কুমিল্লার মুরাদনগরে তিনজনকে প্রকাশ্যে পিটিয়ে হত্যার ৩০ ঘণ্টা পরও মামলা হয়নি। ঘটনার সঙ্গে জড়িত কাউকে গ্রেফতার করতেও পারেনি পুলিশ। এরপর থেকে গ্রামে থমথমে অবস্থা বিরাজ করছে। গোটা এলাকা পুরুষশূন্য। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে উপজেলার কড়ইবাড়িতে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়ন করা হয়েছে।
Advertisement
পুলিশের দাবি ঘটনার পরপর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী অভিযানে নামে। পুরুষশূন্য থাকায় বিকেল পর্যন্ত অভিযান চালিয়েও কাউকে গ্রেফতার করা যায়। এ ঘটনায় থানায় হত্যা মামলা দায়েরের প্রস্তুতি চলছে।
এর আগে স্থানীয় বাজারে এক স্কুল শিক্ষকের মোবাইল ফোন চুরির জের ধরে বৃহস্পতিবার (৩ জুলাই) সকাল সাড়ে ৯টার দিকে উপজেলার আকবপুর ইউনিয়নের কড়ইবাড়ি গ্রামবাসী একত্রিত হয়ে খলিলুর রহমানের স্ত্রী ও চিহ্নিত মাদক ব্যবসায়ী রোকসানা আক্তার রুবি (৫৫), তার ছেলে রাসেল মিয়া (৩৮) ও মেয়ে জোনাকিকে (৩২) পিটিয়ে হত্যা করে। এ সময় তাদের পিটুনিতে গুরুতর আহত হন রুবির মেয়ে রুমা আক্তার (২৪)। তিনি বর্তমানে রাজধানীর একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।
পুলিশ জানিয়েছে, নিহত পরিবারের পাঁচ সদস্যের বিরুদ্ধে ৪৩টি মামলা রয়েছে। এর মধ্যে রুবিসহ তিনজনের বিরুদ্ধে ৩০টি মামলা রয়েছে। এসব মামলার অধিকাংশই মাদক কেনাবেচা এবং মারামারির ঘটনা।
Advertisement
হত্যাকাণ্ডের খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে ছুটে যান কুমিল্লা পুলিশ সুপার (এসপি) নাজির আহমেদসহ একাধিক গোয়েন্দা সংস্থার কর্মকর্তারা। মরদেহ উদ্ধার করে ময়নাতদন্তের জন্য কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল মর্গে পাঠানো হয়।
বাঙ্গরা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মাহফুজুর রহমান বলেন, ঘটনার পরপর পুলিশ অভিযানে নেমে। শুক্রবার ভোর ৫টা পর্যন্ত পুলিশসহ একাধিক আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী চালিয়েছে। এলাকায় পুরুষশূন্য থাকায় কাউকে গ্রেফতার করা যায়নি। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে কড়ইবাড়িতে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন রয়েছে। নিহতের পরিবারের সঙ্গে কথা হয়েছে। তারা মামলা দায়েরের প্রস্তুতি নিচ্ছেন। আমাদের গ্রেফতার অভিযান অব্যাহত রয়েছে।
কুমিল্লা পুলিশ সুপার (এসপি) নাজির আহমেদ খান বলেন, অপরাধী যে হোক না কেন তাকে দ্রুত আইনের আওতায় আনা হবে। অভিযান চলমান রয়েছে।
হত্যার নেপথ্যেরোকসানা আক্তার রুবিসহ তার পরিবারের সদস্যরা দীর্ঘদিন ধরে মাদক কারবারের সঙ্গে জড়িত থাকলেও হত্যার নেপথ্যে মিলেছে ভিন্ন তথ্য। গত মঙ্গলবার (১ জুলাই) সকালে কড়ইবাড়ি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক রুহুল আমীন কড়ইবাড়ি বাজারে স্কুলের কাগজপত্র ফটোকপি করতে যান। ওই সময় এক কিশোর কৌশলে শিক্ষকের মোবাইল ফোনটি চুরি করে নিয়ে যায়। তাৎক্ষণিক ওই শিক্ষক মোবাইল চুরির বিষয়টি সবাইকে জানালে হায়দ্রাবাদ সড়কের মাথা থেকে ওই কিশোরকে ধরে মোবাইলটি উদ্ধার করা হয়।
Advertisement
ফোন চুরি করে নেওয়া কিশোর ছিল রোখসানা আক্তার রুবির আত্মীয়। খবর পেয়ে রুবি, তার মেয়ে জোনাকির স্বামী মনির ও ছেলে রাসেল শিক্ষক রুহুল আমীন ও স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) সদস্য বাচ্চু মিয়ার সঙ্গে বাগবিতণ্ডায় জড়ান। একপর্যায়ে তারা শিক্ষক রুহুল আমীন ও বাচ্চু মিয়াকে কিলঘুষি মারেন। ঘটনা জানতে পেরে রুহুল আমীনের ভাতিজা রবিউল ও ফয়েজ এগিয়ে এলে তাকেও মারধর করা হয়। ওই দিন বাড়ি গিয়ে বাচ্চু মিয়া, রবিউল ও ফয়েজকে দ্বিতীয় দফায় মারধর করেন রুবির পরিবারের সদস্যরা।
পরিবারটির এমন বেপরোয়া আচরণে এলাকাবাসী ক্ষিপ্ত হয় এলাকাবাসী। এনিয়ে বুধবার (২ জুলাই) বিকেলে কড়ইবাড়ি তিন রাস্তার মোড়ে এলাকাবাসী একত্রিত হয়। সেখানে উপস্থিত হন আকবপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান শিমুল বিল্লাহও। এ সময় বিক্ষুব্ধ এলাকাবাসী রুবি ও তার পরিবারকে আর ছাড় দেওয়া হবে না বলে যৌথ সিদ্ধান্ত নেন।
সিদ্ধান্ত মোতাবেক সকাল সাড়ে ৮টা থেকে এলাকাবাসী জড়ো হতে থাকেন। পরে সকাল সাড়ে ৯টার দিকে পরিকল্পিতভাবে নিহত রুবির বাড়িতে যান। এ সময় স্থানীয়দের দেখে রুবি ক্ষিপ্ত হয়ে কথা বাগবিতণ্ডার এক পর্যায়ে ইউপি সদস্য বাচ্চু মিয়াকে থাপ্পড় দেন। সঙ্গে সঙ্গে উপস্থিত গ্রামবাসী রুবি ও তার মেয়ে জোনাকিকে পিটিয়ে মেরে ফেলে। খবর পেয়ে শ্বশুরবাড়ি বেড়াতে যাওয়া রুবির ছেলে রাসেল মোটরসাইকেল নিয়ে ছুটে আসেন। বাড়ির গেটে আসার পরপর উত্তেজিত জনতা রাসেলকেও পিটিয়ে হত্যা করেন। এ সময় অপর মেয়ে রুমা আক্তার মুমূর্ষু অবস্থায় পড়ে ছিল। পুলিশ এসে তাকে উদ্ধার করে মুরাদনগর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে পাঠান।
আকবপুর ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান শাহ আলম জানান, ‘দীর্ঘদিন ধরে তারা মাদক কেনাবেচার সঙ্গে জড়িত ছিলেন। কিছু হলেই গ্রামের মানুষের সঙ্গে উগ্র ভাষা ব্যবহার করতেন। মোবাইল চুরির ঘটনাকে কেন্দ্র করে পরিবারের চার সদস্যকে গণপিটুনি দেয়। এতে তিনজন ঘটনাস্থলে মারা যান। একজনকে হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে।’
তবে নিহত রাসেল মিয়ার স্ত্রী মীম আক্তার কে বলেন, ‘আমার শ্বশুর খলিলুর রহমান ও ননদ রিক্তাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। এটি একটি পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড। গণপিটুনিতে স্বজনদের প্রাণহানির পর তিনি শুধু ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়েছিলেন। তিনি ভেবে পাচ্ছিলেন না কেন এমন নির্মম ঘটনা ঘটেছে। তিনি দায়ীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করেছেন।
নিহত তিনজনের যত মামলা চিহ্নিত মাদক ব্যবসায়ী রোকসানা আক্তার রুবির বিরুদ্ধে ১৬টি মামলা রয়েছে, তার ছেলে রাসেল মিয়ার বিরুদ্ধে ৯টা, মেয়ে জোনাকির বিরুদ্ধে পাঁচটি।
এছাড়াও নিহত রুবির মেয়ে আহত রুমার বিরুদ্ধে দুটি এবং নিহত জোনাকীর স্বামী মনিরের বিরুদ্ধে ১১টি মামলা রয়েছে। রুবির স্বামীর বিরুদ্ধেও একাধিক মামলা রয়েছে। এসব মামলার অধিকাংশই মাদক কেনাবেচার অভিযোগে দায়ের করা।
জাহিদ পাটোয়ারী/আরএইচ/জিকেএস