ছাব্বিশ বছরের তরুণ মোহাম্মদ আফরিজি বিন আপন। জাপানে গিয়েছিলেন অটোমোবাইল ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে। জাপানের মতো উন্নত প্রযুক্তির দেশে বাংলাদেশি এই তরুণের দিনের পর কেটেছে না খেয়ে! এমনকি পানির অভাবেও ভুগেছেন তিনি। নিঃসঙ্গতার কারণে হতাশা ও বিষণ্ন তায় ডুবে যাওয়া এই তরুণের মানসিক অবস্থা হয়ে পড়েছিল শোচনীয়। পরিস্থিতি এতটাই ভয়াবহ ছিল যে, মৃত্যুকেই তিনি ভেবেছিলেন বেঁচে থাকার চেয়ে সহজ উপায়। তাকে বাংলাদেশে ফিরতে হলো কফিনবন্দি হয়ে। জাপানের মতো এমন উন্নত দেশে আপনের এমন করুণ পরিণতি অনেকে মেনে নিতে পারেননি।
Advertisement
দেশের বাইরে পড়তে যাওয়া আমাদের দেশের অধিকাংশ ছেলে-মেয়ের স্বপ্ন। উন্নত ক্যারিয়ার গঠনের এই স্বপ্ন পূরণ করতে প্রতি বছর হাজার হাজার ছেলে-মেয়ে বিদেশে পড়তে যাচ্ছেন। সবার জন্য এই স্বপ্ন পূরণের পথ সহজও নয়। না বুঝে অনেকেই নিজেকে ঠেলে দেন ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে। কেননা সব ধরনের প্রস্তুতি নিলেও মানসিক প্রস্তুতিটুকু নেওয়া হয় না অনেকের। তাই দেশের বাইরে পড়তে যাওয়ার আগে কিছু জরুরি মানসিক প্রস্তুতি নিতেই হবে। বিশেষ করে এই ৭ বিষয়ে।
অর্থনৈতিক চাপ সামলানোর প্রস্তুতিবিদেশে পড়াশোনার খরচ গুরুত্বপূর্ণ বিষয় যা থেকে অর্থনৈতিক চাপ সৃষ্টি হতে পারে। মূলত বিদেশে পড়াশোনার খরচ নির্ভর করে বিশ্ববিদ্যালয় এবং বিষয়ের ওপর। টিউশন ফি, জীবনযাত্রার খরচ, আবাসন, খাবার, যাতায়াত এবং আনুষঙ্গিক অন্যান্য খরচ তো থাকেই। তাই কোন দেশে যাচ্ছেন, সেই দেশের টিউশন ফি ও জীবনযাত্রার খরচ বিস্তারিত জেনে বাজেট তৈরি করে তারপর সেখানে যাওয়া উচিত। এই প্রস্তুতির পরও যদি আর্থিক টানাপোড়েনে পড়তে হয়, সেই চাপ সামাল দেওয়ার মতো মানসিক প্রস্তুতি থাকতে হবে। আর্থিক চাপ মোকাবেলা করার জন্য আগে থেকেই একটি বাজেট তৈরি করে রাখুন। সেই অনুযায়ী খরচ করার পরিকল্পনা থাকলে অর্থনৈতিক চাপ অনেক অংশে কমে যাবে।
একাকিত্ব দূর করবেন কীভাবেবিদেশে পড়তে যাওয়ার পর সবচেয়ে বড় যে সমস্যার সম্মুখীন হবেন তা হলো একাকিত্ব। বিদেশিদের ব্যক্তিকেন্দ্রিক জীবনে একা লাগতে পারে। আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে বেশ কিছু গবেষণায় দেখা গেছে, প্রায় ৮০ ভাগেরও বেশি আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থী একাকিত্বতায় ভোগেন। চেনা-পরিচিত মানুষ ছাড়া, পরিবার ছাড়া, বৈরী আবহাওয়া, সারাদিনের ব্যস্ততার কারণে একাকিত্ব অনুভূত হওয়াটাই স্বাভাবিক। এ জন্য মানসিক প্রস্তুতি রাখতে হবে। নিজের শখের কাজ করে, পরিবার বা বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখার মাধ্যমে একাকিত্ব দূর করা যেতে পারে।
Advertisement
নতুন দেশে গিয়ে নিজের প্রতি যত্নশীল হতে হবে। নিজের ওপর অতিরিক্ত প্রত্যাশা রাখবেন না এবং নিজের ওপর খুব বেশি কঠোরও হবেন না। মনে রাখবেন, সবকিছু না জানা দোষের নয়। সকল বাধার ভয় দূর করে অজানাকে মেনে নিন। নিজেকে বিশ্বাস করান যে, এটি জীবনের অ্যাডভেঞ্চারের অংশ। বিভিন্ন অভিজ্ঞতা নতুন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হওয়া এবং সমাধান খুঁজে বের করতে সাহায্য করবে। এ ছাড়া জীবনের মুখোমুখি হওয়া প্রতিটি চ্যালেঞ্জ আপনাকে আরও শক্তিশালী, আরও আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠতে সাহায্য করবে।
ভোগাবে ভিন্ন সংস্কৃতিসংস্কৃতির ভিন্নতা আপনাকে বেশ ভোগাবে। ভাষার পার্থক্য, বিভিন্ন উচ্চারণের কারণে সবার সঙ্গে স্বাভাবিকভাবে যোগাযোগ করা যায় না। তাই সেখানে বন্ধু তৈরি করতে সমস্যা হতে পারে। এ কারণে বিভিন্ন দেশের নানান সংস্কৃতির মানুষের মাঝে নিজেকে একা মনে হবে। এ জন্য সাংস্কৃতিক পার্থক্যগুলোকে মেনে নিতে হবে। বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করতে হবে। এ ছাড়া মনে রাখতে হবে, প্রতিটি শহর ও দেশের আলাদা স্থানীয় ঐতিহ্য আছে, সেগুলো সম্পর্কে জানুন। তাদের নিজস্ব সংস্কৃতি আবিষ্কার করুন। নতুন খাবার খাওয়ার চেষ্টা করুন। এই মনোভাবই নতুন পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে সাহায্য করবে।
যোগাযোগ বাড়ানোবিদেশে পড়াশোনা সম্পূর্ণ নতুন পৃথিবীর দরজা খুলে দেয়। মানসিকতা রাখতে হবে দেশের মতো অনেক কিছুই ভিনদেশে পাওয়া যাবে না। নানান অনিশ্চয়তা তাই দূরে ঠেলে রাখতে হবে। ভিনদেশে নিজের দেশের বিভিন্ন সোসাইটি রয়েছে, সেখানে পরিচিত হন, যোগাযোগ করুন। চেষ্টা করুন সবার সঙ্গে মিশতে এবং যতটা সম্ভব মুক্তমনা থাকতে। এভাবে যোগাযোগ বাড়ালে আপনি কিছুটা ভালো থাকবেন।
পড়াশোনার চাপ না নেওয়াশিক্ষাগত বিষয়ের মতোই শ্রেণিকক্ষের বাইরেও শেখার মতো অনেক কিছু থাকে। বিশ্ববিদ্যালয় টিউটরিং পরিষেবা এবং স্টাডি গ্রুপের মতো সহায়তা ব্যবস্থাও প্রদান করবে। কোনো সমস্যা হলে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করুন এবং প্রয়োজনের কথা খুলে বলুন। কোনভাবে চাপ সৃষ্টি হলে সেটাকে চাপ হিসেবে নেবেন না।
Advertisement
অ্যাপার্টমেন্ট বা বাসা, যেটাই ঠিক করা হোক না কেন, লিজ বিষয়টা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কোনো কারণে বাসায় কোনো ঝামেলা হলে এই লিজ চুক্তি এক বছর কিংবা ছয় মাসের আগে শেষ করা যায় না। অর্থাৎ, এই পুরোটা সময় আপনাকে সেখানেই থাকতে হবে কিংবা না থাকলেও এর ভাড়াটা ঠিকই পরিশোধ করতে হবে। তাই এ বিষয়গুলো খুব ভালো করে জেনে বুঝে তারপর যাবেন। বাসস্থানের পাশাপাশি সেখানে আপনার সঙ্গী কে হচ্ছেন সেটাও একই রকম গুরুত্বপূর্ণ। বাসস্থানের সঙ্গী ভিন্ন মানসিকতার কিংবা ভিন্ন দেশের হলে অনেক সময় এ নিয়েও কিছুটা ঝামেলা পোহাতে হতে পারে। তাই দুজন একই সংস্কৃতির হলে অনেক ঝামেলা এড়িয়ে যাওয়া যায়। এ ছাড়া ভিন্ন সংস্কৃতির মানুষের সঙ্গে বসবাস করলে, একে অপরের সংস্কৃতি ও ভাষা সম্পর্কে জানার আগ্রহ থাকলে সমস্যা কম হবে। এতে করে একে অপরের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ বাড়বে।
/এমএস