মতামত

বাংলাদেশের বর্তমান প্রেক্ষিতে ‘তিন শূন্য’ তত্ত্ব

বাংলাদেশের বর্তমান প্রেক্ষিতে ‘তিন শূন্য’ তত্ত্ব

বলা বাহুল্য যে, জুলাই- আগস্ট গণ অভ্যুত্থানের আগে-পরে ঘটনাবলী বাংলাদেশের অর্থনীতির উপর বিরাট চাপ সৃষ্টি করে। এক অর্থে মানবজীবন, সম্পদ ধ্বংস এবং অস্থিরতায় ব্যাপক রক্তক্ষরণ ঘটেছে অর্থনীতিতে। এমনিতেই করোনা থেকে শুরু করে রাশিয়া -ইউক্রেন যুদ্ধে নাকাল ছিল বাংলাদেশের অর্থনীতি তবে অর্থনীতি, ভালোভাবে সামালও দিয়েছিল কিন্তু ওই যে কথায় বলে, অভাগা যেদিকে চায় সাগর শুকিয়ে যায় অবস্থা ওইরকম । তবে সার্বিক নাজুক অবস্থার জন্য মূলত দায়ী করা হতো, আন্তর্জাতিক বৈরী পরিস্থিতিকে নয় বরং বিগত সরকারের আমলের ব্যাপক দুর্নীতি, লুটপাট এবং অপশাসনকে। বস্তুত অতীতের যেকোনো অভ্যুত্থানেই অর্থনীতির উপর মারাত্মক আঘাত এসেছে যেমন হরতাল, অবরোধ, ইত্যাদির কারণে ব্যবসাবাণিজ্য বিশেষত শিল্পকারখানার উৎপাদন হ্রাস এবং সার্বিক অভিগমন ও নির্গমনে বিঘ্নতা সৃষ্টি। তবে এসব কর্মকাণ্ডে যারা নিয়োজিত থাকতেন তারা যেভাবেই হোক লোকসান পুষিয়ে নেবার ব্যবস্থা নিতে পারতেন। কিন্তু এবার যেন একটু অন্যরকম।

Advertisement

দুই.২০২৪ সালের অভ্যুত্থানের পর স্বভাবতই আশা ছিল নতুন সরকার ক্ষমতায় বসা মাত্রই অর্থনীতির চাকা সচল হবে এবং ‘আবার জমবে মেলা বটতলা হাটখোলা/ অঘ্রাণে নবান্নের উৎসবে ...।’ কিন্তু ইদানীং বিভিন্ন উৎস থেকে পাওয়া তথ্য -উপাত্ত বলছে উল্টো কথা– দু একটা ব্যতিক্রম ছাড়া সার্বিক অর্থনীতির অবস্থা খুবই নাজুক; মেলা বসেনি তবে চলছে মাজার এবং মেলা ভাঙার মহোৎসব। এমনকি শ্বেতপত্র প্রকাশনা পরিষদের কর্ণধারও বলে বেরাচ্ছেন যে, বাংলাদেশের অর্থনীতি বর্তমান সময়ে সঠিক রাস্তায় হাঁটছে না, নতুন বন্দোবস্তে তো নয়ই পুরদমে পুরনো বন্দোবস্তে। চলছে নাকি বিগত আমলের নীতিমালা, বরাদ্ধ এবং অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে প্রকল্প গ্রহণ।

যাই হোক, যে তিনটি গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় সরকার সফলতার পরিচয় দিয়েছেন সেগুলো হল (ক) অত্যন্ত সংকোচনমূলক মুদ্রানীতির পিঠে চড়ে মূল্যস্ফীতির রাশ কিছুটা টেনে ধরা; (খ) সুবিবেচক নীতিমালা সাপেক্ষে বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভ সন্তোষজনক পর্যায়ে রাখা এবং (গ) বেশ কঠোর হস্তে ব্যাংকিং খাতকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্ত থেকে ফিরিয়ে আনার প্রাণান্ত প্রচেষ্টা। সত্যি কথা বলতে কি, এক অর্থে এই কৃতিত্ব উল্লেখ করার মতো ।

তবে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ বিরুপাক্ষ পাল মনে করেন, “ মূল্যস্ফীতির অনমনীয়তা ও বেকারত্বের মতো বিষয়ের কোনো কৌশলগত সমাধানে সরকার তৎপর নয়। সরকার নিজেই তার প্রাথমিক প্রতীজ্ঞা থেকে সরে এসেছে। কথা ছিল অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ গড়া হবে। আওয়ামী লীগ বিরোধী মতকে পরিসর দেয়নি। ওরা যা যা করেছে সেগুলো ‘নতুন’ বাংলাদেশে আর হবে না। কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকারের সাম্প্রতিক সব কাজই অক্কাপ্রাপ্তির আগে আওয়ামী বিধিবিধানের অনুলিপি বলে মনে হচ্ছে। জামায়াত নিষিদ্ধের স্টাইলে ছাত্রলীগ নিষিদ্ধ করা হলো। ছাত্রলীগ সন্ত্রাসী, নাকি সরকার সমর্থিত সব ছাত্রসংগঠন বরাবরই সন্ত্রাসী, সে কথা ভাবা হলো না। ইতিহাস কী বলে? শুধু ছাত্রলীগ বাদ না দিয়ে সব বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পুরো ছাত্ররাজনীতি বাদ দিলে বোঝা যেত যে সরকার প্রতিশ্রুত রাষ্ট্র সংস্কারে এক ধাপ এগিয়ে গেল। পৃথিবীর যেসব দেশে শিক্ষার মান উন্নত হয়েছে, সেগুলোর কোনোটিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় স্টাইলে ছাত্ররাজনীতি হয়? বৈশ্বিক সূচকে তাই তো এত অধঃপতন।“

Advertisement

প্রসঙ্গত বলে রাখা দরকার যে, অর্থশাস্ত্রে ‘নিষিদ্ধ ‘ শব্দটাই অনেকখানি নিষিদ্ধ কারণ এতে করে নিষিদ্ধ বস্তু বা ব্যক্তির প্রতি আগ্রহ বাড়ে ।

তিন. বিদগ্ধ মহলে জোর আলোচনা এই যে প্রথম থেকেই সরকারের উচিত ছিল কঠোর হস্তে আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে রাখা। অব্যাহতভাবে একের পর এক কলকারখানায় আগুন লাগিয়ে লুট মালামাল লুট, কর্মচারী পুড়ে মারা, ব্যবসাবাণিজ্য এবং উৎপাদনে নিয়োজিত শিল্প প্রতিষ্ঠান জ্বালিয়ে দেয়া, চাঁদাবাজি , মাস্তানি, দখলদারি চলল বেশ কয়েক মাস। চলছে এখনও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নাকের ডগায়। এমনকি মাইকে ঘোষণা দিয়ে প্রতিপক্ষের বাড়ি গুঁড়িয়ে দেয়া, নারীর উপর দুর্বৃত্তদের ঝাঁপিয়ে পড়া এবং কিছু মাওলানার উস্কানিমুলক নারী-বিদ্বেষীবক্তব্য পরিস্থিতি বেসামাল করে রেখেছে অথচ সরকারি আইন শৃঙ্খলা বাহিনি এসব কর্মকাণ্ডের নীরব সাক্ষী হয়ে থাকছে– যেন ওই গানের মতো চেয়ে চেয়ে দেখলাম তুমি জ্বালিয়ে গেলে, আমার বলার কিছু ছিল না, না গো। বলাবাহুল্য যে, দুষ্কৃতিকারীদের এসমস্ত অপকর্ম বাংলাদেশের ভাবমূর্তিকে ভেতরে বাহিরে অনেক খারাপ রেখেছে। বিখ্যাত মানবাধিকার সংথাগুলো বলছে , বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতির নাকি অবনতি ঘটছে ।

বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, প্রায় ত্রিশ লক্ষ লোক গেল ক মাসে দরিদ্র হয়েছে। হয় ত তারা কোনোমতে পানির উপর নাক রেখে টিকে ছিল কিন্তু ব্যবসা-বান্ধব এবং মানবিক পরিস্থিতির অবনতিতে ধাক্কা খেয়ে খাঁদে পড়েছে। অভিজ্ঞ মহল মনে করেন, বাংলাদেশে দারিদ্র্য ও বৈষম্য বেড়ে যাওয়ার পিছনে কাজ করেছে মূল্যস্ফীতি, চাকরি হারানো ও অর্থনীতির ধীরগতি। বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, উচ্চ মূল্যস্ফীতির ফলে নিম্নবিত্ত মানুষকে চড়া দামে নিত্যপণ্য কিনতে হচ্ছে এবং চলতি অর্থবছরে গড় মূল্যস্ফীতির হার আরও বেড়ে ১০ শতাংশ হতে পারে। এদিকে, আমরা জানি ১৬ শতাংশ সুদের সাথে অতিরিক্ত দুই শতাংশ দিয়ে মোট ১৮ শতাংশে ঋণের চাহিদা মেটাতে গিয়ে ব্যবসায়ীর ত্রাহি মধুসদন অবস্থা।

এছাড়া, চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে প্রায় চার শতাংশ শ্রমিক চাকরি হারিয়েছেন। এই একই সময়ে দক্ষ কর্মীদের মজুরি দুই ও উচ্চ দক্ষ কর্মীদের মজুরি দশমিক পাঁচ শতাংশ কমেছে। এ কারণে জাতীয় দারিদ্র্য হার বাড়ছে, চরম দারিদ্র্যের হারও অনেক বেড়ে যাবে বলে বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। একই সঙ্গে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, চলতি অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধিও কমে যাবে এবং জিডিপি'র অনুপাতে সরকারের ঋণের পরিমাণ আগের চেয়ে বাড়তে পারে। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধি তিন দশমিক তিন শতাংশ হতে পারে; যা গত বছর ছিল চার দশমিক দুই শতাংশ। ২০২২-২৩ অর্থবছরে ছিল পাঁচ দশমিক আট শতাংশ।“

Advertisement

চার.অবশ্য বর্তমান সরকার -সমর্থক অর্থনীতিবিদ তথা বুদ্ধিজীবীরা বলতে চাচ্ছেন বিগত আমলের দারিদ্র্য হ্রাসের বয়ান ‘বানানো’ তথ্যের উপর নির্ভরশীল ছিল; দারিদ্র্যের অনুপাত আগ থেকেই বেশি ছিল বলে নাকি এই অবস্থা। তবে মূল্যস্ফীতি, চাকরি হারানো ও অর্থনীতির ধীরগতি'র মতো যেসব বিষয়কে দারিদ্র্য বেড়ে যাওয়ার কারণ হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছে বিশ্বব্যাংক প্রতিবেদনে, অর্থনীতিবিদেরাও তাতে একমত।

পাঁচ.সমালোচকদের ধারণা , সরকার অর্থনৈতিক সংস্কারের দিকে নজর দিয়েছে খুব কম; সব নজর কেড়ে নিয়েছে রাজনৈতিক সংস্কার । ব্যবসাবাণিজ্য এবং শিল্প -কারখানায় গতি ফিরিয়ে আনার ক্ষেত্রে প্রয়াসের ঘাটতি আছে; চাঁদাবাজি চলছে আগের মতই বলে উপদেষ্টারা খালাস কিন্তু নতুন চাঁদাবাজ ও দখলদারিদের ধরার কোনো তৎপরতা লক্ষণীয় নয়। সুতরাং, মাননীয় প্রধান উপদেষ্টা নোবেল জয়ী ড মুহাম্মাদ ইউনূস কর্তৃক বহুল প্রচারিত এবং প্রখ্যাত ‘তিন শূন্য’ দর্শন বাংলাদেশের মাটিতেই এবং আপাতত মার খাচ্ছে বলে মনে হয়- দারিদ্র্য বাড়ছে , কর্মসংস্থান কমছে এবং কার্বন নিঃসরণ ঊর্ধ্বমুখী । এবং এর পেছনে মুল কারণ ব্যবসাবাণিজ্য, পরিবেশ এবং শিল্প -বান্ধব নীতিমালার অনুপস্থিতি এবং ব্যবসায়ী মহলে অযথা আতংক সৃষ্টি । যে দেশে মব ভায়লেন্স ব্যাপক বিরাজ করে সে দেশে বিদেশি বিনিয়োগ দূরে থাক, দেশি বিনিয়োগ বলতে বাধ্য হয় ‘ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি’ এবং পেছনের খিড়কি দিয়ে পালায়। বিনিয়োগ ছাড়া কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং দারিদ্র্য হ্রাস সম্ভব নয় আর তাই মধুচন্দ্রিমা কাল শেষে বাস্তবে দৃষ্টি দেয়া জরুরি। এবং এক্ষণই ব্যবসাবাণিজ্য তথা অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের স্বাধীনতা পুনুরদ্ধার করা না গেলে সমুহ বিপদের সম্ভাবনা আছে। এটা অতীব দুঃখের কথা যে, মাত্র এক বছরের মাথায় দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির এত ব্যাপক অবনতি ঘটে যা জুলাই- আগস্ট অভ্যুত্থানের চেতনাকে আঘাত করবে।

ছয়.আমাদের প্রিয় প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ বিরুপক্ষ পালের বক্তব্যটা এরকমঃ “ শুধু নির্বাচন দিতে এ সরকার আসেনি। জনতা তা চায়নি। হঠাৎ উচ্ছ্বাসে ভাটা পড়ল কেন? রবীন্দ্রনাথ ‘শেষের কবিতা’য় বলেছেন, দুর্বলের শাসন বড় ভয়ংকর। কী অর্থে তিনি তা বলেছেন বোঝা কঠিন। তবে দুর্বলের শাসন যে বিশৃঙ্খলাপূর্ণ সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। এ বিশৃঙ্খলাই অর্থনীতির বারোটা বাজাচ্ছে এবং আরো বাজাবে। শেয়ারবাজার তার প্রতিফলন। ব্যাংক খাত অনেকটা স্থবির। নতুন বিনিয়োগ বাড়ছে না। উচ্চ সুদে তা আরো ব্যাহত হওয়ার কথা। মূল্যস্ফীতি দমনে উচ্চ সুদহার অবশ্যই অনিবার্য। কিন্তু এটি বড় অসময়ে বেড়েছে। কারণ গত সরকারের আমলে নয়-ছয় সুদহারের বেড়াজালে যথাসময়ে সুদ বাড়ানো হয়নি মূলত ধনিকতুষ্টির অন্যতম কর্মসূচি হিসেবে।’পাদটীকা:

বিবিএস এর ২০২৫ সালের এক সমীক্ষা বলছে, গেল ১২ মাসে বাংলাদেসের প্রতি তিন জনের মধ্যে এক জন বিভিন্ন গণ সেবা পেতে ঘুষ দিয়েছেন – সবচেয়ে বেশি বি আর টি এ, পুলিশ , পাসপোর্ট , জমি নিবন্ধন এবং বিচারিক সেবা; উত্তরদাতাদের মাত্র ২৭ শতাংশ বিশ্বাস করে সরকারের করণীয়র উপর তারা মতামত ব্যক্ত করতে পারেন এবং মাত্র ২১ ভাগ মনে করেন রাজনীতিতে তাদের কিছু বলার আছে। অথচ বিগত আন্দোলনটি ছিল দুর্নীতির বিপক্ষে এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক রাজনীতির পক্ষে।

লেখক : অর্থনীতিবিদ, কলামিস্ট। সাবেক ভিসি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।

এইচআর/এমএস