ক্যাম্পাস

ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে ‘জীর্ণদশায়’ দাঁড়িয়ে সলিমুল্লাহ মুসলিম হল

ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে ‘জীর্ণদশায়’ দাঁড়িয়ে সলিমুল্লাহ মুসলিম হল

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যতম প্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী আবাসিক হল সলিমুল্লাহ মুসলিম হল। সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের আদি নাম মুসলিম হল। একসময় এটি বিশ্ববিদ্যালয়ের গৌরবময় শিক্ষা ও আবাসন সংস্কৃতির প্রতীক ছিল। কিন্তু শতবর্ষ পেরিয়ে আসার পর বর্তমানে হলটির চেহারা অনেকটাই বদলে গেছে। একদিকে যেমন রয়েছে ঐতিহ্যের গৌরবগাঁথা, অন্যদিকে রয়েছে সংস্কারের অভাবে ভেঙে পড়া অবকাঠামো ও প্রশাসনিক অব্যবস্থাপনার বাস্তবতা।

Advertisement

সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের যাত্রা শুরু হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সময়ই। মুসলিম ছাত্রদের জন্য আবাসন সুবিধা নিশ্চিত করতে তৎকালীন ব্রিটিশ প্রশাসন ও স্থানীয় মুসলিম নেতৃত্বের সহযোগিতায় এই হল প্রতিষ্ঠা করা হয়। প্রথম বছরেই মুসলিম হলে মোট ১৭৮ জন আবাসিক এবং ৭৫ জন শিক্ষার্থী সংযুক্ত ছিলেন। সহযোগী অধ্যাপক আহমেদ ফজলুর রহমান সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের প্রভোস্ট হিসেবে নিয়োগ পান। দুজন গৃহশিক্ষকও ছিলেন। তাদের একজন ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ এবং অন্যজন ফখরুদ্দিন আহমেদ।

হলটির নামকরণ করা হয় নওয়াব স্যার খাজা সলিমুল্লাহর স্মরণে, যিনি ঢাকায় মুসলমানদের আধুনিক শিক্ষায় আগ্রহী করে তোলায় অসামান্য ভূমিকা রেখেছিলেন। তার নামে নামাঙ্কিত এই হল কেবল একটি আবাসন কেন্দ্র নয়, বরং সেসময় মুসলিম সমাজে শিক্ষা বিস্তারের প্রতীক ছিল।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দক্ষিণ-পূর্বাংশে অবস্থিত হলটি ছাত্র-ছাত্রীদের দৈনন্দিন যাতায়াতের দিক থেকে কিছুটা দূরবর্তী হলেও একসময় এটি ছিল আবাসিক জীবনের প্রাণকেন্দ্র। ব্রিটিশ আমলের নির্মাণশৈলীতে গড়া এই ভবনের পুরোনো কাঠামো এখনো ইতিহাস বহন করে।

Advertisement

আরও পড়ুন ঢাকার নগর জাদুঘর দেখতে যায় না ‘কেউ’ মুক্তিযুদ্ধ ও চব্বিশের গণঅভ্যুত্থান একে অন্যের পরিপূরক ঢাবিতে হলে সিট না পাওয়াদের আবাসন বৃত্তি দেওয়ার দাবি ছাত্রদলের

সরেজমিনে দেখা যায়, হলটিতে রয়েছে প্রায় ১৮০টি কক্ষ, লাইব্রেরি, পাঠকক্ষ, পত্রিকা রুম, কমনরুম, ক্যানটিন ও গেমস রুমসহ নানান ধরনের সুবিধা। তবে দীর্ঘদিন সংস্কার না হওয়ায় এসব কক্ষ ও সুবিধাসমূহের অনেকটাই এখন ব্যবহার অনুপযোগী বলে জানা হলের শিক্ষার্থীরা।

সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের ২০১৯-২০ সেশনের শিক্ষার্থী ইখলাস ভূইয়া হলের বিভিন্ন সমস্যা ও অব্যবস্থাপনা জাগো নিউজের কাছে তুলে ধরেন। ইখলাস ভূইয়া বলেন, হলের বিভিন্ন রুমে ছাদের পলেস্তারা খসে পড়ছে, কিছু রুমে বর্ষাকালে পানি চুঁইয়ে পড়ে। এরই মধ্যে প্রায় ২০ থেকে ৩০টি রুম বসবাসের অযোগ্য ঘোষণা করা হয়েছে। রিডিং রুম ও পত্রিকা রুমের অবস্থা এতটাই নাজুক যে, সেগুলো শিক্ষার্থীরা ব্যবহার করতে পারছেন না।

প্রশাসনের নির্লিপ্ততার অভিযোগ করে এই শিক্ষার্থী বলেন, বিগত দশকগুলোতে শিক্ষার্থীরা এই হল সংস্কারের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে উদ্যোগ নেওয়ার জোর দাবি জানিয়ে আসা সত্ত্বেও উল্লেখযোগ্য কোনো অগ্রগতি হয়নি। এমনকি জুলাই বিপ্লবের পরেও হল সংস্কারের বিষয়ে প্রশাসনকে কোনো দৃশ্যমান উদ্যোগ নিতে দেখা যায়নি। হলের বাথরুমের সংখ্যা প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম এবং অনেকগুলো অচল অবস্থায় আছে। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা নিয়মিত না হওয়ায় দুর্গন্ধ এবং স্বাস্থ্যঝুঁকির পরিবেশ সৃষ্টি হয়। পানি সরবরাহে অসামঞ্জস্য এবং প্রায়ই পানি সংকট দেখা দেয়।

একসময় ঐতিহ্যবাহী এই হল কার্যত বন্ধ ঘোষণা করার মতো পরিস্থিতি তৈরি হয়। যদিও এই সিদ্ধান্তের পেছনে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য রয়েছে বলে মনে করেন এই শিক্ষার্থী। তিনি বলেন, রাজনৈতিক কারণে হলটিতে অ্যালটমেন্ট (সংযুক্তি) বন্ধ ছিল। ফলে হলের বিভিন্ন কালচারাল ক্লাব, ডিবেট ক্লাবসহ সব সহশিক্ষা কার্যক্রম ব্যাহত হয়। পর্যাপ্ত শিক্ষার্থী না থাকায় হলের সামগ্রিক কার্যক্রম চিরতরে বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়। তবে হলের রানিং শিক্ষার্থীরা প্রতিবাদ জানালে ২০২৪-২৫ সেশনের ১২০ জন শিক্ষার্থীর অ্যালটমেন্টের মাধ্যমে হলটি যেন আবার প্রাণ ফিরে পেয়েছে।

Advertisement

হলের ক্যানটিনে নিয়মিত মানহীন ও পচা খাবার সরবরাহের অভিযোগ রয়েছে। শিক্ষার্থীরা জানান, খাবারের মান খারাপ, আবার দামও তুলনামূলক বেশি। এমনকি বেশ কয়েকবার খাবার খেয়ে শিক্ষার্থীরা অসুস্থ পড়েছেন বলেও অভিযোগ রয়েছে। ক্যানটিনে নিয়মিত খাবার সরবরাহ সম্ভব না হওয়ায় শিক্ষার্থীদের বাধ্য হয়ে অন্য হলের ক্যানটিনে গিয়ে খেতে হয়।

২০১৯-২০ সেশনের আরেক শিক্ষার্থী ইমরান হক বলেন, সলিমুল্লাহ হল থেকে একাডেমিক ভবনের দূরত্ব তুলনামূলক অনেক বেশি। অন্যদিকে, বিজ্ঞান অনুষদের হলগুলো বা হলপাড়ার অন্য হলগুলোর অবস্থান একাডেমিক ভবনের কাছাকাছি। তবে দূরত্বের কথা বিবেচনায় রেখেও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন কোনো শাটল বাসের ব্যবস্থা করেনি। প্রতিদিন হেঁটে যাতায়াত করতে গিয়ে আমাদের ক্লান্তি ও সময় অপচয়ের পাশাপাশি মানসিক চাপও বাড়ছে।

আরও পড়ুন জিয়া স্মৃতি জাদুঘর আবার উন্মুক্ত হচ্ছে হারিয়ে যাচ্ছে গ্রামীণ ঐতিহ্যের মাটির ঘর সম্রাট শাহজাহানের শাসনামলে নির্মিত রায়েরকাঠি জমিদার বাড়ি

শিক্ষার্থীরা বলছেন, সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের বর্তমান স্থাপত্য কাঠামো ঠিক রেখেই এর ব্যাপক সংস্কার প্রয়োজন। এর পাশাপাশি, দক্ষিণ-পশ্চিম পাশে এক্সটেনশন ভবন নির্মাণ করে আবাসন সংকট সমাধান করা সম্ভব। তারা চায়, প্রতি বছর অন্তত ২৫০-৩০০ জন শিক্ষার্থী যেন এই হলে অ্যালটমেন্ট পায়, যেন সহশিক্ষা কার্যক্রম সচল থাকে। লাইব্রেরি, পত্রিকা রুম, রিডিং রুম, সেলুন, গেমস রুম এবং সব ওয়াশরুম আধুনিকায়ন ও ব্যবহারোপযোগী করার দাবিও জানান তারা।

শাহেদুল সোহাগ নামে আরেক শিক্ষার্থী সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের বর্তমান অব্যবস্থাপনাকে বিগত আওয়ামী লীগ লালিত প্রশাসনের দাবি করে বলেন, আওয়ামী লীগ লালিত বিগত ঢাবি প্রশাসন চায়নি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার মূল নায়কদের কেউ চিনুক, তাই তারা এটিকে মূলত এক হিসেবে পরিত্যক্ত করে ফেলতে চেয়েছিল। তবে সেই দিন বদলে গেছে।

তিনি বলেন, সলিমুল্লাহ মুসলিম হল শুধু একটি আবাসিক ভবন নয়; এটি একটি ইতিহাস, একটি প্রতিষ্ঠান, একটি চেতনার নাম। এখনই সময়, প্রশাসনিক সদিচ্ছা, বাজেট বরাদ্দ, শিক্ষার্থী অংশগ্রহণ এবং প্রকৌশলগত পরিকল্পনার সমন্বয়ে এই হলের গৌরব পুনরুদ্ধার করা। শতবর্ষের গৌরব বাঁচিয়ে রাখতে হলে প্রয়োজন তাৎক্ষণিক সংস্কার ও সঠিক ব্যবস্থাপনা।

সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. নিয়াজ আহমেদ খান জাগো নিউজকে বলেন, এই হল একরকম সিস্টেমেটিক নেগলেক্টের (কৌশলগত অবহেলা) শিকার। এটিকে এবার আমরা একটা প্রতীকী হলেও বরাদ্দ দিয়ে চালু রাখার চেষ্টা করছি। বিশ্ববিদ্যালয়ের দায়বদ্ধতার জায়গা থেকে হলটি রক্ষা করা, এর ঐতিহ্য রক্ষা করা আমাদের কর্তব্য।

তিনি বলেন, বুয়েটের বিশেষজ্ঞদের দিয়ে আমরা এটা রেনোভেশনের (সংস্কার) ডিজাইন করাচ্ছি। সেই কাজ বেশকিছু এগিয়েছে। এখানে এসে আমাদের ইঞ্জিনিয়াররাও মোটামুটি দেখে গেছেন। আমরা বারবার নিশ্চিত করছি যে হলের মৌলিক কাঠামো এবং মৌলিক ডিজাইনে যেন কোনো পরিবর্তন না আসে। যে কয়টা রুম চালু রাখা যায় সেগুলো চালু রাখার চেষ্টা করছি। আমাদের প্রকল্পের আওতাধীন সলিমুল্লাহ মুসলিম হল এবং হাজী মুহম্মদ মুহসীন হলকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে সংস্কারের কথা বলেছি আমরা।

শিক্ষার্থীদের হলের ক্যানটিনের খাবার নিম্নমানের অভিযোগের বিষয়ে উপাচার্য বলেন, ক্যানটিনগুলোতে যে টাকায় খাবার দেওয়া হয়, সেই টাকায় এর চেয়ে বেশি আর সম্ভব নয়। তবে আমরা চেষ্টা করছি যেন ক্যানটিনগুলো হাইজিন (স্বাস্থ্যবিধি) রক্ষা করে। এটা নিয়ে গতকালও মিটিং করেছি। হাউজ টিউটরদের মাধ্যমে হলগুলোর ক্যানটিনের খাবার তদারকির জন্যও ব্যবস্থা নেবো।

এফএআর/ইএ/এমএফএ/জিকেএস