইসেন্স দেওয়ার সময় শব্দদূষণ নিয়ে নিয়ম-কানুন শেখায়—এ বিষয়েও আমরা কাজ করতে চাই

শব্দদূষণ নিয়ে আমাদের একাধিক গবেষণা রয়েছে। এখন আমরা লোকাল বাসচালকদের নিয়ে কাজ করতে চাই, কারণ এরা অনেক সময় অহেতুক হর্ন বাজিয়ে শহরবাসীকে কষ্ট দেন। এই চালকদের নিয়ে সচেতনতামূলক কর্মসূচির পরিকল্পনা করছি।

জাগো নিউজ: শব্দদূষণ নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছেন—কোনো পরিবর্তন দেখতে পেয়েছেন?

গাউস পিয়ারী: খুব বড় পরিবর্তন এখনো আসেনি। কারণ মানুষ নিজে থেকে সচেতন না হলে এ সমস্যার সমাধান হবে না। রাষ্ট্র বা পরিবেশ অধিদপ্তর একা কিছু করতে পারবে না। অনেকে ব্যক্তিগত গাড়ির পেছনের সিটে বসে থাকেন, অথচ চালক অযথা হর্ন বাজাচ্ছেন—তারা কিছু বলেন না। মানুষ চাইলে নিজে থেকেই হর্ন বাজানো থেকে বিরত থাকতে পারে। বিআরটিএ যেন চালকদের লাইসেন্স দেওয়ার সময় শব্দদূষণ নিয়ে নিয়ম-কানুন শেখায়—এ বিষয়েও আমরা কাজ করতে চাই।

আরএএস/এএসএ/এমএফএ/এমএস