বাংলাদেশে কোভিড-১৯ এর চ্যাপ্টার শেষ, গত দু-তিন বছর ধরে কোভিড-১৯ এর নীরব অনুপস্থিতিতে সাধারণ মানুষের যে এমনই ধারণা জন্মেছিল এ বিষয়ে কারও সন্দেহ নেই। একমাস ধরে ঊর্ধ্বগতি, এমনকি গত তিনদিন অর্থাৎ ২১ থেকে ২৩ জুন ২০২৫ পর্যন্ত ১০ জনের মৃত্যু আবারো সবাইকে ভাবাচ্ছে। ‘কোভিড-১৯ এর ইতিহাস শেষ’ এমন আত্মতৃপ্তিতে আমাদের কারও কারও চির ধরেছে। ৮ মার্চ ২০২০ থেকে ৯৬৩ দিন ব্যক্তিগতভাবে বাংলাদেশের কোভিড-১৯ এর গতি প্রকৃতি পর্যবেক্ষণ করা ইস্তফা দিলেও আবারও পর্যবেক্ষণের পরিবেশ সৃষ্টি করছে বলে মনে হয়।
Advertisement
২০২০ ও ২০২১ এই দুটি বছরে বাংলাদেশসহ সারা বিশ্ব যেই দুঃস্বপ্নের ভিতর দিয়ে গিয়েছিল, সেখান থেকে অনেকেই আজ একটু স্বস্তির নিশ্বাস ফেলছেন। অথচ ভাইরাস বিশ্রামে নেই, রূপ বদলে আবার ফিরছে। সর্বশেষ যে রূপ নিয়ে বৈশ্বিক দুশ্চিন্তা দেখা দিয়েছে, তা হলো NB.1.8.1, অথবা ডাকনামে ‘নিম্বাস’। এটি মূলত ওমিক্রন পরিবারেরই নতুন সাবভ্যারিয়েন্ট, তবে আগের চেয়ে আরও দ্রুত ছড়াতে পারে এবং টিকা বা আগের সংক্রমণ থেকে পাওয়া রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে আংশিকভাবে পাশ কাটাতে সক্ষম এমনটাই ধারণা বিজ্ঞানীদের।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) ২০২৫ সালের ২৩ মে এটিকে "variant under monitoring" হিসেবে চিহ্নিত করেছে। অর্থাৎ এটি এখনো তেমন আতঙ্কের কারণ না হলেও, বিজ্ঞানীরা এটিকে নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছেন কারণ এটি দ্রুত ছড়াচ্ছে এবং ভাইরাসের আচরণে পরিবর্তন আনতে পারে বলে আশঙ্কা রয়েছে। অনেকের মতে, এই ভ্যারিয়েন্টটি ডাক্তার ও গবেষকদের মধ্যে উদ্বেগ তৈরি করছে-এটি আগের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাগুলো (টিকা বা পূর্ববর্তী সংক্রমণ) এড়িয়ে যেতে পারে।
এর মধ্যে আরও গুরুত্বপূর্ণ হলো, NB.1.8.1 ইতোমধ্যেই অন্তত ২০টি দেশে ছড়িয়েছে, যার মধ্যে আছে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ভারত, চীন, অস্ট্রেলিয়া এবং থাইল্যান্ড। বিশ্বে এপ্রিলের শেষ নাগাদ এই ভ্যারিয়েন্টের উপস্থিতি ছিল ১০.৭ শতাংশ, যা মার্চে ছিল মাত্র ২.৫ শতাংশ। এর মানে ভাইরাসটি দ্রুত নতুন অঞ্চলে এবং দেশে প্রবেশ করছে ও ছড়িয়ে পড়ছে।
Advertisement
NB.1.8.1-এর জিনগত পরিবর্তনের (mutation) মধ্যে রয়েছে A435S, V445H, এবং T478I, যা ভাইরাসের স্পাইক প্রোটিনে ঘটে এবং এগুলোর মাধ্যমে এটি প্রতিরোধব্যবস্থা এড়িয়ে যেতে সক্ষম হয়। সংক্রমণের হার বাড়ার জন্য এটিই দায়ী হতে পারে। এই ভ্যারিয়েন্ট বাংলাদেশের মতো দেশের জন্য আরও বড় ঝুঁকি কারণ এখানে পরীক্ষা কম, টিকা দেওয়ার গতি প্রায় থেমে গেছে, আর জনসচেতনতা শূন্যের কোঠায়।
দেশে এখনো NB.1.8.1 এর বিস্তার সম্পর্কে জানা যায়নি; তবে JN.1-এর নতুন সাবভ্যারিয়েন্ট XFG এবং XFC-এর বিস্তার ঘটেছে আইসিডিডিআরবি এমন প্রমাণ পেয়েছে| এসব সাবভ্যারিয়েন্টের বিরুদ্ধে কার্যকর কোনো হালনাগাদ টিকা নেই। তাই পুরোনো টিকাই ভরসা| স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানায়, এখনো ৩২ লাখ ডোজ পুরোনো টিকা মজুত রয়েছে, তবে সেগুলোর মেয়াদ দ্রুত শেষ হয়ে আসছে, আর নতুন ভ্যারিয়েন্টের বিরুদ্ধে সেগুলোর কার্যকারিতা সমানভাবে থাকবে আশা করলেও সে ব্যাপারে নির্দিষ্ট কোনো প্রমাণ নেই।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সর্বশেষ ড্যাশবোর্ড (২২ জুন ২০২৫ পর্যন্ত) বলছে, মহামারির পুরো সময়ে দেশে মোট ১ কোটি ৫৭ লাখ ১৮ হাজার ৮৭৮টি ল্যাব পরীক্ষা হয়েছে; শনাক্তের সংখ্যা ২০ লাখ ৫১ হাজার ৭৫৬ এবং মৃত্যু ২৯ হাজার ৫১৫ জন। শনাক্তের বিপরীতে মৃত্যুর হার প্রায় এক ১.৫ শতাংশ, বৈশ্বিকভাবে যেটা ১.০ শতাংশ| কাগজে-কলমে এগুলো অনেক বড় বড় সংখ্যা এবং পরিসংখ্যান, তবে তার চেয়েও বড় কথা হলো সাম্প্রতিক কোভিড-১৯ এর দ্রুত ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতাটি আমাদের আবারও চোখে আঙুল তুলে দেখাচ্ছে| ‘নিম্বাস’ কিংবা অন্য কোনো ভ্যারিয়েন্ট হয়তো আমাদের দরজায় কড়া নাড়ছে।
চলতি বছরের ১ জানুয়ারি থেকে ২২ জুন পর্যন্ত দেশে মাত্র ৫ হাজার ২৮২টি কোভিড পরীক্ষা হয়েছে, অথচ এরই মধ্যে ৪১৩ জনের সংক্রমণ ধরা পড়েছে এবং ১৯ জন মারা গেছেন (২৩ জুন ২০২৫ পর্যন্ত)। পরীক্ষার মাত্রা এত কম যে প্রকৃত সংক্রমণের চিত্র ধরা পড়ে না। তবু অস্বস্তিকর বাস্তবতা হলো, শুধু গত ২২ জুনের ২৪ ঘণ্টায় ৬২১টি নমুনা পরীক্ষায় ৩৬ জনের দেহে ভাইরাস মিলেছে; অর্থাৎ পজিটিভিটি রেট ৫.৮ শতাংশ, যা বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার সতর্ক সীমা পেরিয়ে গেছে। একই দিনে ৫ জন রোগী মারা গেছেন, বয়স ১৪ থেকে ৯৫ পর্যন্ত, আবার পুরুষ-নারী উভয়ই। বয়স ও লিঙ্গ কোনোটিই আর সুরক্ষার গ্যারান্টি নয়। ২৩ জুনও মারা গেছেন তিনজন| শুধু সংক্রমণ নয়, মৃত্যুও উদ্বেগজনক মাত্রায় বাড়ছে| রাজশাহী, কুমিল্লা, চট্টগ্রাম ও মিরপুরসহ দেশের নানা প্রান্ত থেকে মৃত্যুর খবর আসছে।
Advertisement
একদিকে কোভিড, অন্যদিকে ডেঙ্গু-দেশের হাসপাতাল ব্যবস্থা, মানবসম্পদ এবং সরবরাহ ব্যবস্থার ওপর চরম চাপ সৃষ্টি করতে পারে। অথচ স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোর পরিচ্ছন্নতা কার্যক্রম ও মশক নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম এখনো নিরুত্তর ও এলোমেলো। নাগরিকদেরও সচেতনতার ঘাটতি রয়েছে-বাড়ির আঙিনা, নির্মাণাধীন ভবন, ফুলের টব বা টায়ারে জমে থাকা পানিতে মশার প্রজনন হচ্ছে অনায়াসেই। অতএব কোভিড ও ডেঙ্গুর যুগপৎ মোকাবিলায় এখনই একটি সমন্বিত জাতীয় পরিকল্পনা ও জরুরি পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন।
পরীক্ষার সংখ্যা নাটকীয় ভাবে কমে গেলে নিম্ন পজিটিভিটি চলে আসে, আর পরীক্ষার সংখ্যা হঠাৎ বাড়ালে সংক্রমণের ঢেউ চোখে পড়ে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সর্বশেষ ড্যাশবোর্ড গ্রাফে দেখা যাচ্ছে, মে মাসের শেষ সপ্তাহ থেকে পরীক্ষা ও শনাক্ত দুই-ই ঊর্ধ্বমুখী। জুনের মাঝামাঝি ৬০০’র বেশি পরীক্ষা হয়েছে, শনাক্তের হার কোথাও কোথাও ৫০-৬০ শতাংশে পৌঁছেছে। এটি স্পষ্ট ইঙ্গিত দেয় যে, ভাইরাস আবার গতি পেয়েছে, যদিও আমরা হয়তো তাকে গণনায় ধরতে পারছি না।
এখন প্রশ্ন, এই নতুন ভ্যারিয়েন্ট NB.1.8.1 কি বেশি মারাত্মক? যুক্তরাষ্ট্রের জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ড. লিয়ানা ওয়েনের ভাষ্য অনুযায়ী, ‘নিম্বাস’ সম্ভবত দ্রুত ছড়ায়, তবে মারণ ক্ষমতা বাড়ার প্রমাণ এখনো মেলেনি। তবু বাংলাদেশের মতো ঘনবসতিপূর্ণ দেশে স্বাস্থ্য ব্যবস্থার ওপর চাপ তৈরি হতে সময় লাগবে না। আমাদের টিকাদান কার্যক্রম গত এক বছরে প্রায় স্থবির; জনগণের মাস্ক পরার অভ্যাসও প্রায় উধাও। এর মধ্যে পরীক্ষার পরিসর সংকুচিত হওয়া মানে সংক্রমণ ছড়ায় নীরবে, শনাক্ত হয় দেরিতে, মৃত্যু বাড়ে হঠাৎ করে। ড্যাশবোর্ডের দৈনিক মৃত্যুর গ্রাফ দেখলে, ৫ জুন থেকে ২২ জুনের মধ্যে মৃত্যুর উচ্চজর ও নিম্নচর একসঙ্গে দেখা যায়; অর্থাৎ ‘ক্লাস্টার’ তৈরি হচ্ছে, যা সামগ্রিক মৃত্যু কম হলেও স্থানীয় বিপর্যয় ঘটাতে পারে।
আবারও মনে করিয়ে দিই, করোনা ঠেকানোর সেরা উপায় তিনটি: ১. পর্যাপ্ত পরীক্ষা ও দ্রুত রিপোর্ট, ২. ঝুঁকিপূর্ণ জনসংখ্যাকে টিকার বুস্টার দেওয়া, ৩. ভিড় ও প্রতিকূল পরিবেশ ও জায়গায় মাস্ক ব্যবহার করা। সাম্প্রতিক যে প্রবণতা দেখা যাচ্ছে পরীক্ষা-সংখ্যা বাড়লেই শনাক্তের সংখ্যাও সমানুপাতিকভাবে বাড়বে; তবে কম পরীক্ষায় কম শনাক্ত ধরা পড়ায় ‘নিরাপদ’ ভাবার কোনো অবকাশ নেই। এখনই জেলা-উপজেলা পর্যায়ে পরীক্ষার সক্ষমতা বাড়াতে হবে, হাসপাতালগুলোতে অক্সিজেন সরবরাহ আর আইসিইউ শয্যার তালিকা হালনাগাদ করতে হবে, আর টিকাদানে নতুন ক্যাম্পেইন চালু করতে হবে, বিশেষ করে ষাটোর্ধ্ব ও ইমুনো-কমপ্রোমাইজড রোগীদের জন্য।
রাজশাহী, চট্টগ্রাম ও কুমিল্লার মৃত্যুর মানচিত্র বলছে ভাইরাস ইতোমধ্যে দেশব্যাপী হাজির। স্বাস্থ্যনীতিতে আমরা আর বিলম্ব করতে পারি না। যদি আগাম প্রস্তুতি নেওয়া যায়, তাহলে ২০২০-২১-এর মতো মর্মান্তিক অভিজ্ঞতা আমাদের আর তাড়িয়ে বেড়াবে না। ‘নিম্বাস’-কে অবজ্ঞা নয়; মৃদু হলেও এটি আমাদের প্রতি এক ধরনের সতর্কবার্তা। পরীক্ষার জাল ছড়িয়ে প্রকৃত সংক্রমণ চিহ্নিত করতে হবে, টিকা-বুস্টার নিশ্চিত করতে হবে, স্বাস্থ্যসেবার সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে। যথাযথ তথ্য, চিকিৎসা, সঠিক সময়ে বিজ্ঞানভিত্তিক পরিকল্পনা আর নাগরিক সচেতনতা-এদের প্রত্যেকটির সমন্বয়ে বাংলাদেশ নতুন মহামারি সামলানোর কৌশল নিতে হবে। অন্যথায়, পরিসংখ্যান কেবলই সংখ্যার খেলা হয়ে থাকবে; ক্ষতিটা ভোগ করবে মানুষ, সমাজ আর অর্থনীতি।
এই মুহূর্তে কোভিডের পাশাপাশি আরেকটি আতঙ্কের নাম ডেঙ্গু। রাজধানী ঢাকা এবং চট্টগ্রামসহ অন্যান্য বড় শহরে ডেঙ্গুর সংক্রমণ আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে। প্রতিদিন হাসপাতালে ভর্তি রোগীর সংখ্যা বাড়ছে, আইসিইউ বেডের চাহিদা তৈরি হচ্ছে এবং মৃত্যুও বেড়ে চলেছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৫ সালের প্রথম ছয় মাসেই ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন হাজার হাজার মানুষ এবং মৃতের সংখ্যাও ঊর্ধ্বমুখী। বিশেষত জুন-জুলাই মাসে মৌসুমি বৃষ্টিপাত শুরু হওয়ায় এডিস মশার প্রজনন বৃদ্ধির ফলে পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে উঠছে।
জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থায় এই দ্বৈত চাপ, একদিকে কোভিড, অন্যদিকে ডেঙ্গু-দেশের হাসপাতাল ব্যবস্থা, মানবসম্পদ এবং সরবরাহ ব্যবস্থার ওপর চরম চাপ সৃষ্টি করতে পারে। অথচ স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোর পরিচ্ছন্নতা কার্যক্রম ও মশক নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম এখনো নিরুত্তর ও এলোমেলো। নাগরিকদেরও সচেতনতার ঘাটতি রয়েছে-বাড়ির আঙিনা, নির্মাণাধীন ভবন, ফুলের টব বা টায়ারে জমে থাকা পানিতে মশার প্রজনন হচ্ছে অনায়াসেই। অতএব কোভিড ও ডেঙ্গুর যুগপৎ মোকাবিলায় এখনই একটি সমন্বিত জাতীয় পরিকল্পনা ও জরুরি পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন, নচেৎ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে।
লেখক : অধ্যাপক, ফলিত পরিসংখ্যান এবং ডেটা সায়েন্স, পরিসংখ্যান গবেষণা ও শিক্ষণ ইনস্টিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। hasinur@du.ac.bd
এইচআর/এমএফএ/জেআইএম